চলতে ফিরতে

চীন চলে হিকমতে

কাজল ঘোষ, চীন থেকে ফিরে

৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ১:০১ পূর্বাহ্ন

কুনমিং চেংশুই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাই চীনা সময় সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায়। দিনটি ১২ই সেপ্টেম্বর। আর কুনমিংকে বিদায় জানিয়েছি ২৫শে সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় দুপুর সোয়া দুইটায়। এ সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত ছুটেছি জানার পেছনে। বাংলাদেশ-চীন ইয়ুথ সামার ক্যাম্প-২০১৭ সফল আয়োজনে ঢাকা থেকে মিংডি লাওশি, লিও লাওশি, তাই লাওশি, মিশকাত শরীফ যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন। কুনমিং-এ তারাই দু’সপ্তাহ ছায়ার মতো আমাদের আগলে রেখেছেন। আমাদের বলছি এ কারণে, মোট চারটি দল পৃথক ভাবে এতে অংশ নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কনফুশিয়াস ইনস্টিটিউট, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাম্বেসি গ্রুপ, শান্ত মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়। গড়ে দেড়শ’ শিক্ষার্থী চীনকে জানতে ক্যাম্পে অংশ নিয়েছে। আমি ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রুপে। গ্রুপের ৪৫ জন সব সময় এক সঙ্গে সকল কার্যক্রমে অংশ নিয়েছি। তা কুংফু ফ্যান, তাইচি, ক্যালিগ্রাফি, বোটিং, ক্যাবল কারে চাংশান মাউন্টেন দেখা, থ্রি প্যাগোডা, ন্যাশনালিটি ভিলেজ, স্টোন ফরেস্ট, ইরইউয়ান লেক, ইউনানের পুরনো রাজধানী শহর ত্বালি, ওয়ালমার্টে শপিং, বাই মেডিসিন ফ্যাক্টরি পরিদর্শন সবই এখন স্মৃতির অংশ।
চীনে দেখেছি সবকিছুতেই তারা একটি দর্শন দেখে। এ যেন আপাদমস্তক দর্শনের দেশ। ছোট থেকে বড় সব কিছুর পেছনেই রয়েছে এক ধরনের দর্শন। প্রথম দিনই সকালে খাবার টেবিলে চপস্টিক হাতে নিই। এর পেছনের গল্প হচ্ছে চীনারা গরম খাবার খেতে পছন্দ করে। তাছাড়া, হাত ময়লা থাকতে পারে। সুতরাং কি করা; হাতের সঙ্গে খাবারের যোগসূত্র কমাও। দুটো করে স্টিক দিয়ে খাওয়া শুরু। চীনের বাচ্চাদের বয়স যখন এক বছর তখন থেকেই তারা চপস্টিকে অভ্যস্ত হতে শুরু করে। চীনে কোনো খাবার টেবিলে পানি দেখিনি। কারণ, তারা খাবারের সঙ্গে পানি খায় না। এমনিতেই চীনারা খুব একটা পানি খায় না। কারণ সকলের হাতেই থাকে গ্রিন টি বা লুই চায়ের ফ্ল্যাক্স। যখনই মনে হয় ফ্ল্যাক্স খুলে গলা ভেজাও। খাবারের সঙ্গে পানি না খাওয়ার একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হচ্ছে এতে পেটে গ্যাস হয় না। আর পাকস্থলি খাবার হজম করতে পারে সহজেই। চা আর চীন যেন সমার্থক। আরেকটি বিষয় হচ্ছে ছাতা। লুই চায়ের ফ্ল্যাক্স আর ছাতা সব স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে ছিল কমন। পথ চলতে চলতে দেখতাম এরা ছাতা খুলে ধরে থাকতো। স্বেচ্ছাসেবী অ্যানজেলকে দেখেছি ছায়ার মধ্যেও ছাতা মাথায়। