চলতে ফিরতে

কলকাতার স্কাই লাইনে এক বাংলাদেশির সাফল্যগাথা

কাজল ঘোষ, কলকাতা থেকে ফিরে

৩১ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১:১১ পূর্বাহ্ন

ব্যতিক্রমী স্লোগান। আপকা ভালা, সবকা ভালা। এ স্লোগানে মাতোয়ারা এখন ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো। রাস্তায় রাস্তায় বিজ্ঞাপনে দৃষ্টি কাড়ে সবার। এমনই একটি বিজ্ঞাপন কলকাতার স্কাই লাইনেও। যে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংটি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেটি হলো বন্ধন ব্যাংকের বিজ্ঞাপন। স্বাধীন ভারতে, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে এটি বাঙালি মালিকানার প্রথম ব্যাংক এবং একমাত্র ব্যাংক। আবার সেই মালিক বাংলাদেশের এক যুবক। যিনি বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক ও আশার কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে তোলেন এই ব্যাংক। আদতে বৃহত্তর ত্রিপুরায় জন্ম হলেও যুবক চন্দ্রশেখর ঘোষ বাংলাদেশেরই মানুষ। রাশিবিজ্ঞান নিয়ে মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতকোত্তর পাস করে ব্র্যাকে চাকরিও করেছেন। ১৯৭০ সালে তার পরিবার চলে এসেছিলেন কলকাতায়। তবে চন্দ্রশেখর কলকাতায় আসেন ১৯৯৭ সালে। প্রথমে কিছুদিন নানা রোজগারের চেষ্টা করার পর ঠিক করেন নিজেই শুরু করবেন মাইক্রো ফিন্যান্সিংয়ের ব্যবসা। মহিলাদের স্বাবলম্বনের লক্ষ্যে সামান্য পুঁজি নিয়ে ২০০১ সালে শুরু করেছিলেন এই মাইক্রো ফিন্যান্সিংয়ের ব্যবসা। মাত্র পনেরো বছরে সেই ব্যবসার সাফল্য ও ব্যবসায়িক স্বচ্ছতার কারণে সারা ভারতে প্রথম তাঁর মাইক্রোফিন্যান্স কোম্পানিকে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া পরিপূর্ণ ব্যাংক খোলার অনুমতি দেয়। শিল্পগ্রুপ আম্বানি ও বিড়লাদের হারিয়ে ব্যাংক তৈরির সুযোগ তিনিই পেয়েছিলেন। আর এখন ভারতের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বন্ধন ব্যাংক একটি অন্যতম নাম। বর্তমানে এটি একটি পরিপূর্ণ ব্যাংক। এর মূল মন্ত্র, আপকা ভালা, সবকা ভালাই অর্থাৎ আপনার ভালো, সবার ভালো।  রিজার্ভ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স পেয়ে ২০১৫ সালে ব্যাংক হিসেবে এটি যাত্রা শুরু করেছিল। জন্মলগ্নে গোটা দেশে এটির মোট শাখা ছিল ৫০১টি। বর্তমানে মোট শাখার সংখ্যা ৮৪০। শুরুতে ৫০টি এটিএম কাউন্টার থাকলেও ধীরে ধীরে দেশ জুড়ে বন্ধন ব্যাংক তাদের এটিএম কাউন্টারের সংখ্যা বাড়িয়েছে। কিছু দিন আগেই এক কোটি গ্রাহক হওয়ার সাফল্যকে উদযাপনও করেছে। বর্তমানে ব্যাংকে গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১কাটি ১০ লাখের কাছাকাছি। চলতি অর্থ বছরের ব্যাংকের ত্রৈমাসিক আর্থিক অবস্থা পেশ করতে গিয়ে ব্যাংকের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান কর্মকর্তা চন্দ্র শেখর ঘোষ জানিয়েছেন, এই ত্রৈমাসিকের হিসাবে ব্যাংক মুনাফা করেছে ৩২৭ কোটি টাকা। তিনি জানিয়েছেন, এবার মিউচুয়্যাল ফান্ড এবং জেনারেল ইনসিওরেন্স ব্যবসায় নামতে চলেছে বন্ধন ব্যাংক। সেপ্টেম্বর মাস থেকেই এই পরিষেবা চালু করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে চালু হবে আবাসনের জন্য ঋণপ্রদান ব্যবস্থাও। ঘোষ আরো জানিয়েছেন, ছোট এবং মাঝারি শিল্পে আমরা বিনিয়োগের ওপর জোর দিচ্ছি। ছোট এবং মাঝারি শিল্পে ১ থকে ১০ লাখ পর্যন্ত ঋণদানে ব্যাংক কোনো  ‘সিকিউরিটি’ না নিয়ে নজির গড়তে চলেছে।

