ঢাকা, ৮ মে ২০২৪, বুধবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

তফসিলের আগে ভোট চাওয়া কতটুকু আইনসিদ্ধ

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

(৬ মাস আগে) ১৭ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার, ১:২৪ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৭:২৫ অপরাহ্ন

mzamin

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করেছে নির্বাচন কমিশন, Representation of the People order, 1972  এর Article 91B-এ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে। ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা জারি করা হয় ১৯৯৬ সালের অনুসরণীয় আচরণবিধিমালা রহিত করে এবং ২০১৩ সালে আরও কিছু সংশোধন আনয়ন করে তা চূড়ান্ত করা হয়। আর নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের অধীন। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল  Representation of the People order, 1972 (P .O.no 155 of1972) chapter V1A-এর অধীন নিবন্ধিত হয়েছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেনি। কমিশন কর্তৃক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল সমূহের মাঝে একটি মাত্র দল- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বেশ কিছুদিন ধরে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে। সর্বশেষ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলার সিভিল এভিয়েশন মাঠে আয়োজিত জনসভায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী নৌকা মার্কায় ভোট চেয়ে বলেছেন- নৌকা মার্কায় ভোট দেন, আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেন, আমি আপনাদের কাছে ওয়াদা চাই আপনারা সবাই কি নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন-সহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। যার মাধ্যমে সারা দেশের জনগণ আওয়ামী লীগের  দলীয় প্রতীক নৌকা মার্কায় ভোট প্রদানের প্রচারণা দেখতে পেরেছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জন্য নির্বাচনী প্রচারণার সময় সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০০৮ এর ১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- প্রচারণার সময় কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা উহার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাহাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি ভোট গ্রহণের জন্য নির্ধারিত দিনের ৩ সপ্তাহ সময়ের পূর্বে কোনো প্রকার নির্বাচনী প্রচার শুরু করতে পারিবেন না।
সুতরাং আওয়ামী লীগ দলীয় জনসভায় এবং ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সারা দেশে জনগণের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট প্রদানের আহ্বান ও নির্বাচনী প্রচারের এসব বক্তব্য- নির্বাচন কমিশন প্রণীত সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালা ২০০৮-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার জন্য আচরণ বিধিমালায় অনেক বাধা নিষেধ উল্লেখ রয়েছে।

বিজ্ঞাপন
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের জন্য নির্বাচন পূর্ব সময়- অর্থাৎ জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন কিংবা কোনো শুন্য আসনে উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে কমিশন কর্তৃক তফসিল ঘোষণার দিন থেকে নির্বাচনী ফলাফল সরকারি গেজেট প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত সময়কাল নির্ধারণ করেছে। এই সময়ে সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্রচারণা সংক্রান্ত কাজে নির্বাচন কমিশন বাধা নিষেধ প্রদান করেছে। যাতে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ বা ব্যবহার করতে না পারেন। এমন কী নির্বাচন পূর্ব সময়ে প্রকল্প অনুমোদন, ফলক উন্মোচন প্রশ্নে বলা হয়েছে- নির্বাচন পূর্ব সময়ে কোনো সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রাজস্ব বা উন্নয়ন তহবিলভুক্ত কোনো প্রকল্পের অনুমোদন, ঘোষণা বা  ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন কিংবা ফলক উন্মোচন করা যাবে না। সরকারি দল যদি সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তফসিল ঘোষণার পূর্বে দলীয় প্রচারে ব্যবহার করে, প্রকল্প অনুমোদন বা ফলক উন্মোচন করে- তা কোনোক্রমেই আইনগত বা নৈতিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করে না।

নির্বাচনী বিধিমালা লঙ্ঘনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিধিমালার বিধান লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ধারা ১৮-তে বলা হয়েছে-
(১) কোনো প্রার্থী বা তাহার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্বাচন পূর্ব সময়ে এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করিলে অনধিক ছয়মাসের কারাদণ্ড অথবা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা দণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।
(২) কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচন পূর্ব সময়ে এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করিলে অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনো দলই তার দলের প্রতীকে ভোট দেয়ার জন্য কোনোরকম নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে না বা জনসভায় দলীয় প্রতীকে ভোট দেয়ার আহবান জানাচ্ছে না, কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো দলের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বেই নৌকা প্রতীকে ভোট চাওয়া কেনো জরুরি প্রয়োজন হলো? এতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হচ্ছে। এই ধরনের আগাম নির্বাচনী প্রচারব্যবস্থায় ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন এসব দেখেও না দেখার ভান করছে। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে কোনো শাস্তিযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশন প্রদর্শন করতে পারেনি। আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সতর্ক করার জন্য একটি নোটিশ প্রদানের সক্ষমতাও কমিশনের নেই। কমিশন তার প্রণীত আচরণ বিধিমালা যথাযথ প্রয়োগ করে বৈধতার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি।
ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণ থেকে নির্বাচন- মুক্ত হওয়ার কোনো পথ যে নেই, এতে তা প্রমাণীত হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন যদি স্বেচ্ছায় তার 'ক্ষমতা', 'এখতিয়ার' এবং 'বৈশিষ্ট্য' থেকে সরে আসে তাহলে একটি অবাধ ও পক্ষপাতহীন নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনা দিনদিন তিরোহিত হয়- এটা স্পষ্ট।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন দল হওয়ায় নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে সতর্ক হওয়ার তাগিদও অনুভব করছে না। নির্বাচনকে তারা শুধুমাত্র ক্ষমতা ধরে রাখার উপায় হিসেবে বিবেচনা করছে। রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থায় এবং নির্বাচনে জনগণকে  অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলা হয়েছে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে, ধ্বংসপ্রাপ্ত নির্বাচনী ব্যবস্থা দিয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে আইনগত এবং অনৈতিকভাবে ব্যবহার করার মাধ্যমে ক্ষমতা হয় তো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এটা সুনিশ্চিত। 
নির্বাচন সম্পর্কিত গোটা পদ্ধতি এবং আনুষঙ্গিক কাজের জন্য 'নির্বাচন কমিশন'কে যতই স্বাধীন বা শক্তিশালী সংস্থা বলা হোক- সরকারি দলের প্রভাবের বাইরে এর অবস্থান করার বাস্তবতা বাংলাদেশে নেই। নির্বাচন কমিশন যে সরকারি দলের উদ্দেশ্যসিদ্ধির কাজে ব্যবহৃত হবে না, এমন বিশ্বাস কারোরই নেই।
'৭১-এ গণতন্ত্র অর্থাৎ জনগণের ভোটের মর্যাদা রক্ষার জন্য সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে, অগণিত মানুষ আত্মবলিদান করেছে-  আর এখন গণতন্ত্রের সমাধির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের বয়ান দেয়া হচ্ছে। এটা জাতির জন্য বড়োই দুর্ভাগ্য।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শুরুর আগেই- রণেভঙ্গ দেয়া বিদ্যমান নির্বাচন কমিশন কীভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে, তা আর কিছুদিন পরই জাতি প্রত্যক্ষ করবে!

লেখক: গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক
[email protected]

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status