ঢাকা, ৩ মে ২০২৪, শুক্রবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

ফিলিস্তিনের পাশে শুধু ইরান কেন!

মাহবুব নাহিদ
২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার
mzamin

মুসলমানদের সংগঠন যদি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে তাহলে ফিলিস্তিন কেন শুধু বিশ্বের কোনো মুসলিম দেশেই হামলা বা শাসন-শোষণ করতে হলে একশ’বার ভাবতে হবে। ইহুদিরা এখন দিন গুনছে দাজ্জালের আগমনের। আর আমরাও স্মরণ করি, এডলফ হিটলারের কথা। তিনি যেভাবে বিশ্বের বুকে ইহুদিদের ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত হয়েছিলেন, সেই কথা সবার মনে পড়ে। অনেকেই হয়তো তার সেই বিখ্যাত উক্তি নিয়েও চর্চা করেন, তিনি কিছু ইহুদি রেখে যাচ্ছেন যাতে সবাই মনে করে যে কেন তিনি তাদের মেরেছিলেন! আজ আমাদের সত্যিই হিটলারকে মনে পড়ে। আমরা ভয় পাই রোহিঙ্গাদের নিয়েও, একসময় তারাও না এভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমরা খুব ভালো আছি, ভালো খাচ্ছি, নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছি। কিন্তু আমাদের ভাইয়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে আছে। প্রতি মুহূর্ত মৃত্যুভয়ে পার করছে তারা। শুধু মুসলমান হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে উচিত এই হত্যাযজ্ঞের বিপক্ষে দাঁড়ানো।

বিজ্ঞাপন
শুধু ফিলিস্তিন নয়, কোথাও এমনটা না হোক, সেটাই প্রত্যাশা

 

ঘটনার ঘূর্ণিপাকে অনেক কিছুই ঘূর্ণি খায়। দিন চলে যায়, রাত চলে যায় কিন্তু কিছু মানুষের দুঃখ দুর্দশা চিরকাল থেকেই যায়। আমরা সারা বিশ্ব কি দারুণ একটা সময় পার করলাম। আমরা ঈদ কাটালাম, আনন্দ করলাম। কিন্তু ফিলিস্তিন ও গাজার মানুষগুলো কি অসহায় দিনযাপন করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঈদের আনন্দ ওদের কাছে ফিকে হয়ে গেছে। ওদের কাছে বেঁচে থাকাই যেন ঈদের আনন্দ। প্রতিটা মুহূর্ত ওরা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে।  একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই দৃশ্যটা এমন না হলেও হতে পারতো। আজকের যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে গাজার মানুষ, ঠিক তার চেয়েও করুণ অবস্থায় ছিল ইসরাইলের মানুষেরা। ইসরাইলে যেসব ইহুদিরা বসবাস করে, তাদের আমাদের বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। বেদে সম্প্রদায়ের যেমন নির্দিষ্ট কোনো ঘর নেই তেমনি ইহুদিদেরও নির্দিষ্ট কোনো ঘর ছিল না। ফিলিস্তিনের বুকে তারা এক রকম উড়ে এসে জুড়েই বসেছে বলা যায়। মূলত দেশটা ফিলিস্তিনের, এটাই হচ্ছে চরম সত্য। ফিলিস্তিন তাদের পূর্বের মানচিত্রে ফিরে যেতে চায়। এটা শুধুমাত্র তাদের না, সারা বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের চাওয়ার জায়গা। ফিলিস্তিনের চাওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের ভাবাদর্শ একদম মিলে যায়। আমরা যেভাবে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা পেয়েছি, সেভাবেই ফিলিস্তিনও স্বাধীনতা চায়। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য যুগ যুগান্তরে অনেকেই কাজ করে গেছেন। সেই পালে নতুন হাওয়া লাগিয়েছিল হামাস। হামাস হচ্ছে হারাকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া (ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন), তারা ফিলিস্তিনের একটি ইসলামী রাজনৈতিক দল যারা গাজা শহর নিয়ন্ত্রণ করে।  হামাস বেশ কিছুদিন ধরেই নতুন করে ইসরাইলে হামলা চালাচ্ছে। হামাসের হামলার সাথে নতুন করে যোগ দিয়েছে পরমাণু শক্তিধর শিয়া অধ্যুষিত দেশ ইরান। শিয়া শব্দটা বলার একটা বিশেষ কারণ আছে। ইরান যখন হামাসের পক্ষ নিয়েছে বা ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তখন চতুর্দিকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। প্রথমত বেশির ভাগ মানুষ ইরানকে সাধুবাদ জানিয়েছে, দ্বিতীয়ত অনেকেই আবার বলছে ইরান শিয়া হয়ে সুন্নিদের পাশে দাঁড়িয়েছে এটা একটা ভিন্ন ব্যাপার, এর আড়ালে হয়তো ঢোল খঞ্জনির বাজনা আছে। অর্থাৎ পেটে পেটে হয়তো ভিন্ন কথা থাকলেও থাকতে পারে। অর্থাৎ ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতা বহুদিনের। আর ইসরাইলের সবচেয়ে বড় মিত্র হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্রের কানে সুড়সুড়ি দেয়ার জন্যই কি এই হামলা?  এই হামলার বিশেষ দুইটা দিক নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। এক, এই হামলার ফলে আসলে কি কোনো প্রভাব পড়েছে? দুই, বিশ্বে মুসলমানের সংখ্যা ২২০ কোটির মতো হলেও শুধুমাত্র ইরানের কেন দায়বদ্ধতা ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানোর?  প্রথম কথার ব্যাখ্যায় যাই, হামলার ফলে কোনো প্রভাব পড়েছে কিনা সেটা একটু জানতে যাওয়া উচিত আগে, ইসরাইলের সবচেয়ে বড় মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই হামলার সময় সফরে ছিলেন। তিনি সফর সংক্ষিপ্ত করে এসে জরুরি বৈঠকে বসে পড়েন। তারাও ইরানকে প্রতিরোধ করতে বদ্ধপরিকর। তারা অবশ্য যতটা না ইসরাইলের পাশে দাঁড়ানোর জন্য উদগ্রিব তার চেয়ে বেশি অবশ্য তাদের চিন্তা ইরানের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার ব্যাপারটা।

