এক্সক্লুসিভ

জাহাজ নির্মাণ শিল্পে সুবাতাস!

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

১৮ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:৪৮ পূর্বাহ্ন

দেশের সবগুলো শিপইয়ার্ডে জাহাজ নির্মাণে ব্যস্ত সময় কাটছে এখন। চলছে সঠিক সময়ে অর্ডারপ্রাপ্ত জাহাজ হস্তান্তরে নিরন্তর চেষ্টা। ফলে সুবাতাস বইছে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে। বিষয়টি স্বীকার করেছেন শিপইয়ার্ড পরিচালকরাও।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরায় অবস্থিত কর্ণফুলী শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এম এ রশিদ মানবজমিনকে বলেন, টানা ৬ বছর মন্দাভাব কাটিয়ে চলতি বছরে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দেয়। শিপইয়ার্ডগুলোতে পর্যাপ্ত অর্ডার আছে। যা নির্মাণে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে এখন।
তিনি বলেন, জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু পুঁজির অভাবে এ শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে হিমশিম খাচ্ছে। এ শিল্পে সহায়ক ব্যাংক ঋণ পেলে রপ্তানির অন্যতম খাত হবে।
তিনি বলেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও মন্দা নেমে আসে। এ সময় পর্যাপ্ত অর্ডার না থাকায় ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি অনেক প্রতিষ্ঠান। বেড়েছে সুদের বোঝা। তাই এ খাতে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা ও সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড শিপবিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশ-এইওএসআইবির তথ্যানুযায়ী, দেশে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক শিপইয়ার্ড ও শতাধিক মেরিন ওয়ার্কশপ রয়েছে। শিপইয়ার্ডগুলির ৭০শতাংশ ঢাকা ও এর আশেপাশে, ২০ শতাংশ চট্টগ্রামে এবং ১০ শতাংশ খুলনা ও বরিশালে অবস্থিত। দেশের সকল অভ্যন্তরীণ ও সমুদ্র উপকূলীয় জাহাজ এসব শিপইয়ার্ডে নির্মাণ 
ও মেরামত হয়ে থাকে। স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য এসব শিপইয়ার্ড ৩৫০০টন ধারণক্ষমতা সমপন্ন জাহাজের ডিজাইন তৈরি ও নির্মাণ করে।

বেশিরভাগ শিপইয়ার্ডই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। এতে সরকারের পর্যবেক্ষণ-নিয়ন্ত্রণ অতি সামান্যই। বছরপ্রতি নতুন নির্মিত জাহাজের সংখ্যা ২৫০। এ কাজে শিপইয়ার্ডগুলোতে ৫০ হাজার দক্ষ, ১ লাখ আধাদক্ষ কর্মী নিয়োজিত রয়েছে। বেশিরভাগ ব্যক্তি মালিকানাধীন শিপইয়ার্ড মার্চেন্ট শিপের পুরনো প্লেট, ইঞ্জিন ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে। যা ভাটিয়ারী অঞ্চলে জাহাজভাঙ্গা কারখানা থেকে সংগ্রহ করা হয়।
তথ্যে জানা যায়, দেশে আনুমানিক ১০ হাজার টন ক্ষমতার আন্তর্জাতিক মানসমপন্ন রপ্তানিমুখী জাহাজ তৈরির ক্ষমতা সমপন্ন ১০টি শিপইয়ার্ড রয়েছে। এরমধ্যে ২০০৮সালে জার্মানির স্টেলা শিপিং কোমপানির কাছে প্রথম এমভি স্টেলা ম্যারিস নামের সমুদ্রগামী বহুমুখী পণ্যপরিবহনের উপযোগী জাহাজ রপ্তানি করে আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেড। এরপর জাহাজ রপ্তানিতে যুক্ত হয় চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড।
তথ্যমতে, গত ৮ বছরে বিশ্বের ১১টি দেশে মোট ৪২টি জাহাজ রপ্তানি করে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এরমধ্যে ওয়েস্টার্ণ মেরিন শীপইয়ার্ড লিমিটেড রপ্তানি করেছে ২৭টি জাহাজ। যার মূল্য প্রায় ১৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অবশিষ্ট জাহাজগুলো রপ্তানি করেছে আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়ে লিমিটেড। বর্তমানে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও নরওয়েতে রপ্তানির জন্য ৬টি জাহাজ নির্মাণ করছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও এশিয়ার অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে দেশীয় কয়েকটি জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানও নির্মাণাদেশ নিশ্চিত করতে পেরেছে।
এইওএসআইবির সাধারণ সমপাদক ও ওয়েস্টার্ন মেরিনার্স শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমরা এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। এজন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি ব্যাংক লোন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩০ বছর মেয়াদি লোন পরিশোধের সুযোগ আছে। এ শিল্পে আর্থিক সমস্যা নিরসনে রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগকৃত মূলধনের বিপরীতে উচ্চ সুদের হার ৪ শতাংশ করে, তা ২০ বছর মেয়াদে (৫ বছর মোরাটারিয়াম সময়সহ) পরিশোধের সুবিধা দেয়া অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। তা হলেই ২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত যে লোকসান ছিল তা ক্রমেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, দেশের যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে তাতে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশের প্রচুর অর্ডার পেয়েছি। আগামি ১০ বছরে আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতের দরকার পড়বে ৬০০ জাহাজ। কিন্তু এত জাহাজ তৈরির সক্ষমতা তাদের নেই। আমার প্রতিষ্ঠান ১০ জাহাজ নির্মাণের অর্ডার পেয়েছে। সুতরাং বিষয়টি পরিষ্কার।
তিনি বলেন, তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও পরিবহন ভাড়া কমে যাওয়ায় এ শিল্পের মন্দাভাব বিরাজ করছে। তবুও অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। কারণ বিদেশে যে জাহাজ নির্মাণে ৩৫কোটি টাকা লেবার খরচ লাগে; সেখানে আমাদের দেশে লাগে মাত্র ৩ কোটি টাকা।

