এক্সক্লুসিভ
অভিনয়ও করতেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
রুদ্র মিজান
৭ আগস্ট ২০১৭, সোমবার, ৩:৩৮ পূর্বাহ্ন
মুজাহিদুল ইসলাম খান সেলিম। আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে খান শব্দটি বাদ দেন নিজের নাম থেকে। সেই থেকে হয়ে যান কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ছাত্রাবস্থায় আকৃষ্ট হন সমাজতন্ত্রের প্রতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ মার্ক পেলেও কোনো চাকরিতে যোগ দেননি। দেশের বাইরেও যাননি। বুর্জোয়া দলের ক্ষমতার সিঁড়িও হননি। বরং লোভনীয় অনেক প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। বিয়ে, সংসার থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করেছেন। মা-বাবার একমাত্র পুত্র। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বিয়ে করেছেন। তার স্বপ্ন শোষণহীন সমাজ। যেখানে মানুষের অধিকার থাকবে। শ্রেণিবৈষম্য থাকবে না। সেলিম বিশ্বাস করেন কোনো একদিন তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবেই।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের জন্ম এক অস্থির সময়ে। পাকিস্তান জন্মের এক বছর পরে। ১৯৪৮ সালের ১৬ই এপ্রিল ঢাকার অদূরে সাভারে। বাবা মোসলেহ উদ্দিন খান ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা আর মা উম্মে হানী খানম ছিলেন নারীনেত্রী। ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫৭ সালে ভর্তি হন সেন্ট গ্রেগরি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে। তখন থেকেই শিক্ষা বৈষম্যটি তার চিন্তায় স্থান পায়।
শিশু বয়সে স্বপ্ন দেখতেন বিজ্ঞানী হবেন। আর তাইতো মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, শৈশবে ভাবতাম মানুষের জন্য বিশেষ কিছু আবিষ্কার করবো। বিশেষ কোনো যন্ত্র, যা মানুষের জীবন-যাপনকে উন্নত করবে, যা এক ব্যক্তি পরিচালনা করে ১০০ জনের কাজ করবে একাই। কিন্তু ভাবতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো তাহলে তো ৯৯ জন বেকার হয়ে যাবে। প্রযুক্তির সঙ্গে
সমাজ ব্যবস্থার পুনর্গঠন না হলে অমঙ্গল হয়ে যাবে। -এভাবেই ছোটবেলা থেকেই সমাজ নিয়ে ভাবতেন তিনি।
তখন থেকেই বই পড়ার অভ্যাস। সেইসঙ্গে অভিনয়ও করতেন মঞ্চে। ১৯৫৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান রেডিওতে শিশুদের অনুষ্ঠান ‘খেলাঘর’-এর নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। এছাড়া সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন। এরমধ্যেই দেখছিলেন আন্দোলন। স্বৈরশাসক আইয়ুবখান বিরোধী আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেন তিনিও। যোগ দেন মিছিলে, সভায়। স্লোগান দেন কিশোর সেলিম। এভাবেই বোধোদয়ের পর থেকেই আন্দোলনে জড়িয়ে যান তিনি। ওই সময়েই জীবনে প্রথমবার কারাবন্দি হন। সেলিম বলেন, স্কুলজীবনের শেষের দিকে প্রায়ই স্বৈরাচারবিরোধী মিছিলে অংশ নিতাম। সময়টা ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন। ওই সময়ে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। ওই মিছিলে পুলিশ হামলা চালায়। আমাকে তারা আটক করে নিয়ে যায়। তখনই প্রথমবার কারাবন্দি হই।
অসংখ্যবার কারাবন্দি হয়েছি। সবেচেয়ে দীর্ঘ সময় কারাগারে ছিলাম ১৯৭৮ সালে, প্রায় দুই বছর বিনাবিচারে কারাভোগ করেছি। এখানেই শেষ নয়। আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবেই পারিবারিক উপাধি ‘খান’ শব্দটি নিজের নাম থেকে বাদ দেন তিনি। ১৯৬২ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে রেডক্রসের শতবার্ষিকী উপলক্ষে আমেরিকা ভ্রমণ করেন সেলিম, সেখানেই ঘটে ঘটনাটি।
