ঢাকা, ৯ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

কৃষি শিক্ষার বাতিঘর সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রফেসর ডা. মো. জামাল উদ্দিন ভূঞা

(৫ মাস আগে) ২১ নভেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:৫৯ অপরাহ্ন

mzamin

গৌরবের ১৭ বছর পেরিয়ে ১৮ বছরে পা দিয়েছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (সিকৃবি)। বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব কোণে অবস্থিত হাওর, সমতলভূমি ও টিলাবেষ্টিত সিলেট বিভাগে কৃষি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। শুরুতে তিনটি অনুষদ নিয়ে যাত্রা করলেও পর্যায়ক্রমে সাতটি অনুষদ চালু হয়। এসব অনুষদের মাধ্যমে কৃষিবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রসরমাণ বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা ও সমতা অর্জন এবং জাতীয় পর্যায়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি ও গবেষণা কার্য পরিচালনা করা হয়।

সিলেট বিভাগীয় শহরে টিলাবেষ্টিত ৫০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদীয় ভবন, প্রশাসনিক ভবন ও আবাসিক ভবন ছাড়াও রয়েছে  কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়াম। তামাবিল বাইপাস রাস্তার উত্তরপাশের্^ ১২ দশমিক ২৯ একর ভূমি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস ও গবেষণা মাঠ গড়ে তোলা হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ৭টি অনুষদ, ৪৭টি বিভাগ, মাঠ গবেষণা কেন্দ্রসহ উন্নতমানের গবেষণাগার। এছাড়া রয়েছে একটি ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতাল।

ভাষাশহিদ ও স্বাধীনতার বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ এ ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার যা বাংলাদেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন শহিদ মিনারগুলোর অন্যতম, যার নামকরণ করা হয়েছে ‘সূর্যালোকে বর্ণমালা’। এছাড়া রয়েছে পাঁচটি ছাত্র হল ও দু’টি ছাত্রী হল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় চলছে গবেষণা কার্যক্রম, যার স্বীকৃতিস্বরূপ বৈশ্বিক মহামারির (কোভিড-১৯) সময়েও আন্তর্জাতিক স্কুপাস ইনডেক্সড জার্নালে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের একশ’র বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনায় হাওরে জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছেন এখানকার গবেষকরা। বোরো ফসলনির্ভর হাওরাঞ্চলে একসময় শীতকালেও মাঠের পর মাঠ পতিত থাকতো।

বিজ্ঞাপন
সুনামগঞ্জের হাওরসহ বিভিন্ন হাওরের প্রান্তিক কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে সিকৃবি নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। চলছে মসলাজাতীয় ফসল নিয়ে নিবিড় গবেষণা। সিকৃবি উদ্ভাবিত প্রোটিনসমৃদ্ধ ‘সিকৃবি শিম-১’ ও ‘সিকৃবি শিম-২’ জাত দু’টি সিলেট অঞ্চলে বছরব্যাপী প্রোটিনের চাহিদা  মেটাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

সিলেট অঞ্চলের কৃষি আবহাওয়া-সম্পর্কিত তথ্য জানার জন্য স্থাপন করা হয়েছে অটোমেটেড অ্যাগ্রোমেটিওরোলজিক্যাল স্টেশন। কৃষিক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও গবেষণা করে চমক দেখিয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এজন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।

২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম (সাউরেস) এর মাধ্যমে ইতিমধ্যে ৫২২টি গবেষণা প্রকল্প সফলতার সাথে সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১৮৭টি গবেষণা প্রকল্প চলমান রয়েছে। গবেষণা কাজে সহযোগিতার জন্য ৪১টি বিভাগে ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত গবেষণাগার স্থাপন করা হয়েছে।

গবেষণা কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণা তথ্যাদি আদান-প্রদানের লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সিকৃবির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত অন্যতম প্রতিষ্ঠানসমূহ হল জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজি টুবিগেন-এর সমন্বিত বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান বিভাগ, আন্তর্জাতিক কৃষি ও বিজ্ঞান শিক্ষার অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ জাপানের  কোবে বিশ্ববিদ্যালয়, নরওয়ের ওসলো ইন্টারন্যাশনাল রোটারি ক্লাব, পশ্চিমবঙ্গের দ্যা নিউটিয়া ইউনিভার্সিটি, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিএসআইআর, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।