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম ছায়ায় ছাতা রহস্য কি? সে বললো, ছায়ার মধ্যেও রোদের রশ্মি শরীরে এসে ত্বকের ক্ষতি করে। বাব্বা এতো সচেতন। যা হোক চীন থেকে আমিও ছাতাকে সঙ্গী করেছি। আর চা-কে নানা দার্শনিক মিথের পর্যায়ে নিয়ে গেছে চীনারা। থ্রি কোর্স টি সেই দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাই পিপলদের থ্রি কোর্স টি দুনিয়াজুড়ে খ্যাত। জীবনের তিক্ততা, মধুরতা আর অম্লমধুরতা এই তিন মিলেই জীবন। থ্রি কোর্স টি তাই। প্রথম কাপে তিক্ততা, তারপর মিষ্টি আর সবশেষে তিতা-মিষ্টি মিশ্রিত চা। এই চা যুবকদের বেশি খেতে দেয়া হয় জীবনে চলার অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই সেই রহস্যকে জানতে। বেশির ভাগ চীনারা ধার্মিক নন। মানে তারা ধর্ম মানেন না। কিন্তু তারা সময় মানার ক্ষেত্রে একাট্টা। তাদের কাছে বন্ধুত্ব মানে বিশ্বাস-আস্থা। কর্মই তাদের কাছে ধর্ম। জীবন দিয়ে হলেও দায়িত্ব পালনে তারা ন্যায়নিষ্ঠ। তার কিছু কিছু প্রমাণও পেয়েছি পথ চলতে গিয়ে। স্টোন ফরেস্ট যাওয়ার দিন আমাদের গাড়ি ছাড়ার সময় ছিল সাড়ে সাতটা। গাড়ি তৈরি ছিল ঠিক সময়ানুযায়ী। কিন্তু আমাদের গাড়িতে তিন বন্ধু পাঁচ মিনিট দেরি করায় গাড়ি ছেড়ে যায়। যদিও পরে তাদের ভিন্ন গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে স্টোন ফরেস্টে। কিন্তু সময় বলে কথা। আমরা বিরক্ত হয়েছিলাম পাঁচ মিনিটের জন্য তিন বন্ধুকে ফেলে যাওয়ায়। কিন্তু আমাদের বলা হলো- ‘টাইম ইজ মানি, মানি ইজ টাইম।’ পরবর্তী কোনো সময় আর কাউকে সময় নিয়ে তাড়া দিতে হয়নি। বিশেষ করে ত্বালি যাওয়া-আসার পথে তাই দেখেছি। যদিও চাংশান মাউন্টেনে ক্যাবল কারে বেড়াতে গিয়ে আমাদের আসিফ আর দেবাশীষের জন্য দুশ্চিন্তা হয়েছিল।


তারা একটি ভুল পথে পা বাড়িয়েছিল। পথ হারাতে বসেছিল। অবশ্য লিও লাওশি সময় মতো বিষয়টি বুঝতে পেরে সাবধান হওয়ায় কোনো সমস্যা হয়নি। একটু বেশি সময় লেগেছিল এই যা। এই ভ্রমণে সহযাত্রী রাগীব, পুষ্পিতা আর ঊর্মি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মধ্যরাতেও যেভাবে রাগীব আর পুষ্পিতাকে লিও লাওশি অ্যাম্বুলেন্স আনিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন তাতে আমরা বিস্মিত হয়েছি। মধ্যরাত পর্যন্ত তিনি ঘুমাতে যাননি। কারণ, এটা তার দায়িত্ব। ঊর্মিকে নিজ টাকায় ট্যাক্সি ভাড়া করে সোফিয়া যেভাবে ডার্মাটোলজিস্টের কাছে নিয়ে গেছে আমরা অনেকেই সেই উদারতা দেখাতাম কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এখনো প্রতিদিন প্রতিবেদন লেখার জন্য যেভাবে স্বেচ্ছাসেবকরা