এ প্রসঙ্গে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আমি সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। ইংলিশ মিডয়ামের স্কুলটি পরিচালনা করতেন পাদ্রিরা। স্কুলের শিক্ষকরা পড়ানোর সময় কমিউনিস্টবিরোধী মতবাদ প্রকাশ করে মগজধোলাই দিতেন। এই মগজধোলাইয়ে আমার মগজ খুলে দেয়। অষ্টম-নবম শ্রেণিতে পড়াকালীনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। অষ্টম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় যখন আমেরিকায় যাই তখন সেখানকার অনেকেই জিজ্ঞেস করতেন, আমার সঙ্গে আইয়ুব খানের বংশীয় সম্পর্ক রয়েছে কি-না। এতে আমি ক্ষুব্ধ হই। স্কুলজীবন শেষে যখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হই তখন আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। ওই সময়ে নাম থেকে ‘খান’ শব্দটি বাদ দিই। ১৯৬৭ সালে সেলিম ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। রাজনীতি করেও লেখাপড়ায় মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। ১৯৭৩ সালে প্রথম বিভাগে প্রথম হন তিনি।
সমাজতন্ত্রের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, খালাতো ভাই মনজুরুল আহসান খান (সিপিবি’র সাবেক সভাপতি) রাজনীতি করতেন। একজন কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে তাকে আকৃষ্ট করতেন মনজুরুল আহসান খান। স্কুল জীবনেই তার কাছ থেকে নিয়েই পাঠ করেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। এছাড়াও এসএসসি পরীক্ষার পরপরই পাঠ করেন কার্ল মার্ক্স’র ‘ডাস ক্যাপিটাল’। এসব বই পাঠ করেই জেগে উঠে তার ভেতরের বিপ্লবী মানুষটি। এভাবেই সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যোগ দিতে প্রস্তুত হন তিনি। কলেজে পা দিয়েই সম্পৃক্ত হন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে। সহ-সাধারণ সম্পাদক থেকে ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৭২ সালে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ। ওই নিষিদ্ধ পার্টির হয়েই কাজ শুরু করেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ১৯৬৯ সালেই গণ-অভ্যুত্থানের সময় তিনি এই গোপন পার্টির সদস্যপদ লাভ করেছিলেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। বুঝতে পারছিলেন যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি। মার্চ থেকেই ছাত্রদের নিয়ে প্রস্তুতি নেন সেলিম। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের মনোটভ ককটেল, হাই এক্সপ্লোসিভ তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন। প্রশিক্ষণ দেয়া হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে অস্ত্র হাতে নিয়েই ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে প্যারেড করেন। এভাবেই সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধের অনুশীলনের নেতৃত্বে দেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ২৫শে মার্চের কালরাতে সেলিমের নেতৃত্বেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলা হয়। ভারত থেকে প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ নিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরে অপারেশন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন সেলিম। মহান মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। নিজ সংগঠন ছাড়া মুজাহিদুল ইসলাম জনপ্রিয় হয়ে উঠেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নির্বাচিত হন।
