চলতে ফিরতে

কাছের বন্ধু টেমস নদী

ইশরাক পারভীন খুশি

২৫ আগস্ট ২০১৮, শনিবার, ৭:২১ পূর্বাহ্ন

সকালে ঘুম ভেঙে জানালার পর্দা সরাতেই মোহময় এক সকাল। দেয়াল জুড়ে বিশাল জানালা যার কোন গ্রিল নেই। যে কেউ ইচ্ছে করলেই জানালা টপকে নিচে ঝাঁপ দিতে পারবে। আমি থাকতাম দোতলার এক কামড়ায়। দেশে বসে ভাবতাম ভাবতাম বিদেশে না জানি সবকিছু আলিশান। না, সাধারণ কাঠের তেচালা বাংলো অথবা সারি সারি স্কুলঘরের মত দেখতে এ্যপার্টমেন্ট এত সাদামাটা যে কল্পনার সঙ্গে একেবারেই মিলেনা। তবে ছিমছাম শব্দহীন আর পরিস্কার ও সুন্দর পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা সবকিছু। সেই প্রথম কার্পেট পরিষ্কারের যন্ত্র হোবার মানে ভ্যকুয়াম ক্লিনার অবাক হলাম। যন্ত্রটি দেখতে হালকা মনে হলেও আসলে কার্পেট পরিস্কার করতে ঘাম বের হয়ে যায়। সে যায় হোক সংসারিক কাজ রান্না-বান্না, বাজার করা, খায়-দায়, ঘুম, প্রাণ ভোমরের সঙ্গে টেমস নদীতে ঘুরতে যাওয়ার আনন্দ বেশিদিন সহজ থাকলো না, মানে সহজ রাখার উপায় ছিলোনা।

দিন যত যেতে লাগল তত একটা কাজ জোগাড় করে রুজি রোজগারের ব্যবস্থা করতে হবে এই তাড়না দেখা দিল। দিতে তো হবেই, প্রাণ ভোমরা ব্যরিস্টারি পড়তে গিয়েছেন। এ তো রবি বাবু নন যে বাবার টাকা যথেচ্ছ খরচ করে আয়েশি কায়দায় একটা চুরুট টানবেন। আমি তার প্রধান সাহায্যকারী জীবন মরণের সঙ্গী। কাজেই পাশে খুটি হয়ে দাঁড়াতে হবে বৈকি। যদিও সে পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করে।

এখানে বাংলাদেশি ছাত্ররা যারাই এসেছে সবাইকেই কিছু না কিছু করতে হয়। কাজ, পড়া, ক্লাস, টিউশন ফি জোগাড় করা, তারপর বাড়ি ফিরে নিজের রান্না নিজেকেই করতে হয়। এরমধ্যে কত জন ঝরে যায়। সবাই তাল মিলিয়ে না সামলালে অ্যাম্বেসি ভিসা দিবেনা। কতজন পড়া ছেড়ে থিতু হওয়ার জন্য নানা ধান্দা খুজঁতে থাকে। কতজন ইচ্ছাকে বুকের মধ্য জমা করে রাখে একটু গুছিয়ে নিয়ে আবার শুরু করবে। কতজনকে পরাজিত হতে দেখলাম, কতজনকে কচ্ছপের মত দাঁত কামড় দিয়ে লড়াই করতে দেখলাম। তাই বলে দিন শেষে মুখের হাসি মলিন হতোনা কারো। সবাই একসঙ্গে হলে কিছু দিয়ে না হোক অন্তত সাহস দিয়ে, দু একটা সিগারেট হাতে নিয়ে তাসের আড্ডা জমাতো। সেটাই ভুলিয়ে রাখত পিছনে ফেলে আসা আম্মার হাতের গ্লাসে পানি ঢেলে খাওয়ানোর গল্প।