এগিয়ে এসেছেন তাতে আমার বিস্ময়ের মাত্রা বেড়েছে বহুগুণ। আমি ঢাকায়। কিন্তু কুনমিং থেকে প্রতিদিনই ছবি পাঠিয়ে, তথ্য দিয়ে যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন মিশকাত শরীফ, সোফিয়া, রিন্ডা, অ্যাঞ্জেল, গোয়েনসহ আরো অনেকে তাদের কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা আমার জানা নেই। এই সহিষ্ণুতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা যেন আমরাও তাদের উপহার দিতে পারি-প্রার্থনা এটাই। চিরবসন্তের দেশ ইউনান। ইউনানের বাংলা অর্থ হচ্ছে দক্ষিণের মেঘ। শুধু দক্ষিণ কেন? এ যেন সবখানের মেঘ। চারপাশ প্রকৃতি সাজিয়েছে অনিন্দকান্তি সৌন্দর্য্য দিয়ে। কখনো কুনমিং-এ ঘাম নেই। ধুলো নেই। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ময়লা পরিষ্কার করে করপোরেশন। চারপাশে ফুলের বাগান। ছিমছাম। ছবির মতো শহর। সকালটা যেমন সুন্দর, বিকাল-সন্ধ্যা আর রাত যেন আরো সুন্দর। চৌদ্দ দিনে একটি গাড়ির হর্ন শুনিনি। গাড়িচালক আমাদের নিয়ম শিখিয়েছেন। নিয়মের বাইরে কোনো কথা নেই। চীনাদের খাবার সময়ও আমাদের চেয়ে ব্যতিক্রম। সকালে নাস্তা আটটার মধ্যে। দুপুরের খাবার ১২টার মধ্যে। ডিনার সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে শেষ। এর কোনো ব্যত্যয় হবে না। আমাদের পাকস্থলীও এই নিয়মে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। আর ডিনার শেষে চীনাদের চলে হাঁটাহাঁটি। খাবার হজম করে তারপর ঘুমাতে যাওয়া। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনার বাইরে ক্যাম্পাসে কোনো আড্ডা বা জটলা দিতে দেখিনি। বরং আমাদের আড্ডার জটলা দেখে ওরা অবাক হয়েছে। বাঙালিরা বা মান চিয়ালা পিপল (বাংলাদেশের মানুষ) বোধ হয় এমনি! চীনারা সাইকেলে ছুটছে। শহরের চারপাশে       সাইকেল আপনার অপেক্ষায়। হাতে উইচাট অ্যাকাউন্ট আপনাকে সহজেই সাইকেল পেতে সাহায্য করবে। যখন খুশি যেখানে চলে যান। পুরো চীনই এখন শেয়ারিং ফরমুলায় সাইকেল ব্যবহার করছে। এতে অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে, পরিবেশ রক্ষা হচ্ছে আর গাড়ি অযথাই রাস্তায় থেকে যানজট বাড়াচ্ছে না। আমাদের বেশির ভাগ সময় কেটেছে ইউনান ইউনিভার্সিটিতে। এখনো চোখ বন্ধ করলে সেই ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য্য আমাকে তাড়িত করে। এতোটাই পরিচ্ছন্ন আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঘেরা। চীনে সাজসজ্জার জন্য গাছ লাগিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয় না। ট্রাকে করে পাহাড় থেকে বড় বড় গাছ তুলে এনে রোপণ করা হয় নির্ধারিত স্থানে। চলার পথে অনেক স্থানেই এভাবে গাছ লাগিয়ে স্যালাইন দিতে দেখেছি। আর এ পদ্ধতিতে খুব সহজেই যেকোনো স্থানকে গাছপালা দিয়ে