প্রথম পাতা

পরিবহন ধর্মঘটের ডাক

নূরে আলম জিকু

৫ নভেম্বর ২০২১, শুক্রবার, ৯:২৭ অপরাহ্ন

ফাইল ছবি

দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বগতির দিকে। এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। হঠাৎ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় জনজীবনে দেখা দিয়েছে নানা শঙ্কা। দাম বাড়ার একদিনের মাথায় প্রভাব পড়েছে পরিবহন খাতে। গণপরিবহনে আদায় হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। এ নিয়ে যাত্রী ও বাস স্টাফদের মধ্যে ঘটছে বাকবিতণ্ডা। ঘোষণার আগে গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া নিয়ে ক্ষুব্ধ যাত্রীরা। এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ক্ষুব্ধ পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টরাও। ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য প্রতি লিটার ১৫ টাকা বৃদ্ধির প্রতিবাদে আজ থেকে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য গণপরিবহন ও পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংগঠনটি। গণপরিবহনের কেন্দ্রীয় সংগঠনগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মঘটের ঘোষণা না দিলেও বাস বন্ধ রাখার পক্ষে সায় দিয়েছেন নেতারা। গণপরিরহনের নেতারা বলছেন, সরকার তেলের দাম না কমালে ধর্মঘটে যাবেন তারা। এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর পরিবহন খাতের বিভিন্ন সংগঠনের মালিক-শ্রমিকরা গতকাল বৈঠক করেছেন। অনেকেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বাস ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। অধিকাংশ সংগঠনের নেতারা সরকারপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেও সরকার ভাড়া বৃদ্ধি না করা পর্যন্ত পরিবহন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে একটি অংশ বলছেন, ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে সংগঠনের নেতাকর্মীরা বৈঠক করবেন। বিআরটিএ ভাড়া সমন্বয়ে রাজি হলে রাজধানীসহ সারা দেশে গণপরিবহন আগের মতোই চলবে। অন্যথায় গণপরিবহনের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভার ইউনিয়ন জানিয়েছে, হঠাৎ বেড়ে যাওয়া জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার না হলে আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে যাবেন তারা। তেলের দাম বৃদ্ধির প্রথমদিনে অধিকাংশ পরিবহন আগের ভাড়াই নিয়েছেন। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছেন শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, পূর্ব কোনো ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ ডিজেল ও কেরোসিনের লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়ায় জনজীবনে এর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে পরিবহন, কৃষি ও বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বাড়বে। সাধারণ মানুষের আয়ের ওপর এটা ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। করোনায় অর্থনৈতিকভাবে দেশের মানুষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এর মাঝে ডিজেল ও কেরোসিনের নতুন দাম নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষদের নতুন করে চাপে ফেলবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনো ঘোষণা কিংবা সরকারি নির্দেশনা ছাড়াই বাড়তি ভাড়া আদায় করায় দিনভর বাসে ও কাউন্টারে যাত্রীদের সঙ্গে বাস কন্ডাক্টরদের বাকবিতণ্ডা, ঝগড়া ও হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। হঠাৎ ভাড়া বাড়ানো নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক যাত্রী। বাস স্টাফরা তাদের ইচ্ছামতো ভাড়া নির্ধারণ করেছেন। এতে বিপাকে পড়েছেন যাত্রীরা। বাস স্টাফরা বলছেন, সরকার তেলের দাম বাড়িয়েছে। এতে আগের চেয়ে আমাদের খরচ বেড়েছে। বাড়তি খরচ মেটাতে বাড়তি ভাড়া নেয়া হচ্ছে। গতকাল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে সরকারি নির্দেশনা ছাড়াই জনপ্রতি ১৪ টাকা বেশি আদা করেছে পরিবহনগুলো। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বন্ধন ও উৎসব পরিবহনের মালিকরা ৩৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা করে ভাড়া আদায় করেছেন। এছাড়া শীতল পরিবহনে ৫৫ টাকার ভাড়ার বিপরীতে ৬৫ টাকা আদায় করা হয়েছে। যদিও একই রুটের অন্যান্য পরিবহনে আগের ভাড়াতেই যাত্রীরা যাতায়াত করছেন। এছাড়া তেলের বিপরীতে এসব বাস গ্যাসে চলাচল করে।