গব বুঝে আমিও দাঁড়লাম শিরদারা সোজা করে। লন্ডনে তখন কাজের বাজার ভীষণ মন্দা। কতজন হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছে। কাজ চাইলেই কি আমার জন্য কেউ নিয়ে বসে আছে? শুরু হল আমার আরেক পথচলা। ভাষা বুঝিনা, বুঝাতে পারিনা, পথঘাট অচেনা, কোন কিছু হাতের কাছে না মানে বাসে, ট্রেনে চড়েই যেতে হবে কাজ পেতে হলে, পথচারীও সাদা কালো শতবর্ণের।
এই সময়টায় আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল টেমস নদী। কাজ খুজঁতে খুজঁতে ক্লান্ত ওয়াটারলুর টিউব মানে পাতাল রেলে চড়ে নদীর ধার। মন খারাপ হলে চোখ জল চেপে চলে যেতাম টেমসের ধারে। নদীতে আর একটু জল ঝরাতে। মজার বিষয় হল টেমসের আলাদা কোনো সৌন্দর্য ছিলনা। ছোট চিকন ডেউহীন দুর্গন্ধময় পানি। দুপাশেই ব্রিজের মত উঁচু দেয়াল দিয়ে বাঁধানো। বসার ভাল বন্দোবস্ত। আর নদীর পাশে যেখানে মানুষ চলাচল করতে পাওে সেখানে নানা রঙের পশরা। কত সমাগম কত বিচিত্র বেশ। দু একটা স্ট্যাচু দেখে আমি মুগ্ধ, রুপালি, সোনালি বর্ণের স্ট্যাচু। ওমা! দেখি সেই স্ট্যাচু হাত বাড়িয়ে হ্যন্ডশেক করতে চায় আমার সঙ্গে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললে ওকে পয়সা দিতে হয়। এটাই নাকি ওর রুজি।

আরেকটি মজার বিষয় হল টেমস নদীর ওপর যে সুন্দও ব্রিজটি আছে যাকে আমরা সাধারণত লন্ডন ব্রিজ বলি তার নাম আসলে টাওয়ার ব্রিজ। যে ব্রিজের নিচ দিয়ে বড় জাহাজ গেলে ব্রিজ দুভাগ হয়ে যায়।
টেমস নদীর পার ধরে ওয়াটার লু টাওয়ার ব্রিজ থেকে বিগ বেন ঘড়ি। বিগ বেনের ঢং ঢং আওয়াজে ঘুমিয়ে পড়া প্রাচীন এই শহরের নিরবতা ভাঙে, আর ব্যস্ত জীবনের কথা মনে করে শহর জেগে ওঠে। তবে এখানকার তিন চার মাইল এলাকা ওয়েস্ট মিনিস্টার পর্যন্ত হেঁটে যাবার জন্য খুবই আরামদায়ক। এই শহওে অনেকগুলো ব্রিজ আছে। আছে লন্ডন আই, যার চরকিতে চড়লে পুরো লন্ডন শহর দেখা যায়। আছে বিশাল অ্যাকুরিয়াম, ভৌতিক জাদুঘর ও সংসদ ভবন যার সবই প্রাচীন চারু-কারুও সৌকর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। কত বিকেল আর কত সন্ধ্যা আমাদেও কেটেছে কফির পেয়ালা নিয়ে সেই লম্বা পথ হাঁটতে-হাঁটতে, জীবনের হিসাব কষতে-কষতে তার ইয়ত্তা নেই। নদীর পার ধরে পথের মাঝে বিচিত্র এক মেলা যা আমাকে আচ্ছন্ন করতো। চোখ মেলে অবাক হয়ে দেখতাম নানা সাজের মানুষ। কতজন রাজা রাণী সাজে, সাজে রুপকথার কোন রাজপুত্র বা দেওদানব অথবা যান্ত্রিক মানব। লোকজন খুশি হয়ে খুচরা পয়সা রেখে যায়। কতজন বিভিন্ন মিউজিক্যাল যন্ত্র নিয়ে গান করছে, কেউ মাইকেল জ্যাকসনের মত নাচছে। কত রকমের খেলার মেলা। পুরোনো বই বিক্রির পশরাও বসে ফুটপাতে। আছে শুরাপানের দোকান। পাশাপাশি রয়েছে মউ মউ গন্ধ ছড়ানো অভিজাত রেস্তোরাঁও। লাইব্রেরি সায়েন্স থেকে এমএ করেছি বলে বইয়ের দোকান দেখলেই চোখ চকচক করত। কি বাহারি দোকান, যেন একেকটা বিশাল লাইব্রেরি। দুরুদুরু বুকে সেখানে ঘুড়ঘুড় করতাম, ইস্ যদি আমাকে এখানে কেউ কাজ দিত!