পূর্ণ করা যায়। ফুলগাছের ক্ষেত্রে দেখেছি রঙের বাহার। যদি লাল রঙের হয় তাহলে অনেক দূর পর্যন্ত একই রঙ, আবার হলুদ হলে একই রঙের অনেক দূর। এভাবে লাল-নীল-হলুদ-সাদা। চীনের সোশ্যাল মিডিয়া বলতে উইচাট। সে যেন পুরো পৃথিবী ঢুকিয়ে দিয়েছে উইচাটে। সব করা যায় উইচাটে। এর তালিকা দেয়ার প্রয়োজন নেই। তবু বলি, উইচাট অ্যাকাউন্টে আপনি এক লাখ আরএমবি খরচ করতে পারবেন ব্যাংকের ঝুট-ঝামেলা ছাড়াই। ওয়াশিং মেশিনে কাপড় দিয়ে রুমে এলে উইচাট জানিয়ে দেবে আপনার কাপড় তৈরি হয়েছে কিনা? বিশেষ দিনে উইচাট আপনাকে পৌঁছে দেবে হংপাও অর্থাৎ উপহারের খামও।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ড্রাগন ড্যান্স দেখেছি। প্রচলিত আছে ড্রাগন ক্ষতিকর। মুখ দিয়ে আগুন বের হয়। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয় সব কিছু। না চীনে তা নয়। চীনের ড্রাগন শান্ত। সে মুখ দিয়ে শান্তির বারি নিক্ষেপ করে। সে বাস করে জলে। সে তাদের খরায় স্বস্তি এনে দেয়। চীনারা ড্রাগনকে পুজো দেয়। শ্রদ্ধা করে। সাহস পেতে আশ্রয় নেয় ড্রাগনের কাছে। চাইনিজ নটের অর্থও ভিন্ন। এটা তাদের শুভ কামনার প্রতীক। পাঁচটি শুভ ইচ্ছে আছে চাইনিজ নটে। ঐধঢ়ঢ়ুহবংং, অঁংঢ়রপরড়ঁংহবংং, খঁপশ, ঝড়ষরফধৎরঃু ্‌ ঝধভবঃু।
কুনমিং পৌঁছাবার দুদিনের মাথায় জেনে গেলাম বেশকিছু চাইনিজ জনপ্রিয় শব্দ এবং প্রতীক। ওদের ভাষায় চড়ঢ়ঁষধৎ ড়িৎফং ্‌ ষপড়হং। সুন ওয়ান ওয়ে ও চাং থিং আমাদের শেখালেন। দু’হাত দিয়ে হার্ট এঁকে বললেন- এটা আমাদের এখানে কি? আমরা হৃদয় জানি বলতেই ওরা বললো- চীনে এই সাইনকে বলা হয় ভালোবাসি। কাজেই দূর থেকে বা কাছে এসে বা মুঠোফোনে সবাই সবাইকে চাইনিজরা পিসিং জানায়। আমাদের এখানে ফ্লাইং কিস বা উড়ন্ত চুমু বিনিময় হয় সাধারণ প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে। কিন্তু চীনে এর অর্থ একটু ভিন্ন। হাত দিয়ে সবার উদ্দেশে চীনারা এই ফ্লাইং কিস দিয়ে থাকে। একে বলে মমতা। কাজেই চীনে থাকার সময় আমরাও বেশ কিছুদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মমতা বিলানোর সুযোগ পেয়েছি। মঞ্চে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠানের শেষে বা শুরুতে শিল্পীরা দর্শকদের উদ্দেশে এই মমতা ছড়িয়ে দেন। চিয়ার্স বা নাইস অর্থে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি আর নিকটতম তর্জনি দিয়ে তুরির মতো প্রদর্শন করে থাকে- এটাকে বলা হয় কেইলি। যেকোনো উৎসবময়তা বা আনন্দঘন মুহূর্তের জন্য পাঁচটি ইংরেজি ৬৬৬৬৬ অর্থাৎ আওয়াজ করে লু লু লু লু লু বলে থাকে চীনারা। এটা বৃদ্ধাঙ্গুলি আর কনিষ্ঠা একসঙ্গে প্রদর্শন করে লুলুলু বলে।