এরমধ্যেই গড়ে উঠে বাকশাল। এ প্রসঙ্গে সেলিম বলেন, অনেকেই মনে করেন বাকশালে যুক্ত হয়ে বিলীন হয়েছিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। এটি ভুল। গোপনে কমিউনিস্ট পার্টি কার্যক্রম চলছিল। এমনকি প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে নেতৃবৃন্দ বলেছিলেন, সিপিবি বিলুপ্ত হয়নি। বাকশাল গঠনের আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে সিপিবি বলেছিল, বাকশাল করবেন না।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর প্রথম মিছিল করেছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ওই দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল করেন তিনি। তারপর ওই বছরের ৪ঠা নভেম্বর সেলিমের উদ্যোগে ঢাকার রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছি। সব সময়ই সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। যখন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তখন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেও মিছিল করেছি। ছাত্রজীবন শেষে সাধারণ মানুষকে নিয়ে কাজ শুরু করেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। গ্রামে গ্রামে গিয়ে ক্ষেতমজুরদের সংগঠিত করতে থাকেন। তিনি বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সাল থেকে দীর্ঘদিন সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ২০১২ সাল থেকে তিনি সিপিবি’র সভাপতি।
এই অনিশ্চিত জীবনে কাউকে জড়ানো যায়? কিন্তু মা-বাবা পুত্রবধূ চান। ১৯৭৮ সালের নভেম্বর জেল খেটে বের হতেই বিয়ে করার চাপের মুখে পড়েন তিনি। মা-বাবাকে জানিয়ে দেন, যদি কোনো নারী তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে রাজি হন তবেই তাকে বিয়ে করবেন তিনি। এগিয়ে এলেন একজন নারী। তিনি নাসিমা সুলতানা। নাসিমা নিজেও ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করেছেন কিছুদিন। সেলিমকে চিনেন তিনি। সেলিমের প্রতি শ্রদ্ধা রয়েছে তার। ১৯৭৯ সালের ৫ই আগস্ট বিয়ে হয় সেলিম-নাসিমার। এ বিষয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, হাসি ট্টাঠার ছলে বলেছিলাম উল্টো কাবিনে বিয়ে করতে হবে। উল্টো ভরণ-পোষণ আমাকে দিতে হবে। সংসার সম্পর্কে তিনি বলেন, সংসার তিনিই দেখেন। আমি রাজনীতি নিয়েই আছি। তিনি দায়িত্বশীল নারী। ব্যস্ততার মধ্য থেকে চেষ্টা করি তাকে ভালোবাসার। সেলিম জানান, স্ত্রী নাসিমা সুলতানার বাড়ি কিশোরগঞ্জে। ঢাকার সেন্ট্রাল ওমেন্স কলেজ থেকে এইচএসসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে মাস্টার্স করেছেন তিনি। তিনি রাজস্ব বোর্ডে সহকারী কমিশনার হিসেবে চাকরি করতেন। এই দম্পতির দুই সন্তান স্বর্ণালী ইসলাম ও তৌহিদুল ইসলাম সুমন্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স, মাস্টার্স শেষে একটি ইংরেজি দৈনিকে সাংবাদিকতা করছেন সুমন্ত।
নয়া পল্টনে পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত চার তলা বাড়ি রয়েছে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের। বাড়িটি ভাড়া দেন। পরিবার নিয়ে থাকেন এ্যালিফ্যান্ট রোডের ভাড়া বাসায়। সাধারণত সকাল সাড়ে ৬টায় ঘুম থেকে উঠে ইন্টারনেট সংযুক্ত ল্যাপটপ অন করে দেশ-বিদেশের খবর পড়েন। মেইল চেক করেন। টিভিতে সংবাদ দেখেন। বাংলা গান শোনেন। তারপর দৈনিক পত্রিকা পড়েন। সকাল ৯টায় ফ্রেশ হয়ে, নাস্তা সেরে অফিসমুখো হন। অফিসের রুটিন অনুসারে কাজ করেন। নেতাদের সঙ্গে আলোচনা, কর্মসূচি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত তৎপরতা। এরমধ্যে পত্রিকার জন্য কলাম লিখেন, প্রুফ দেখেন। বেলা ৩টায় বাসায় দুপুরের খাবার খান। বিকালে দলীয় কর্মসূচি, রাতে টকশো, বইপড়া এভাবেই সময় কাটে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের। এরমধ্যেই পরিবারকে সময় দেয়ার চেষ্টা করেন। মাসিক বাজার করেন তিনি। প্রতি মাসের শুরুর দিকে অফিস থেকে ফেরার পথে মৎস্য অধিদপ্তরের সামনে থেকে মাছ কিনে নেন। ওষুধ, চাল, ডাল সবই কেনা হয়। এরমধ্যে নয়া পল্টনের বাসায় ভাড়া উত্তোলন ও তদারকি করেন। বয়স বাড়ছে। রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে। ডায়াবেটিস ও হার্টের অসুখ রয়েছে। প্রতিরাতে ইনসুলিন নেন তিনি।