২০০৯ রেশিসনের সময়। লন্ডনে কাজের ভীষণ আকাল। সামান্য ফাস্টফুডের দোকানেও কাজ পাওয়া যায় না। তার জন্য ব্যাপক আকারের ইন্টারভিউ এর মুখোমুখি হতে হয়। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে দোকানে দোকানে ঢুকে জিজ্ঞ্যেস করতে হয় আমার কাজ দরকার, তোমাদের কি লোক লাগবে? সিভি রেখে এসে বসে থাকতে হয় কবে ডাক আসবে? আমি তো শুধু বেড়াতে যাইনি জীবন যাপন আর লক্ষ্য অর্জনে গিয়েছি। তাই কাজ খুজঁতে খুঁজতে পাতাল রেলে, বাসে করে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে লন্ডন শহরকে চিনতে শুরু করেছি। আর হতাশ হলেই, চোখে জল এলেই টেমসের পার হল আমার সঙ্গী। ছয় মাস লাগল একটা উপযুক্ত কাজ পেতে। যদিও এগুলোকে অড জব বলে তবু তা ছিল যথাযথ নিয়ম মাফিক। মানে ভ্যকেশন, সিক লিভ ইত্যাদি। একটা রিটেল সপে অ্যাসোসিয়েট। তাতেই যে ইন্টারভিউ দিতে হয়েছে তা বোধকরি বিসিএস পরীক্ষাকেও হার মানায়। কোথাকার প্রধানমন্ত্রী কে তা নয় কাস্টমারকে কত অমায়িক ব্যবহার দিতে সক্ষম তার চুলচেরা বিশ্লেষণ।

এই কাজের আগে তিনটি জায়গায় কাজ করার সুযোগ হয়েছিল, এক সিলেটি মালিক যার আড়ং নামে দোকান ছিল, যাকে না দেখলে এত ভাল একজন সিলেটি মানুষ অর্থাৎ শ্রদ্ধেয় বদরুল ভাইকে অদেখা থেকে যেত, এক শিখ পরিবার যাদের জুতোর দোকান ছিল আর মানুষ হিসেবে শিখরা কত ভাল তা অজানা থাকত, আর কোস্টা কফি সপ যেখানে প্রথম স্বচক্ষে ভদ্রমানুষকে অন্যের ব্যাগ থেকে চুরি করতে দেখার প্রথম অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতাম।

প্রশ্ন হতে পাওে, ভ্রমণ কাহিনী বলতে গিয়ে এতসব ব্যক্তিগত গল্প কেন করছি? আসলে জীবনের প্রতিটি সময় আমরা ভ্রমণের ওপরই আছি। জীবন যাপন করতে গিয়ে যে মহাকাল পার হচ্ছি তার সবই এক ভ্রমণ। সে ভ্রমণে যা পাওয়া যায় তাই মহাকালের মহার্ঘ।
চোরের গল্পটি বলি। পথে পথে ঘুরে ঘুরে প্যডিংটন ইস্টিশনের কাছে কোস্টা কফি সপে একটা কাজ জুটলো। কফির তীব্র গন্ধে মন মউ মউ করে। পোড়া পোড়া ঝাঁঝাল গন্ধে মন মেজাজ সতেজ হয়ে যায়। লাতে, ক্যপাচিনো, মোকা, আমেরিকানো, মকাচিনো, এক্সপ্রেসো, ফ্যপাচিনো কত কত নামের কত সাজের কফি। আমার কাজ করতে গিয়ে হরেক রকমের কফি পান করতে হয়না কফির ঘ্রাণ আর বানানোর সৌন্দর্যে এমনিতেই পান হয়ে যায়।

আমার সামনের টেবিলের অল্প দূরে এক মহিলা তার ব্যাগটা চেয়ারের পায়ের কাছে রেখেছেন। পাশের টেবিলের ভদ্রলোক ঐ চেয়ার ঘেঁসে উলটো দিকের চেয়ারে বসেছেন, চেয়ারের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে দিয়েছেন তার কোট। সুযোগ মত হাত বাড়িয়ে মহিলার ব্যাগটা কাছে টেনে নিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিলেন ব্যাগের ভেতর বার করে আনলেন ছোট পার্স। আমি দেখছি চুপচাপ কি হচ্ছে, বুঝে উঠতে সময় লাগল। চোখ আমার ছানাবড়া। কি করবো কি করা উচিত? কুলকিনারা পাচ্ছি না। চিৎকার করে উঠবো চোর চোর বলে নাকি? একে তো গলা দিয়ে ইংরেজি বের হতে চায়না তার ওপর অনেক কষ্টে পাওয়া নতুন কাজ হতে চলেছে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় আর মহিলা নির্বিকার তার সঙ্গীর সাথে গল্পে মশগুল আর চোর ব্যস্ত। চিরাচরিত বাঙালি বৈশিষ্ট্য নিয়ে মন খারাপ করে বাসায় ফিরলাম। কি করা উচিত ছিল আর কি করলাম। মাত্র দু সপ্তাহ কাজ করেছিলাম সেই কফি শপে। কিন্তু এ স্মৃতি আর কোস্টা কফির মোহনীয় গন্ধ আমার মনে থাকবে সারাজীবন।

লেখক : টেক্সাস (যুক্তরাষ্ট্র) প্রবাসী
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status