ঢাকা, ৯ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

নির্বাচন যেন নির্বাসন না হয়

তারাপদ আচার্য্য
১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার
mzamin

গণতান্ত্রিক দেশে নিরপেক্ষভাবে ভোট দেয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অপরাধ নয় অধিকার। তবু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটের আগে ও পরে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এই দায় কোনো রাজনৈতিক দল এড়িয়ে যেতে পারে না, এড়িয়ে যেতে পারে না রাষ্ট্র তথা নির্বাচনকালীন সরকারও। বিবেকবান নাগরিক সমাজেরও করণীয় আছে। নির্বাচন কমিশনের তো এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করার কথা। কারণ রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের ভয়-ভীতিহীনভাবে ভোট প্রদানের পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনেরই। পরিশেষে রাষ্ট্র, দল, ব্যক্তির কাছে বিনীত নিবেদন, আসন্ন ’২৪ সালের নির্বাচন যেন সংখ্যালঘুদের নির্বাসন না হয়

আমার জন্ম বাংলাদেশে। আমি জন্মসূত্রে বাংলাদেশি। ধর্মসূত্রে আমি হিন্দু। আমার বাবা-ঠাকুরদাদা জন্মেছে এই দেশে।

বিজ্ঞাপন
আমার মা-স্ত্রী বাংলাদেশি। সন্তানরাও জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। আমি ছোটবেলা থেকে বড়বেলায় পৌঁছেছি। আমার চারপাশের পরিবেশ হাতের তালুর মতো চেনা। চেনা ঘর, চেনা বারান্দা, চেনা পথ, চেনা উঠোন, চেনা তুলসিতলা, চেনা পুকুর ঘাট, চেনা সবুজ ফসলের মাঠ, চেনা বাজার, চেনা হাট। আমার চারপাশের লোকজনদের আচার-আচরণ মুখস্থ। চলতি পথে বড়দের দেখলে আমি সম্মান জানাই। ছোটদের কুশল জিজ্ঞাসা করি। পারিবারিক সুখ-দুঃখের খবরাখবর নেই। কোনো বিশেষ উৎসব-আনন্দে ওদের নিমন্ত্রণ করে মুড়কি-মোয়া-নাড়ু খাওয়াই। জাত-পাতের হিসাবনিকাশ আমার কাছে কোনো কালেই ছিল না, আজও নেই। আমি সম্প্রীতি ভালোবাসি। মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করি। কে হিন্দু, কে মুসলাম, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান সেটা আমার কাছে বড় কথা নয়। আমি রাজনীতি বা ধর্মের বিবেচনায় মানুষকে ভাগ করি না। আমার কাছে মুচি-মেথর, রিকশাওয়ালা-দোকানদার সবাই সমান। তাদের আমি সম্মান করি, অন্তর দিয়ে ভালোবাসি। 

কখনো কখনো আমার এই চেনা পৃথিবীটা অচেনা হয়ে যায়। মানুষের মুখগুলো মুখোশ পরা মনে হয়। ওদের আচার-আচরণও অচেনা হয়ে যায়। রাজনীতি আর ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় ওদের মন-মানসিকতা। স্বার্থের কারণে ওরা হয়ে ওঠে হিংস্র। সম্মানীদের অসম্মান করতে বিবেকে বাধে না। গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করে না। পরিবারের বয়সী মেয়েদের সঙ্গে অশালীন আচরণ, এমনকি খুন-খারাবির পর্যায়েও চলে যায় সেই হিংস্রতার স্রোত। 

আমি রাজা-মন্ত্রীদের নির্বাচনের কথা বলছি। আমি আসন্ন ’২৪-এর নির্বাচনের কথা বলছি। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘুদের দুর্দশার কথা বলছি। নির্বাচনকে ঘিরে সংখ্যালঘুদের ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে যায় তা শুধু তারাই অনুভব করতে পারে। 
‘কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।’
একজনের বিষের যাতনা অন্যজন বুঝতে পারে না। অতীতে প্রতিটা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ বিষের জ্বালা সহ্য করতে হয়েছে সংখ্যালঘুদের। আগুন দিয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, মেয়েদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, পুরুষদের মারধর করা হয়েছে, বাড়িঘর লুটপাট করা হয়েছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সংখ্যালঘুরা। প্রশাসনিক নিরাপত্তার বলয়ে জানমাল রক্ষার চেষ্টা চলে। প্রশাসন কঠোর থেকে কঠোরতর হয়। তারপরও কঠোরতর নিরাপত্তার বেষ্টনী ভেদ করে অতীতে অনেকবার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। সহায়-সম্বল আর আপনজনের বিয়োগ ব্যথার ক্ষতে কেউ এগিয়ে আসেনি উপশমের মলম দিতে, কেউ শোনায়নি অভয় বাণী, কেউ দেয়নি সান্ত্বনা।

