মত-মতান্তর

বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং: সেকাল ও একাল

তৌহিদুল হক

১৭ জুন ২০১৯, সোমবার, ৭:৫২ পূর্বাহ্ন

নিঃসন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় পরিবেশ। যেখানে মেনে ও মানিয়ে নিতে সময় লাগে। লাগে সাহস আর শীতের সকালে সতেজ চোখের পিটপিট চাহোনী। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আপন থেকে আরো আপন হয়। নিজের আদি বাড়ী মনে হয়। মনে হয়, জন্ম-জন্মান্তর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি। গাছের পাতা, কাক আর কোকিলের আওয়াজ, পুকুরে জমে থাকা পানি, শ্যাওলা সবকিছুর প্রতি এক নরম অনুভূতি তৈরী হয়। যে অনুভূতি সহজে কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না। কিংবা এড়িয়ে যেতেও চায় না। উচ্চশিক্ষায় একাডেমিক গন্ডীর বাইরে অনেক পড়াশুনা রয়েছে। যে পড়াশুনায় ক্যাম্পাসের সবাই কিছু না কিছু শিখায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঋণ কেউ শোধ করতে পারবে না।
নিজেকে উঁচুস্তরে নিয়ে যাবার বাসনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রার শুরুতে অনেককেই একটু হোঁচট খেতে হয়। হোঁচট খেতে হয় সিনিয়র ভাই-আপুদের কাছ থেকে। হোঁচটের আভিধানিক নাম র‌্যাগিং। আর চলতি বা যন্ত্রণার চাঁদড়ে মোড়া নাম ‘ফাঁপড় খাওয়া’। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আলাদা একটা ভালোবাসা জন্মায়। বহুবার দেখেছি যে, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে সেরা প্রতিষ্ঠিত করতে শিক্ষার্থী কিংবা পাশকরা শিক্ষার্থীদের তর্কাতর্কি। এমনকী মনোমালিন্য, হাতাহাতি। পরে কোলাকোলি। এইতো বিশ্ববিদ্যালয়। পেছনে ফিরে তাকালে অদ্ভূত ভালোলাগা নিয়ে স্মিত হাসি আর আনন্দশ্রু।
ইদানিং, বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে মাত্রা ছাড়িয়ে উচ্চমাত্রায় গিয়ে পৌঁছে যায়। যার নাম নির্যাতন, ভীতি প্রদর্শন। এর মধ্য দিয়ে অনেকেই ঘাবড়ে যায় বা ভয় পায়। এ ভয় কাটাতে সময় লাগে। একটি বিষয় হলো র‌্যাগিং কী চলতি সময়ে হচ্ছে, না অতীতেও ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং সব সময়ই ছিলো। শুধু ধরণ পাল্টাচ্ছে।
অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং এর ধারণা সম্পর্কে যা জানা যায়, তাহলোÑ অতীতে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক আজকের মতো ছিলো না। র‌্যাগিং দু’টি বিশেষ জায়গায় ছিলো। একটি ডিপার্টমেন্ট অন্যটি আবাসিক হল। বিভাগে সিনিয়র ভাই-আপুদের দাপট থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে স্বাভাবিকতার বৈশিষ্ট্য সালাম দেয়া, সিনিয়র কথা বললে তা মেনে নেয়া, মিষ্টি করে আপু ডাকা, বড় ভাই-আপুদের নিকটজন হওয়ার একটি চেষ্টা ছিলো।
অন্যটি হলো বসবাসরত আবাসিক হল। এখনকার মতো শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশী না হওয়াতে অতীতে হলের সবাই সবাইকে প্রায় চিনতো। তবে হলে র‌্যাগিং এর ধরণ ছিলো রুমে সিনিয়র একটু ভাব ও আভিজাত্য নিয়ে কথা বলা, বন্ধুত্বপূর্ণ দূরত্ব বজায় রাখা। জুনিয়রের কথার জবাবে নতুন বুদ্ধিজীবি ধারা সম্পন্ন উত্তর।
এভাবেই দূরে রাখতে গিয়ে কখন কাছে এসেছে, কেউ জানে না। জানে, যে নেই, আর যারা আছে। দূরত্ব হয়তো কাছে আসার দুনির্বার শক্তি নিয়ে হাজির হয়, দূরত্বের মধ্য দিয়ে কাছে আসার গল্পে সারা জীবনের পরশ লেগে থাকে।
বর্তমান সময়েও বিভাগ ও হলে র‌্যাগিং হয়। বিভাগে র‌্যাগিং এর ধরণ অতীতের মতোই রয়েছে। সিনিয়রদের ভাব ও বুদ্ধিজীবি স্টাইল। সব প্রশ্নের উত্তর জানা স্বভাব। পরিবর্তন এসেছে হলে। হলে জুনিয়রদের গ্রহণ করতে গিয়ে সিনিয়ররা নিজেদের অবস্থান, ভাব-মর্যাদা, আধিপত্য ধরে রাখতে একটু শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষার নাম ‘ম্যানার’ শেখানো, এই শিক্ষার নাম ‘বরণ’। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত শিক্ষার্থীকে একটি দিয়াশলাই কাঠি দিয়ে রুমর দৈর্ঘ-প্রস্থ মাপার আদেশ দেয়া। আবার কাঁদার নামতা পড়তে বলা হয়। ব্যাপারটি ইন্টারেস্টিং ও মজার। তবে ঘটনা যখন ঘটে তখন আর মজার থাকে না। কাঁদার নামতা ‘প্যাকের নামতা’ নামে পরিচিত।
এর চর্চাটি এভাবে, প্যাক এক্কে প্যাক, প্যাক দু’গুণে প্যাক প্যাক..... চলতে থাকে। এখন ভাবলে মজা লাগে, সেই সময় যার ওপর দিয়ে এই ¯্রােত যায় সে বুঝতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ে বইয়ের পড়ার বাইরে আরো পড়া আছে, সেখানে প্যাক বা কাঁদা এড়িয়ে গেলে চলবে না।
তবে র‌্যাগিং এর মধ্য দিয়ে সম্পর্কের গভীরতা কারো কারো ক্ষেত্রে প্রশস্ত হয়েছে, নিকট থেকে নিকটতম হয়েছে। ডিপার্টমেন্টের এক সিনিয়র নারী শিক্ষার্থী র‌্যাগ দিতে গিয়ে জুনিয়রের প্রেমে পড়েছে। জুনিয়রও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে তা হলোÑ র‌্যাগিং এর মাধ্যমে কারো মধ্যে ভীতির সঞ্চার করা যাবে না, কাউকে অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় হয়রানি করা যাবে না। আজকে যে সিনিয়র সে একসময় বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাবে। রেখে যাবে স্মৃতি, নিয়ে যাবে স্মৃতি। আবার আজ যে জুনিয়র সে একদিন সিনিয়র হবে। আসা-যাওয়ার খেলায় কারো মনে কষ্ট দিলে, সেই কষ্ট হৃদয়ে বেশী বাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র ও জুনিয়র মিলে এমন এক মেলবন্ধন সৃষ্টি করবে যেখানে বন্ধুত্বের দাবিতে হৃদয় কথা বলবে।

লেখক: অপরাধ ও সমাজ গবেষক এবং সহকারী অধ্যাপক
সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: [email protected]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status