‘রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ’, ‘মার্কসবাদ একটি চিরায়ত দর্শন’, ‘বিকল্পের কোনো বিকল্প নেই’সহ বিভিন্ন গ্রন্থ রয়েছে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে কি স্বপ্ন দেখেন তিনি? জানতে চাইলে সেলিম বলেন, স্বপ্ন দেখি শ্রেণি-বৈষ্যমহীন সমাজের। এটি বাস্তবায়ন হবেই। হওয়া অপরিহার্য। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সমাজতন্ত্রের দিকেই সমাজ ব্যবস্থা ধাবিত হচ্ছে। গতিমুখ স্পষ্ট। কতদিন লাগবে জানি না। সভ্যতা কমিউনিজমের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আরো দৃঢ় হবে। একদিন মানুষের জয় হবে বলেই বিশ্বাস করেন কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের জন্ম এক অস্থির সময়ে। পাকিস্তান জন্মের এক বছর পরে। ১৯৪৮ সালের ১৬ই এপ্রিল ঢাকার অদূরে সাভারে। বাবা মোসলেহ উদ্দিন খান ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা আর মা উম্মে হানী খানম ছিলেন নারীনেত্রী। ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫৭ সালে ভর্তি হন সেন্ট গ্রেগরি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে। তখন থেকেই শিক্ষা বৈষম্যটি তার চিন্তায় স্থান পায়।
শিশু বয়সে স্বপ্ন দেখতেন বিজ্ঞানী হবেন। আর তাইতো মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, শৈশবে ভাবতাম মানুষের জন্য বিশেষ কিছু আবিষ্কার করবো। বিশেষ কোনো যন্ত্র, যা মানুষের জীবন-যাপনকে উন্নত করবে, যা এক ব্যক্তি পরিচালনা করে ১০০ জনের কাজ করবে একাই। কিন্তু ভাবতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো তাহলে তো ৯৯ জন বেকার হয়ে যাবে। প্রযুক্তির সঙ্গে
সমাজ ব্যবস্থার পুনর্গঠন না হলে অমঙ্গল হয়ে যাবে। -এভাবেই ছোটবেলা থেকেই সমাজ নিয়ে ভাবতেন তিনি।
তখন থেকেই বই পড়ার অভ্যাস। সেইসঙ্গে অভিনয়ও করতেন মঞ্চে। ১৯৫৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান রেডিওতে শিশুদের অনুষ্ঠান ‘খেলাঘর’-এর নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। এছাড়া সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন। এরমধ্যেই দেখছিলেন আন্দোলন। স্বৈরশাসক আইয়ুবখান বিরোধী আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেন তিনিও। যোগ দেন মিছিলে, সভায়। স্লোগান দেন কিশোর সেলিম। এভাবেই বোধোদয়ের পর থেকেই আন্দোলনে জড়িয়ে যান তিনি। ওই সময়েই জীবনে প্রথমবার কারাবন্দি হন। সেলিম বলেন, স্কুলজীবনের শেষের দিকে প্রায়ই স্বৈরাচারবিরোধী মিছিলে অংশ নিতাম। সময়টা ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন। ওই সময়ে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। ওই মিছিলে পুলিশ হামলা চালায়। আমাকে তারা আটক করে নিয়ে যায়। তখনই প্রথমবার কারাবন্দি হই।
অসংখ্যবার কারাবন্দি হয়েছি। সবেচেয়ে দীর্ঘ সময় কারাগারে ছিলাম ১৯৭৮ সালে, প্রায় দুই বছর বিনাবিচারে কারাভোগ করেছি। এখানেই শেষ নয়। আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবেই পারিবারিক উপাধি ‘খান’ শব্দটি নিজের নাম থেকে বাদ দেন তিনি। ১৯৬২ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে রেডক্রসের শতবার্ষিকী উপলক্ষে আমেরিকা ভ্রমণ করেন সেলিম, সেখানেই ঘটে ঘটনাটি।
এ প্রসঙ্গে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আমি সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। ইংলিশ মিডয়ামের স্কুলটি পরিচালনা করতেন পাদ্রিরা। স্কুলের শিক্ষকরা পড়ানোর সময় কমিউনিস্টবিরোধী মতবাদ প্রকাশ করে মগজধোলাই দিতেন। এই মগজধোলাইয়ে আমার মগজ খুলে দেয়। অষ্টম-নবম শ্রেণিতে পড়াকালীনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। অষ্টম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় যখন আমেরিকায় যাই তখন সেখানকার অনেকেই জিজ্ঞেস করতেন, আমার সঙ্গে আইয়ুব খানের বংশীয় সম্পর্ক রয়েছে কি-না। এতে আমি ক্ষুব্ধ হই। স্কুলজীবন শেষে যখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হই তখন আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। ওই সময়ে নাম থেকে ‘খান’ শব্দটি বাদ দিই। ১৯৬৭ সালে সেলিম ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। রাজনীতি করেও লেখাপড়ায় মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। ১৯৭৩ সালে প্রথম বিভাগে প্রথম হন তিনি।