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- সংখ্যালঘু নির্যাতনের অধিকাংশ ঘটনাই ঘটেছে নির্বাচনকালে, কিংবা তার আগে নয়তো পরে। ২০০১ সালে সিরাজগঞ্জে, ভোলায় এবং অন্যান্য স্থানে আক্রমণ ও নির্যাতনের ঘটনায় নাগরিক সমাজ সোচ্চার হলেও নির্যাতনের শিকার পূর্ণিমা-সীমাদের ধর্ষণ পরবর্তী আহাজারি প্রশাসন বা রাজনৈতিক মহলের কেউই শুনতে পায়নি, শোনার প্রয়োজনও মনে করেনি বলে আমার মনে হয়।

২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন পরবর্তী হামলার ঘটনাও সংখ্যালঘুদের জন্য আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছিল। নির্বাচনের দিন রাতে যশোরের অভয়নগরে হিন্দুদের ওপর হামলা হয়। পরদিন ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, লালমনিরহাট, বগুড়া, চট্টগ্রামসহ নানা জায়গায় হিন্দু ও অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার খবর পাওয়া যায়। তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অবাধে লুটপাট করা হয়, বসত-বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার হুমকি দেয়া হয়। ওইসব বাড়ির নারী-পুরুষ-শিশুরা শিকার হয় নির্মম নির্যাতনের। 

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে পরবর্তী গত নয় বছরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর সাড়ে তিন হাজারের বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে।

মানুষ প্রথম তার জীবনের নিরাপত্তা খোঁজে। যখন কোনো দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তখনই মানুষ নির্বাসনে যায়। অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত দেশের হিন্দু জনসংখ্যার হিসাব দেখলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৭৪ সালে হিন্দু ১৩ দশমিক ৫ থেকে ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক নয় পাঁচ শতাংশে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাতের ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক এক গবেষণা তথ্যে দেখা গেছে, ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫ দশকে মোট ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ দেশত্যাগ করেছেন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ নিরুদ্দিষ্ট বা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আর প্রতিদিন দেশ ছেড়েছেন গড়ে ৬৩২ জন হিন্দু। অধ্যাপক বারকাতের এই গবেষণা তথ্য বিবেকবান মানুষদের বিচলিত করে তোলে। হিন্দুদের বিচলিত করে নির্বাচনের আগে ও পরের সহিংসতার শিকার হয়ে নির্বাসনে যাওয়ার আতঙ্ক।

গণতন্ত্রের বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে যাবে। এ ভোটাধিকার তার গণতান্ত্রিক অধিকার। অনেক সময় সংখ্যালঘুদের কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের হুমকি-ধামকিতে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারে না। আবার ভোট দিতে গেলেও হিন্দুদের নির্দিষ্ট একটি দলের ভোটার বলে মনে করা হয়। যখন ওই দল পরাজিত হয় তখনই হিন্দুদের ওপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন। আবার জয়ী হলেও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। সম্প্রতি নির্বাচনের আগে ও পরে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ আট দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত।

গণতান্ত্রিক দেশে নিরপেক্ষভাবে ভোট দেয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অপরাধ নয় অধিকার। তবু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটের আগে ও পরে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এই দায় কোনো রাজনৈতিক দল এড়িয়ে যেতে পারে না, এড়িয়ে যেতে পারে না রাষ্ট্র তথা নির্বাচনকালীন সরকারও। বিবেকবান নাগরিক সমাজেরও করণীয় আছে। নির্বাচন কমিশনের তো এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করার কথা। কারণ রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের ভয়-ভীতিহীনভাবে ভোট প্রদানের পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনেরই। পরিশেষে রাষ্ট্র, দল, ব্যক্তির কাছে বিনীত নিবেদন, আসন্ন ’২৪ সালের নির্বাচন যেন সংখ্যালঘুদের নির্বাসন না হয়।

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status