চীনের সবকিছুর কোনো না কোনো অর্থ রয়েছে। বাড়িঘরের দেয়ালে যে চিত্র আঁকা থাকে তা ঐ পরিবারের ইতিহাসকে বর্ণনা করে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সেই চিত্র দিয়ে বুঝে থাকে তাদের পথচলা। চীনে খাবারে ভেজাল এ বিষয়টি বোধহয় তারা অবগত নয়। ফলে কখনো ফরমালিন বা কার্বাইট দিতে হয় এ শিক্ষা তাদের নেই। আর যেকোনো খাবার তাই নিশ্চিন্তে গলাধঃকরণ করেছি। বিশেষত সিজার নামে একটি ফলের কথা ভুলতে পারছি না। ইউনিভার্সিটির উইতং ক্যাফেতে লাঞ্চ বা ডিনার শেষে ছুটতাম অপজিটের সুপার শপে। সেখানে গিয়ে আধা কেজি সিজার চার আরএমবিতে কিনে গপাগপ গিলতাম। সিজার দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের টমেটো বা ভুটানে খাওয়া প্লামের মতো। কিন্তু এর স্বাদ আর মিষ্টি সত্যিই অন্যরকম। চীনে লেখার জন্য জেল পেন খুব জনপ্রিয়। সেখানে আমাদের শিষ বা বলপেনের একেবারেই কাটতি নেই। কারণ তাদের হানজি লিখতে হয় জেল পেন দিয়ে। তারা সবকিছুতেই একটি ছবি দেখতে পায় ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে তার বড় উদাহরণ। তাদের সকল অনুষ্ঠানাদিতে ক্যালিগ্রাফি থাকবেই। এমনকি রেষ্টুরেন্ট বা সুপারশপ এলাকাতেও। অবসর বা একান্তে অথবা সেরিমনিয়াল হিসেবেও সকলেই ক্যালিগ্রাফি করে থাকে।
সেখানকার সবকিছুর জন্যই মূল্য পরিশোধ করতে হয়। পথেঘাটে বা বিভিন্ন সুপার শপের খোলা এলাকায় বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তা ডিজিটাল। পানিকে চীনে বলে শুয়ে। আর এই পানি খাওয়ার জন্য রয়েছে কার্ড যা শুয়ে কার্ড নামে পরিচিত। চীনের মানুষের রয়েছে সংগীতের প্রতি ভীষণ ভালোলাগা। পথ-ঘাট-পার্কে সবসময় ক্ল্যাসিক্যাল বাজতে শুনেছি। এমনকি আমরা ইউনিভার্সিটির বাগান এলাকায় বা পথ দিয়ে চলার পথে বিভিন্ন স্থানে সাউন্ড বক্সের মাধ্যমে আসা টুংটুং ধ্বনি শুনতে পেতাম। তাছাড়া দুপুরে খাবার সময় ক্যাফেতে প্রবেশ পথেই বড় ডিজিটাল স্ক্রিনে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান চালাতে দেখেছি। তাছাড়া, খাবার বিরতির সময় শ্রেণিকক্ষে বা পাঠাগারে গান বেজে ওঠে। এটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য এখন খাবার সময়। চলার পথে রাস্তায় বা বাড়িঘরের দেয়ালে কোনো পোস্টার-ব্যানার দেখিনি। চিকা মারাতো দূরের কথা। ত্বালি যাওয়ার পথে গাড়ি টানেলে ঢুকতেই এক সহযাত্রী সকলের উদ্দেশে একটি কুইজ জিজ্ঞাসা করলো- বলো তো বাংলাদেশ হলে টানেলে কি দেখতাম? সবাই ইতিওতি করছে। ও নিজেই তখন বললো, টানেলের দেয়ালে থাকতো চিকা মারা। ‘অমুক ভাইয়ের শুভেচ্ছা নিন, অমুক ভাইকে ভোট দিন।’ চীনে তোরা এটা দেখা থেকে বঞ্চিত হলি। চীনে গাড়ি চলে সবসময় বাঁদিকের হিসেবে। অর্থাৎ লেফটহ্যান্ড ড্রাইভ। এক্সপ্রেসওয়েতে চলার সময় বাসেও সিটবেল্ট বাঁধতে হয়েছে। কুনমিং-ত্বালিতে একটি বিষয় দেখেছি বয়সীরা রাস্তা বা শপিং মলে খুব একটা ছুটোছুটি করে না। তবে তারা একটি নির্দিষ্ট সময় পার্কে মিউজিকের তালে তালে তাই চি চর্চা করে। নীরোগ এবং সুস্থ থাকার জন্য দিনভর চলে এই তাই চি। আর অবসর ভাতা তাদের চলার সম্বল। চীন নিয়ে অনেক কথা যা এক লেখায় শেষ করা যাবে না। চীন অনেক বড় দেশ। এক দেখায় শেষ করা সম্ভব নয়। বারবার যেতে হবে চীনকে জানতে। শেষ করতে চাই চীনের মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের দুটি ঘটনার উল্লেখ করে। রাত ৯টায় ক্লাস চলছে মাধ্যমিক স্কুলে। কারণ সামনেই কাউখাউ পরীক্ষা। ভালো করতে হবে। ক্লাস শেষে একদল ছেলেমেয়ে ছুটে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু আরেক দল ব্যস্ত ক্লাসরুম পরিষ্কার করায়। এটাই তাদের নিয়ম। ভাগ ভাগ করে শ্রেণিকক্ষ বা ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্ন করতে হয় শিক্ষার্থীদের। এমনকি স্কুলের টয়লেট পর্যন্ত পরিষ্কার করতে হয় তাদেরকেই। আমাদের এখানে কোনো শিক্ষার্থী টয়লেট পরিষ্কার করছে জানলে অভিভাবকরা স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কি আচরণ করবেন- তা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি আমরা। কিন্তু জীবন গড়তে হলেই সবরকম শিক্ষাই দরকার তা ভুলতে বসেছি আমরা।
সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নাম লেখাতে হয় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। চার ক্যাটাগরির মধ্যে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কোনো না কোনো কাজে অংশ নিতে হয় স্বেচ্ছায়। বৃদ্ধদের সহায়তায়, শিশুদের পড়ানো, শিশুদের প্রেরণামূলক কাজ শেখানো আর দেশের দুর্যোগে স্বেচ্ছায় আত্মনিয়োগ। যুবকরা তাদের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের এভাবেই ব্যস্ত রাখে সমাজ গঠনে।
পাঁচ বছরের হুয়াং উয়েহং পড়ছে ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে। বিষয়টি চোখে পড়ার মতো। অবাক বিস্ময়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তোমার স্বপ্ন কি? বড় হয়ে কি হতে চাও? ইংরেজিতে হুয়ার উয়েহং বলেছিল, ইৎরহম ঢ়বধপব রহ ঃযব বধৎঃয, যবষঢ় ড়ঃযবৎং। চীনা নেতৃত্বের কানে এই বক্তব্য পৌঁছাবে কিনা জানি না। তবে চীনের তরুণ প্রজন্ম যদি শান্তির পথে চলে তা এই বিশ্বকে আরো অনেক বেশি বাসযোগ্য করে গড়ে তুলবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইয়ুথ সামার ক্যাম্প-২০১৭ দিয়েছে অনেক অভিজ্ঞতা। একটি পুরনো সভ্যতাকে জানার অসাধারণ সুযোগ। পরিশেষে বলতে চাই, চীন চলে হিকমতে আর বাঙালি চলে হুজুগে। তবে আমাদের পথচলা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করতে পারলে আমরাও এগিয়ে যাবো উন্নতির শিখরে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status