সমাজতন্ত্রের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, খালাতো ভাই মনজুরুল আহসান খান (সিপিবি’র সাবেক সভাপতি) রাজনীতি করতেন। একজন কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে তাকে আকৃষ্ট করতেন মনজুরুল আহসান খান। স্কুল জীবনেই তার কাছ থেকে নিয়েই পাঠ করেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। এছাড়াও এসএসসি পরীক্ষার পরপরই পাঠ করেন কার্ল মার্ক্স’র ‘ডাস ক্যাপিটাল’। এসব বই পাঠ করেই জেগে উঠে তার ভেতরের বিপ্লবী মানুষটি। এভাবেই সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যোগ দিতে প্রস্তুত হন তিনি। কলেজে পা দিয়েই সম্পৃক্ত হন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে। সহ-সাধারণ সম্পাদক থেকে ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৭২ সালে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ। ওই নিষিদ্ধ পার্টির হয়েই কাজ শুরু করেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ১৯৬৯ সালেই গণ-অভ্যুত্থানের সময় তিনি এই গোপন পার্টির সদস্যপদ লাভ করেছিলেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। বুঝতে পারছিলেন যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি। মার্চ থেকেই ছাত্রদের নিয়ে প্রস্তুতি নেন সেলিম। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের মনোটভ ককটেল, হাই এক্সপ্লোসিভ তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন। প্রশিক্ষণ দেয়া হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে অস্ত্র হাতে নিয়েই ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে প্যারেড করেন। এভাবেই সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধের অনুশীলনের নেতৃত্বে দেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ২৫শে মার্চের কালরাতে সেলিমের নেতৃত্বেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলা হয়। ভারত থেকে প্রথম ব্যাচে প্রশিক্ষণ নিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরে অপারেশন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন সেলিম। মহান মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। নিজ সংগঠন ছাড়া মুজাহিদুল ইসলাম জনপ্রিয় হয়ে উঠেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নির্বাচিত হন।
এরমধ্যেই গড়ে উঠে বাকশাল। এ প্রসঙ্গে সেলিম বলেন, অনেকেই মনে করেন বাকশালে যুক্ত হয়ে বিলীন হয়েছিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। এটি ভুল। গোপনে কমিউনিস্ট পার্টি কার্যক্রম চলছিল। এমনকি প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে নেতৃবৃন্দ বলেছিলেন, সিপিবি বিলুপ্ত হয়নি। বাকশাল গঠনের আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে সিপিবি বলেছিল, বাকশাল করবেন না।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর প্রথম মিছিল করেছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ওই দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল করেন তিনি। তারপর ওই বছরের ৪ঠা নভেম্বর সেলিমের উদ্যোগে ঢাকার রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছি। সব সময়ই সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। যখন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তখন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেও মিছিল করেছি। ছাত্রজীবন শেষে সাধারণ মানুষকে নিয়ে কাজ শুরু করেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। গ্রামে গ্রামে গিয়ে ক্ষেতমজুরদের সংগঠিত করতে থাকেন। তিনি বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সাল থেকে দীর্ঘদিন সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ২০১২ সাল থেকে তিনি সিপিবি’র সভাপতি।
