বিনোদন

আজম খান এবং কিছু অপ্রিয় সত্য

লতিফুল ইসলাম শিবলী

৪ মার্চ ২০১৬, শুক্রবার, ৩:৫২ পূর্বাহ্ন

নব্বইয়ের দশক জুড়ে আমরা একটা আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটাতাম, এই বুঝি আজম ভাই মারা যাচ্ছেন। ঠিক ওই সময়টায় চলছিল মিক্সড অ্যালবাম বানানোর হিড়িক। আর ক্যাসেট ব্যবসার চরম রমরমা অবস্থা। আমাকে তখন বলা হতো আজম ভাইয়ের জন্য গান লিখতে হবে আর গানের বিষয়টাও নির্ধারণ করে দেয়া হতো। অর্থাৎ গান লিখতে হবে ‘মরে যাবো’, ‘শেষদিন’, ‘বাঁচবো না’, ‘এই গান শেষ গান’, ‘আর গাইবো না গান’ এ জাতীয় কথামালা দিয়ে। আমি জিজ্ঞাস করতাম, কেন? এসব কথা দিয়ে গান লিখতে হবে কেন? তখন বলা হতো, যে কোনো দিন আজম ভাই মারা যেতে পারেন, আর উনি মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ জাতীয় গান সুপার হিট হয়ে যাবে, মিডিয়ায় তার মৃত্যুর খবর প্রচার হতে থাকবে আর এ গান বাজতে থাকবে। কি ভয়ংকর! আজম ভাই কোনো দিন জানতেও পারেননি সম্মুখে গুরু গুরু বলে মুখে ফেনা তোলা একদল মানুষ তার পেছনে পেছনে তৈরি করে যাচ্ছে তার মৃত্যুযাত্রার চিত্রনাট্য।
ব্যবসার জ্ঞান আমার কোনোকালেই ছিল না। তাই এ জাতীয় কথার অর্থ আমি তখন অত বুঝতাম না। শুধু এতটুকু বুঝতাম এ কাজটা ঠিক হচ্ছে না। স্রেফ কিছু টাকার জন্য এ রকম ফরমায়েশি ৮-১০টা গান আমি আজম ভাইয়ের জন্য লিখেছিলাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও লেখা এসব গানের আমি কোনো খবর রাখিনি। তখন আমার ছিল বোহেমিয়ান জীবন, কোনো কিছু লিখে সংরক্ষণ করে রাখার মতো ডিসিপ্লিনড মানুষ আমি কোনো কালেই ছিলাম না। এসব কারণে আমার লেখা গান অন্যরা নিজের নামে চালিয়েছে- এমন নজির আছে বেশ। আজ শুধু আমার লেখা আজম ভাইয়ের গাওয়া তিনটি গানের কথা আমি বলতে পারি- (১) যতদূর যত পথ (২) জীবনের এই শেষ কটা দিন তোমারই কাছে যেন থাকতে পারি (৩) সে যে বেলকনিতে রোদে বসে চুল শুকাতো।
দিন যায় মাস যায় বছর যায়। আজম ভাইয়ের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীগুলো আসে-যায়, আর আমি এক ধরনের অপরাধবোধ নিয়ে থাকি। এমনকি আজ পর্যন্ত তাকে নিয়ে ফেসবুকে আমি কোনো স্ট্যাটাস পর্যন্ত লিখিনি।
আমি পেয়েছি আজম ভাইয়ের জীবনের নব্বই দশকটি। সেই সময়টা উনি নিজের জীবনের ব্যাপারে অনেক বেশি বিশৃঙ্খল আর উদাসীন ছিলেন। কাউকে কাউকে দেখেছি স্রেফ নামমাত্র কিছু টাকা দিয়ে উনাকে দিয়ে গান গাইয়ে নিতে। বোঝা যেত খুব অভাবে দিন কাটছিল উনার। সেই সুযোগে যে যেভাবে পেরেছে আজম ভাইকে ব্যবহার করেছে। সিনেমায়, বিজ্ঞাপনে, মঞ্চে, অত্যন্ত হাস্যস্পদ করে তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে, মাইকেল