তবুও আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় আন্তর্জাতিক দরপত্রে সরাসরি অংশ নেওয়ার সুযোগও কমে যাচ্ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর। এছাড়া এ শিল্পের জন্য নীতিমালা না থাকায় অনেকেই মানসমপন্ন জাহাজ নির্মাণ করছেন না। ফলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক সম্ভাবনাময় এ শিল্পে বিরুপ প্রভাব পড়ছে। তাই সংশ্লিষ্টরা জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য একটি নীতিমালা অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন।
এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেড চেয়ারম্যান ইয়াছিন চৌধুরী বলেন, মন্দার কারণে আমাদের ব্যাপক লোকসান হয়েছে। প্রায় প্রতিটি শিপইয়ার্ডের অবস্থা একই। অনেকেই ব্যাংক ঋণের কারণে দেউলিয়ার পথে। অথচ আমরা প্রচুর অর্ডার পেয়েছি। অর্থসংকট নিয়ে সরকার আন্তরিক হলে এ শিল্পের দুরাবস্থা কেটে যাবে।
তিনি বলেন, চীনে জাহাজ নির্মাণ খাতে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ব্যাংকঋণ পায়। ইস্পাতের তৈরি পাত নিজ দেশের প্রতিষ্ঠান থেকে কেনার ক্ষেত্রে বাজারমূল্যের চেয়ে ১৫ শতাংশ ভর্তুকি পায়। জাহাজ রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রণোদনা পায় ২০ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে সুদের হার ৯-১২.৫ শতাংশ। রপ্তানিমূল্যে প্রণোদনা ১০ শতাংশ। কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকলেও চীনের মতো নয়। ফলে শ্রমিকের মজুরি কম হলেও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো।
দেশীয় উদ্যোক্তারা বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিজেদের জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে বাঁচাতে প্রণোদনা দিচ্ছে। ভারত সরকার ২০১৬ সালের ১লা এপ্রিল থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত জাহাজের রপ্তানিমূল্যের ওপর ২০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা অনুমোদন করেছে। অথচ রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়ায় দেশীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গত তিন বছরে জনবল ছাঁটাই করেছে। তবে দেশে পদ্মা সেতুসহ অনেকগুলো বড় অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে হলে এখনই প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো সরকারিভাবে এ শিল্পের সহায়তা প্রয়োজন।
এইওএসআইবির তথ্যমতে, বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণশিল্পে অবকাঠামোগত বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকা। আর জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশের বিপরীতে নেয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এখন ঋণ অনিয়মিত হওয়ায় বা বিনিয়োগের অর্থ তুলে আনতে না পারায় ব্যাংকগুলো নতুন করে জাহাজ নির্মাণখাতে উৎসাহী হচ্ছে না।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের রিভিউ অব মেরিটাইম ট্রান্সপোর্টের ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বিশ্বে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের শীর্ষে চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিতীয়, তৃতীয় জাপান। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ২২তম। প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ২০তম।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status