 সামনে মার্কিন নির্বাচন, এই মুহূর্তে ইরানকে হুমকি-ধমকি ভালোভাবে দিতে না পারলে নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলবে রিপাবলিকানরা। পাশাপাশি রিপাবলিকানরাও অনেক বড় কথা শোনাবেন এখন, তারা ক্ষমতায় আসলে  তারাও ইরানকে দেখিয়ে দিবে এমন কথা বলবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য এখনই হুমকি-ধমকি দেয়া শুরু করেছেন। পাশাপাশি ইসরাইলও নড়েচড়ে বসেছে। তারা জাতিসংঘে নালিশ দেয়াও শুরু করেছে। এদিকে আবার সামনে ভারতের নির্বাচন। ইসরাইলের যেমন মিত্র যুক্তরাষ্ট্র তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ভারত। দুই দেশের নির্বাচনের আগে ইসরাইল যদি হামাস আর ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে পিছিয়ে যার এর প্রভাব দুই দেশের নির্বাচনেও পিছিয়ে যাবে ক্ষমতাসীন দলগুলো।  শত্রুর শত্রু হয়ে যায় নিজের বন্ধু। বাইডেনের সঙ্গে নেতানিয়াহুর সম্পর্ক একটু খারাপ খারাপ ভাব যখন হয়েছিল, ঠিক তখনই ইরানের ইসরাইলে হামলা সম্পর্ক আবার পাকাপোক্ত করে দিয়েছে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটা সেটা হচ্ছে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব! শিয়াদের সঙ্গে সুন্নিদের দ্বন্দ্ব ঐতিহাসিক। কিন্তু ইসরাইল ফিলিস্তিন বা হামাসের যুদ্ধে তারা কেন পাশে দাঁড়ালো এইটা এখন আসল প্রশ্ন। ইরান নিশ্চিতভাবে মধ্যপ্রাচ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়, এটা সত্য। কিন্তু ইসরাইলের সঙ্গে ইরানের শত্রুতা কিন্তু নতুন না। এটা বহু পুরাতন, শুধু পুরাতন বললে ভুল হবে, এ যেন প্রায় অর্ধশত বছরের পুরাতন। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইরানের সঙ্গে ইসরাইলের একসময় সখ্যতা ছিল, শুধু সখ্যতা না, দারুণ সখ্যতা। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। তুরস্কের পরে ইরান দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলকে স্বীকৃতিও দেয়, ১৯৫০ সালে। ১৯৫৭ সালে ইরান যখন তাদের গোয়েন্দা সংস্থা ‘সাভাক’ প্রতিষ্ঠা করে তখন তারা ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদের’ সহায়তা নেয়। ইরানের শাহ শাসনের সময় বামপন্থিদের সঙ্গে ফাতাহ এবং ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। আয়াতুল্লাহ খামেনী এবং তার অনুসারীরা বরাবরই ইসরাইল নামক ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের বিপক্ষে ছিল। 