স্পেনভিত্তিক সিমাগো ইনস্টিটিউশন র‌্যাঙ্কিং এর ওয়েবসাইটে সম্প্রতি প্রকাশিত র‌্যাংকিং অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪১টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উদ্ভাবনী পদমর্যাদায় দেশে ১নং স্থান অর্জন করেছে সিকৃবি। এছাড়াও দেশের জলজ বিজ্ঞান বিষয়ক ১১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২৩ সালে সারা বিশ্বের মোট ৮৪৩৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিক্ষা, গবেষণা, সামাজিক, সামাজিকতা, স্বাস্থ্য, উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয় যাচাই করে এই র‌্যাঙ্কিং নির্ধারণ করা হয়েছে। সামগ্রিক র‌্যাঙ্কিং-এ সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে রয়েছে ৫ নম্বর অবস্থানে।

দেশের উত্তর-পূর্ব কোণে প্রতিষ্ঠিত সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে যোগদান করার পরপরই শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ কাজে জোর দেয়ার পাশাপাশি প্রশাসনিক কাজে বিরাজমান সমস্যা দূর করে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রম সূচারুরূপে পরিচালনা, শিক্ষা বিভাগের সমস্যা এবং শ্রেণিকক্ষের দুরবস্থা দূরীকরণসহ শিক্ষা উন্নয়নে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে বিশ্ববিদ্যালয় একদিনের জন্যও অনির্ধারিতভাবে বন্ধ থাকেনি। সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী শিক্ষাদান পদ্ধতির অন্তরায়গুলি চিহ্নিত করে দূর করার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে একবিংশ শতাব্দীর চাহিদা মোতাবেক সিলেবাস কারিকুলাম ঢেলে সাজানো হয়েছে। গতানুগতিক একাডেমিক নিয়মকানুনের পরিমার্জন করে শিক্ষা পদ্ধতিতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে; গবেষণাক্ষেত্রে যোগ করা হয়েছে নতুন মাত্রা। এক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদেরকে গবেষণায় পারদর্শী করে গড়ে তুলতে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার তৈরির পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে শিক্ষালব্ধ জ্ঞান সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে মাঠ গবেষণায় গুরুত্ব প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক সকল বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারনেট সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষকদের ন্যায্য পাওনা ও পদোন্নতি নিশ্চিত করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়া কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পর্যায়োন্নয়নসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার পরিবেশ বজায় রাখার পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ক্রীড়া, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সমভাবে পারদর্শী করে গড়ে তুলতে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যায়-নীতি, স্বচ্ছতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধান সমুন্নত করতে কাজ করে যাচ্ছি।

বিভিন্ন প্রতিকূলতা ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা কৃষিসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিভিন্ন দিকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছি। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন রূপকল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে এই বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে চলেছে। সম্প্রসারণ কর্মসূচি, তথ্য বিনিময় এবং সহযোগিতামূলক প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কৃষির উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অবদান রাখতে পেরেছি। সরকারি সংস্থা, স্টেকহোল্ডার এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্ব শক্তিশালী হয়েছে।

একটা সময় ছিলো যখন কৃষিকাজ করে কৃষক শুধু খেয়েপরে কোনোরকমে বেঁচে থাকতো। এখন আর সেরকম দৃশ্য দেখা যায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার কৃষিকে আধুনিক ও লাভজনক করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাধীনতা অর্জনের পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হতো। সেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে দেশে সব থেকে বড় সাফল্য এসেছে কৃষিতে। চার দশক ধরে খাদ্যে ঘাটতি থাকলেও দেশ এখন এ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ, যার গর্বিত অংশীদার সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক: ভাইস-চ্যান্সেলর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status