জ্যাকসন সাজিয়ে ভাঁড়ামি করানো হয়েছে। আপাদমস্তক শিশুর সারল্যে ভরা অকৃত্রিম একজন মানুষ ছিলেন তিনি। ভালোবাসা, স্নেহের সুযোগ নিয়ে যে যেভাবে বুঝিয়েছে উনি সরল মনে তাই করেছেন। আজম ভাই কখনোই ভাবেননি তাকে যা করতে বলা হচ্ছে সেটা তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় কি না। আজ ভাবলে কষ্ট হয়, আমরা আমাদের সময়ে একজন লিজেন্ডকে পেয়েছিলাম যাকে কিছু মানুষ নিজেদের লোভ আর স্বার্থে সস্তা করে তুলেছিল। যে দেশে সকাল-বিকাল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বিক্রি করা হয় সে দেশের একজন ফ্রন্টলাইন ফ্রিডম ফাইটার আজম খান কখনোই নিজের সেই পরিচয়কে ব্যবহার করে কোনো ফায়দা লুটেননি। প্রমাণ তার পুরোটা জীবন। বিনয়ী আজম ভাইয়ের মুক্তিযুদ্ধের গল্প আমরা তার মুখ থেকে শুনিনি, শুনেছি দুই নম্বর সেক্টরের তার সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে, ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ আর ‘অপারেশন তিতাসের’ যোদ্ধাদের জীবনী থেকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের তারুণ্যের দ্রোহ আর ভালোবাসার প্রকাশ সংগীতের একটি নতুন ধারার মধ্য দিয়ে, নতুন ভাষায়, জীবন আর বাস্তবতাকে উপজীব্য করে যিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তার ভাগ্যে জোটেনি কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। আজ মনে হয় আজম ভাইদের মতো গুণীদের বোঝার মতো স্মার্ট এখনও হয়ে ওঠেনি এই রাষ্ট্র। আজম ভাইয়ের পুরো জীবনটাই বলে দেয় তার মতো মানুষেরা জন্মেছিল দেশকে দেয়ার জন্য, দেশের থেকে নেয়ার জন্য নয়।
প্রকৃত মানুষ যতই উচ্চতায় উঠতে থাকে ততই আভূমি নুয়ে থাকে তার মাথা। আজম ভাইয়ের জীবন থেকে এ দেশের ‘বড় শিল্পীরা’ আর ‘বড় মুক্তিযোদ্ধারা’ আর কিছু না হোক ‘বিনয়’ শিখতে পারে।
জীবনের শেষ অধ্যায় এসে আজম ভাই অনেক ডিসিপ্লিনড ছিলেন, নতজানু ছিলেন আল্লাহতালার প্রতি। আমি দেশে ফেরার পর একদিন ফোনে কথা হয়েছিল, তিনি অভিমান নিয়ে বলেছিলেন, ‘শিবলী তুমি আমারে দেখতে আইলা না’। আজম ভাইয়ের এই শেষ বাক্যটি সারা জীবন আমার কানে বাজতে থাকবে। আমি আসছি আসবো বলেও আর যাওয়া হয়নি। প্রিয় আজম ভাই মহান আল্লাহতায়লা আপনাকে জান্নাতবাসী করুন।
এ দেশে যে যত বড় গুরু বস অথবা ওস্তাদ হয়ে উঠুক না কেন, এ দেশে ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাস শুরু হবে আজম খান থেকে, যা কিছু ঘটেছে সব মধ্যবর্তী সময়ে আর সেই ইতিহাসকে শেষ হতে হবে আজম খান দিয়ে।
লেখক: গীতিকবি ও চিত্রনাট্যকার
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status