এই অনিশ্চিত জীবনে কাউকে জড়ানো যায়? কিন্তু মা-বাবা পুত্রবধূ চান। ১৯৭৮ সালের নভেম্বর জেল খেটে বের হতেই বিয়ে করার চাপের মুখে পড়েন তিনি। মা-বাবাকে জানিয়ে দেন, যদি কোনো নারী তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে রাজি হন তবেই তাকে বিয়ে করবেন তিনি। এগিয়ে এলেন একজন নারী। তিনি নাসিমা সুলতানা। নাসিমা নিজেও ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করেছেন কিছুদিন। সেলিমকে চিনেন তিনি। সেলিমের প্রতি শ্রদ্ধা রয়েছে তার। ১৯৭৯ সালের ৫ই আগস্ট বিয়ে হয় সেলিম-নাসিমার। এ বিষয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, হাসি ট্টাঠার ছলে বলেছিলাম উল্টো কাবিনে বিয়ে করতে হবে। উল্টো ভরণ-পোষণ আমাকে দিতে হবে। সংসার সম্পর্কে তিনি বলেন, সংসার তিনিই দেখেন। আমি রাজনীতি নিয়েই আছি। তিনি দায়িত্বশীল নারী। ব্যস্ততার মধ্য থেকে চেষ্টা করি তাকে ভালোবাসার। সেলিম জানান, স্ত্রী নাসিমা সুলতানার বাড়ি কিশোরগঞ্জে। ঢাকার সেন্ট্রাল ওমেন্স কলেজ থেকে এইচএসসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে মাস্টার্স করেছেন তিনি। তিনি রাজস্ব বোর্ডে সহকারী কমিশনার হিসেবে চাকরি করতেন। এই দম্পতির দুই সন্তান স্বর্ণালী ইসলাম ও তৌহিদুল ইসলাম সুমন্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স, মাস্টার্স শেষে একটি ইংরেজি দৈনিকে সাংবাদিকতা করছেন সুমন্ত।
নয়া পল্টনে পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত চার তলা বাড়ি রয়েছে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের। বাড়িটি ভাড়া দেন। পরিবার নিয়ে থাকেন এ্যালিফ্যান্ট রোডের ভাড়া বাসায়। সাধারণত সকাল সাড়ে ৬টায় ঘুম থেকে উঠে ইন্টারনেট সংযুক্ত ল্যাপটপ অন করে দেশ-বিদেশের খবর পড়েন। মেইল চেক করেন। টিভিতে সংবাদ দেখেন। বাংলা গান শোনেন। তারপর দৈনিক পত্রিকা পড়েন। সকাল ৯টায় ফ্রেশ হয়ে, নাস্তা সেরে অফিসমুখো হন। অফিসের রুটিন অনুসারে কাজ করেন। নেতাদের সঙ্গে আলোচনা, কর্মসূচি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত তৎপরতা। এরমধ্যে পত্রিকার জন্য কলাম লিখেন, প্রুফ দেখেন। বেলা ৩টায় বাসায় দুপুরের খাবার খান। বিকালে দলীয় কর্মসূচি, রাতে টকশো, বইপড়া এভাবেই সময় কাটে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের। এরমধ্যেই পরিবারকে সময় দেয়ার চেষ্টা করেন। মাসিক বাজার করেন তিনি। প্রতি মাসের শুরুর দিকে অফিস থেকে ফেরার পথে মৎস্য অধিদপ্তরের সামনে থেকে মাছ কিনে নেন। ওষুধ, চাল, ডাল সবই কেনা হয়। এরমধ্যে নয়া পল্টনের বাসায় ভাড়া উত্তোলন ও তদারকি করেন। বয়স বাড়ছে। রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে। ডায়াবেটিস ও হার্টের অসুখ রয়েছে। প্রতিরাতে ইনসুলিন নেন তিনি।
‘রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ’, ‘মার্কসবাদ একটি চিরায়ত দর্শন’, ‘বিকল্পের কোনো বিকল্প নেই’সহ বিভিন্ন গ্রন্থ রয়েছে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে কি স্বপ্ন দেখেন তিনি? জানতে চাইলে সেলিম বলেন, স্বপ্ন দেখি শ্রেণি-বৈষ্যমহীন সমাজের। এটি বাস্তবায়ন হবেই। হওয়া অপরিহার্য। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সমাজতন্ত্রের দিকেই সমাজ ব্যবস্থা ধাবিত হচ্ছে। গতিমুখ স্পষ্ট। কতদিন লাগবে জানি না। সভ্যতা কমিউনিজমের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আরো দৃঢ় হবে। একদিন মানুষের জয় হবে বলেই বিশ্বাস করেন কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।