এক্সক্লুসিভ

একজন সাখাওয়াত হোসেন

তামান্না মোমিন খান

৩ এপ্রিল ২০১৬, রবিবার, ৯:৩৩ পূর্বাহ্ন

ঘটনাবহুল এক জীবন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনের। জন্ম ১৯৪৮ সালে বরিশালে। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় তিনি। বাবা বেলায়েত হোসেন তৎকালীন পাকিস্তানের সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় অনেক শহরেই থাকার সুযোগ হয়েছে তার। জন্মের কিছুদিন পর বাবার সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। প্রথম স্কুল তেজগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এরপর বাবার বদলির সুবাদে তৃতীয় শ্রেণিতে  গিয়ে ভর্তি হন রংপুর জেলা স্কুলে। দুই বছর রংপুরে থাকার পর পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়ে ভর্তি হোন যশোর জেলা স্কুলে। এখানে পড়েন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। এরপরে বাবার বদলি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ে। এরপর করাচি থেকেই স্কুল-কলেজ শেষ করে ভর্তি হোন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনা বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে কমিশন লাভ করেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় শিয়ালকোটে ছিলেন সাখাওয়াত হোসেন। সে সময়টায় কেমন ছিলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় থেকে দেশে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানে বন্দিদশার মধ্যে কাটাতে হয়েছিল। বাঙালি অফিসারদের পরিবারগুলোকে সেনানিবাসে না রেখে একটি ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল। বাঙালি সেনা অফিসারদের র‌্যাঙ্ক কেড়ে নেয়া হয়েছিল। বেতন বন্ধ ছিল। মাসোহারা হিসেবে মাত্র দুশো টাকা দেয়া হতো। এ সময়ের মধ্যে আমার বড় সন্তানের জন্ম হয়। সে এক দুর্বিষহ সময়। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝিতে যখন বাংলাদেশে ফিরে আসি তখন একটা সুটকেসে কিছু কাপড় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। মাত্র যুদ্ধ শেষ হওয়া বাংলাদেশের তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো ছিল না। সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন চলছিল। তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর পদে যোগ দেই কুমিল্লা সেনানিবাসে। কিছুদিন কুমিল্লা থাকার পর ১৯৭৪ সালের শুরুর দিকে আবার বদলি হই ঢাকা সেনানিবাসে।
১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থান পালটা অভ্যুত্থানগুলো খুব কাছে থেকে দেখেছেন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত। তিনি বলেন, ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেনাবাহিনীর ভেতরে নেতৃত্বের একটা টানাপড়েন চলছিল। এ সময়টিতে প্রায় ২১টির মতো ছোট ছোট অভ্যুত্থান হয়েছিল। আমার মধ্যে কখনও ক্ষমতায় যাবার কোনো মোহ কাজ করেনি। এ কারণে এসব অভ্যুত্থান থেকে আমি নিজেকে দূরে রাখতে পেরেছি। সবসময় চেইন অব কমান্ড মেনে চলেছি। আমি কখনও সেনা আইনের বাইরে কোনো কাজ করিনি। চাকরি জীবনে কুমিল্লা, ঢাকা, সৈয়দপুর, খুলনা, যশোর, বান্দরবান ও ময়মনসিংহ সেনানিবাসে দায়িত্ব পালন করেছেন। লেখাপড়া করেছেন স্টাফ কলেজ অব বাংলাদেশ, স্টাফ কলেজ অব আমেরিকা এবং ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ অব পাকিস্তান থেকে। ২৯ বছর সামরিক বাহিনীতে চাকরি করার পর ১৯৯৪ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদ থেকে অবসরগ্রহণ করেন। এরপর কিছুদিন ব্যবসা করার চেষ্টা করেন। ব্যবসা ঠিক জমে না উঠায় সরে আসেন ব্যবসা থেকে। তারপর থেকেই লেখালেখি শুরু। প্রথম বই লেখেন ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের রক্তাক্ত অধ্যায় নামে। প্রায় ৪০০টির মতো আর্টিকেল বের হয়েছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। নির্বাচন কমিশনার হওয়ার আগে উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন সাখাওয়াত হোসেন। ২০০৬ সালে ইয়াজউদ্দিন সরকারের ৪ উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে তাকে এই প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু প্রস্তাবটি গ্রহণ করেননি তিনি। সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সে সময়ের রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দেই। কারণ উপদেষ্টা হয়েও সেই পরিস্থিতিতে আমি কোনো অবদান রাখতে পারতাম না। ওয়ান ইলেভেনের পর সে সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদ একদিন আমাকে ফোন করে নির্বাচন কমিশনার হওয়ার প্রস্তাব দেন। আমি কিছুটা সময় নেই ভেবে দেখার জন্য। এরপর ২০০৭ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যোগ দেই নির্বাচন কমিশনে। এর আগে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার শামসুল হুদা এবং নির্বাচন কমিশনার হিসেবে মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন নির্বাচন কমিশনে যোগ দেন। আমরা কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে কাজ করেছি নির্বাচন কমিশনে। একদিকে যেমন জরুরি অবস্থা চলছিল অন্য দিকে নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের কমিশন কিছু কাজ করেছিল যা আগে কখনও হয়নি। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করি। আমাদের কমিশনের সবচেয়ে বড় যে সাফল্য তা হচ্ছে ছবিসহ জাতীয় পরিচয়পত্র। আগে এদেশের মানুষের কোনো পরিচয়পত্র ছিল না। আমরা ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি চালু করেছিলাম। এ পদ্ধতি গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছিল। কেন বর্তমান কমিশন এ পদ্ধতি থেকে সরে আসলো তা বুঝতে পারলাম না। আমাদের কমিশন যখন যা কাজ করেছে তা নিয়েও অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু আমরা এ সমালোচনাগুলোকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছি। নির্বাচন কমিশন তিন সদস্যের বেশি হওয়া ঠিক নয় বলে মনে করেন সাবেক এই কমিশনার। তিনি বলেন, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। যখন তিনের অধিক কমিশনার হবে তখন মতবিরোধও বেশি হবে। আমাদের কমিশন যা সিদ্ধান্ত নিতো আমরা তিনজনে একমত হয়েই নিতাম।
নির্বাচন কমিশন থেকে বিদায়ের পর বিভিন্ন নাগরিক ইস্যুতে সরব রয়েছেন এম সাখাওয়াত হোসেন। স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই পুত্রবধূ নিয়ে তার পরিবার। থাকেন মহাখালী ডিওএইচএসে। স্ত্রী  লে. কর্নেল (অব. ) রেহানা খানম পেশায় চিকিৎসক। বড় ছেলে মোহম্মদ কায়সার হোসেন একটি মোবাইল কোম্পানিতে কর্মরত। ছোট ছেলে মোহম্মদ শাফাক হোসেন ব্যবসা করেন। কখনও রাজনীতিতে নাম লেখাবেন না বলে জানান তিনি। দ্রুত রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশ আবার গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসবে এমনটাই প্রত্যাশা এম সাখাওয়াত হোসেনের।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status