বন্ধন ব্যাংকের গোড়ার কথা
চন্দ্র শেখর ঘোষ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৯৮৪ সালে পরিসংখ্যান বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কাজ করেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকে। তাও প্রায় একযুগ। পরিবার আগেই থিতু হয়েছিল আগরতলায়। ১৯৯৭ সালে চন্দ্র শেখর পাড়ি জমান কলকাতায়। কি করবেন এমন চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরছিলেন। দরিদ্র্যতার কশাঘাত তখন পরিবারের পিছু ছুটছে। ঘরে নিয়মিত খাওয়া জুটতো না। কিন্তু চন্দ্র শেখর ঘোষ মুষড়ে পরেননি। এমনও হয়েছে শুধু সেদ্ধ ভাত খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। কিভাবে বদল ঘটলো সেই দিনের? ১৯৯৭ থেকে ২০১৭। দুই দশক। চন্দ্র শেখর ঘোষের পুঁজি ছিল সততা, পরিশ্রম আর বুদ্ধিমত্তা। তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘বন্ধন’ বইতে সেইদিনগুলোর উল্লেখ আছে এভাবেই। উত্তর কলকাতার শুভাবাজার এলাকায় একটি ছোট্ট কক্ষে চারজন মানুষ কিছু সুতা নিয়ে পোশাক তৈরির কাজ শুরু করেন। প্রথমদিকে এ থেকে আয় হয়েছিল দৈনিক ১০০ থেকে ২০০ রুপি। পরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলো নিয়ে সেখানেই হোসিয়ারি বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর এর সঙ্গে যুক্ত হয় দারিদ্র্য দূরীকরণ ও চিকিৎসা সেবা নিয়ে কাজ। একদিন সুভাবাজার এলাকায় সবজিবাজারে কিছু নারীর ঋণ নিয়ে সবজি কেনাবেচার অভিজ্ঞতা শুনে বদল ঘটে চিন্তার। যারা অধিক সুদে ঋণ নিয়ে প্রতিদিন ফেরত দিত মহাজনকে। পরে কিভাবে এইসব দরিদ্র মানুষদের বিনা জামানতে অল্প সুদে ঋণ দেয়া যায় তা নিয়ে কাজ শুরু করেন চন্দ্র শেখর ঘোষ। টার্নিং পয়েন্ট এখানেই। আজ থেকে দেড়দশক আগে ২০০১ সালে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা বন্ধন পথচলা শুরু করে। হাওড়ার বাগনানে এর সূচনা। মাত্র তিনজন কর্মী নিয়ে একটি ভাড়া বাড়িতে। সেখানে বর্তমানে বন্ধন ব্যাংকে কাজ করছে ১৯,৫০০ মানুষ। ভারতের ২৭টি রাজ্যে ৮৪০ শাখা আর ২৫০টি এটিএম বুথের মাধ্যমে প্রতিনিয়িত সেবা ছড়িয়ে দিচ্ছে বন্ধন। চন্দ্র শেখর ঘোষ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রতিবছর ৩০ শতাংশ হারে ব্যবসা বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে বন্ধন। সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য বায়োমেট্রিক (বুড়ো আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে) পদ্ধতিতে অ্যাকাউন্ট খোলার পদ্ধতি চালু করবে বন্ধন। এ জন্য ব্যাংকের শাখায় শাখায় ছোটছোট যন্ত্র রাখা হবে। সেখানেই আঙুলের টিপ ছাপ দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেন করা যাবে। ব্যাংক শুরু করতে যেখানে ন্যূনতম ৫০০ কোটি টাকা মূলধনের প্রয়োজন  সে তুলনায় অনেক বেশি ৩,২০০ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে বন্ধন ব্যাংক যাত্রা শুরু করেছে। যেহেতু রিজার্ভ ব্যাংকের নিয়ম অনুসারে, কাজ শুরুর তিন বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে শেয়ারবাজারে নথিভুক্ত করার সুযোগ আসবে তাই তখনই সুবিধা মতো সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চান চন্দ্র শেখর ঘোষ। ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত ৮,০০০ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে, যার মধ্য একেবারে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আনা হয়েছে প্রায় ৮৫০ জনকে। এছাড়া ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা হিসেবে সারা দেশে বন্ধনের ওই ২০২২ শাখাকেও ব্যাংকিং পরিষেবায় শামিল করা হবে। নতুন ব্যবস্থায় ওই সব শাখা ক্ষুদ্রঋণ দেয়া ছাড়াও ছোট অংকের আমানত সংগ্রহ, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় টাকা হস্তান্তর করা (রেমিট্যান্স), বীমা প্রকল্প বিক্রিসহ আরো কিছু কাজ করবে। নতুন ব্যাংক চালুর ব্যাপারে বন্ধনকে বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে সারা দেশে তাদের ক্ষুদ্রঋণ পরিষেবার অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছে। বন্ধন পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে ক্ষুদ্রঋণ পরিষেবাও বন্ধন চালু রাখতে চায়। বর্তমানে সারা দেশে বন্ধনের ৬৬ লাখ ক্ষুদ্রঋণ গ্রাহক তাদের একইসঙ্গে ব্যাংকেরই অ্যাকাউন্ট হোল্ডার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। প্রথম সূচনা বক্তব্যে চন্দ্র শেখর ঘোষ সাধারণ ঘোষণায় বলেছেন, ব্যাংকিং হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার। কাজেই বন্ধনের কাছ থেকে কেউ যেন মুখ ফিরিয়ে না নেয় তা নিয়ে কাজ করছে বন্ধন। বিনা জামানতে ব্যবসায়ীদের দশ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়ে পুরো ভারতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন চন্দ্র শেখর ঘোষ। একজন বাংলাদেশির এই সাফল্য যে দেশপ্রেমি মানুষের জন্য সত্যিই গৌরবের। যা দেশের বাইরে কলকাতায় বসে বারবার মনে হয়েছে। চলার পথে বন্ধন ব্যাংকের সাইনবোর্ড, বন্ধন ব্যাংকের শাখা দেখলে মনে হয়েছে এ ব্যাংকের রূপকার একজন বাংলাদেশি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status