শেষমেশ ইরানে ইসলামিক বিপ্লব হওয়ার পরে ইরানের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্কের চিড় ধরা শুরু হয়। তখন ইরানের বিপ্লবী সরকার ইসরাইলের দূতাবাস ভেঙে দিয়ে ফিলিস্তিনের দূতাবাস গঠন করে। ইরানের ইসরাইল নীতি পরিবর্তন হওয়ার ফলে সম্পর্ক ভেস্তে যায়। এ ছাড়াও মিসাইল এবং পরমাণু প্রকল্পে হাত দেয়ার পর তো তিক্ততা আরও বেড়ে যায়। এসব প্রকল্পের অনেক বিজ্ঞানীকেও হত্যা করে ইসরাইল। হামাসের সঙ্গে হোক ফিলিস্তিনের সঙ্গে হোক সখ্যতার চেয়েও বড় বিষয় হয়তো ইসরাইলের সঙ্গে ইরানের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব। আবার এটাও সত্য যে ইসরাইলের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব লেগেছেও ফিলিস্তিনের জন্যই। যে কারণেই করুক তারা তো পাশে দাঁড়িয়েছে। মুসলিমদের বড় বড় হর্তাকর্তা দেশগুলো এখন ইরানের দোষ না ধরে তারাও তো পাশে দাঁড়াতে পারতো। সেটা না করে ইরানের পেছনে লাগার কোনো কারণ নাই। বিষয় হচ্ছে, ফিলিস্তিনে যে হত্যাযজ্ঞ ইসরাইল চালাচ্ছে তা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার, এটা সবাই দেখতেই পাচ্ছে। কিন্তু কেউ কথা বলছে না। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাব দিয়েছে যুদ্ধ বিরতির, কিন্তু স্থায়ী সমাধানের পক্ষে আগানোর মতো কোনো উদ্যোগ কেউ নিতে পারেনি। শিয়া অধ্যুষিত দেশ পাশে দাঁড়ালে যদি নিজেদের জাত চলে যায় তাহলে সুন্নি মুসলমানদের যারা হর্তাকর্তা আছে তারা কেন চুপ করে বসে আছে। এই বিষয়ে সবচেয়ে যাদের বেশি এগিয়ে আসার কথা ছিল তাদের চুপ থাকার বিষয়টা সবাইকে অবাক করে। বিশ্ব মুসলিমদের আবেগ অনুভূতির জায়গা সৌদি আরব কেন কোনো কথা বলে না এটা নিয়ে অনেকের অনেক কথা। যেই দেশে পবিত্র কাবা শরীফ আছে, যেই দেশে আমাদের প্রিয় নবী (স.) এর কবর রয়েছে তারা যদি মুসলমানদের কষ্টে চুপ থাকে তাহলে কষ্ট সবার লাগে। 

ফিলিস্তিন শুধু মুসলিম দেশ বলে নয়। ফিলিস্তিনের মাটি আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ইসরাইলের সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্দু আল আকসা মসজিদ আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মসজিদ মুসলমানদের প্রথম কিবলা ছিল। এই জায়গা থেকে আমাদের প্রিয় নবী (স.) কে মেরাজে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আর ঠিক সেই মসজিদ ভেঙে ইহুদিরা বানাতে চায় কিং সালমানের তৃতীয় মন্দির। এই মসজিদে তারা মুসলমানদের নামাজ পড়ায় বাধা দেয়।  এই আল আকসা মসজিদ ভাঙতে হলে মুসলমানদের বুকের ওপর ছুরি চালিয়ে ভাঙতে হবে।  কিন্তু ২২০ কোটি মুসলমান আজ কেন চুপ করে থাকবে! সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে বিশ্ব মুসলিমদের একটা সংগঠন আছে নাম যার ওআইসি, কিন্তু নেই তাদের কোনো কার্যক্রম, নেই তাদের কোনো উদ্যোগ। বিশ্বে মুসলমানদের সংগঠন যদি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে তাহলে ফিলিস্তিন কেন শুধু বিশ্বের কোনো মুসলিম দেশেই হামলা বা শাসন-শোষণ করতে হলে একশোবার ভাবতে হবে। ইহুদিরা এখন দিন গুনছে দাজ্জালের আগমনের। আর আমরাও স্মরণ করি, এডলফ হিটলারের কথা। তিনি যেভাবে বিশ্বের বুকে ইহুদিদের ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত হয়েছিলেন, সেই কথা সবার মনে পড়ে। অনেকেই হয়তো তার সেই বিখ্যাত উক্তি নিয়েও চর্চা করেন, তিনি কিছু ইহুদি রেখে যাচ্ছেন যাতে সবাই মনে করে যে কেন তিনি মেরেছিলেন! আজ আমাদের সত্যিই হিটলারকে মনে পড়ে। আমরা ভয় পাই রোহিঙ্গাদের নিয়েও, একসময় তারাও না এভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমরা খুব ভালো আছি, ভালো খাচ্ছি, নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছি। কিন্তু আমাদের ভাইয়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে আছে। প্রতি মুহূর্ত মৃত্যুভয়ে পার করছে তারা। শুধু মুসলমান হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে উচিত এই হত্যাযজ্ঞের বিপক্ষে দাঁড়ানো। শুধু ফিলিস্তিন নয়, কোথাও এমনটা না হোক, সেটাই প্রত্যাশা। 

লেখক: কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status