যাত্রীরা জানান, ডিজেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছেন বাসমালিকরা। এতে অনেককেই বাড়তি ভাড়া নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে। এ নিয়ে যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া দিতে অস্বীকার করলে তাদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। প্রকাশ্যে বাড়তি ভাড়া নিলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বাড়তি ভাড়া আদায় করা পরিবহনের স্টাফরা বলছেন, মালিক পক্ষ ভাড়তি ভাড়া আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তেলের দাম মেটাতে নেয়া হচ্ছে এই বাড়তি ভাড়া।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির একাধিক কর্মকতা জানান, সরাসরি সংগঠন থেকে গণপরিবহন বন্ধের কোনো ঘোষণা না থাকলেও অনেকেই আজ থেকে বাস বন্ধ রাখবেন। তেলের দাম বাড়ায় খরচ মেটাতে বাড়তি ভাড়া কার্যকর না করা পর্যন্ত ঢাকায় বাসের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে। হয়তো তেলের দাম আগের দামে রাখুন, নয়তো ভাড়া বৃদ্ধি করতে হবে।
ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ট্যাঙ্কলরি, প্রাইম মুভার মালিক-শ্রমিক ঐক্যপরিষদ সংগঠনের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান মানবজমিনকে বলেন, হঠাৎ কোনো ঘোষণা ছাড়াই তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এই বাড়তি দামে তেল কিনে মালিক-শ্রমিকরা ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ট্যাঙ্কলরি চালাতে চাচ্ছেন না। এতে তারা ক্ষতির সম্মূখীন হবেন। আমরা কেউ লোকসান কিংবা ক্ষতি মাথায় নিয়ে মালবাহী যানবাহন চালাতে পারি না। তাই আমরা চাচ্ছি রাতের আঁধারে যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে তার একটা সমাধান করা হোক। অন্যথায় পণ্য ও যাত্রী ভাড়া বাড়ানো হোক। আমাদের দাবি না মানা পর্যন্ত শুক্রবার সকাল থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করবো। ইতিমধ্যে জেলার সংগঠনগুলোও আমাদের সঙ্গে ধর্মঘট পালনের প্রস্তুতি নিয়েছে।
বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী মানবজমিনকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় প্রতিটি লঞ্চে টিপ প্রতি ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বাড়তি খরচ বেড়েছে। প্রতি ব্যারেল তেলের দাম বেড়েছে ৩ হাজার টাকা। হঠাৎ তেলের দাম বাড়ায় লঞ্চ মালিকরা বিপাকে পড়েছেন। বাড়তি খরচ নিয়ে লঞ্চ চালানো কষ্টকর। এ নিয়ে আজ বিকালে পল্টনে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মিটিংয়ের কথা রয়েছে। সেখানে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সরকার লঞ্চের ভাড়া না বাড়ালে আমরা পরবর্তীতে অবস্থানুযায়ী পদক্ষেপ নিবো।
বাসমালিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, তেলের দাম বেড়েছে। তবে আমরা বিআরটিএতে ভাড়া বাড়ানোর জন্য চিঠি দিয়ে বলেছি, বাস মালিক বর্তমান ভাড়ায় বাস চালাতে চাচ্ছে না। বিআরটিএ’র সঙ্গে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে আলাপ চলছে। আমরা পরিবহন বন্ধ কিংবা ধর্মঘটে যাচ্ছি না। অন্যান্য সংগঠনগুলো তাদের মতো করে তারা করছে। তাদের সঙ্গে আমাদের কেউ সম্পৃক্ত নেই।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান বলেন, দীর্ঘ আট বছর ধরে গণপরিবহনে কোনো ভাড়া বাড়ানো হয়নি। অথচ বৃহস্পতিবার থেকে এক লাফে ২৩ শতাংশ জ্বালানি তেলের দাম  বেড়েছে। এতে মালিকদের পক্ষে পরিবহন পরিচালনা কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সারা দেশের পরিবহন মালিকদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে  পরিবহন খাতে মালিক শ্রমিক সম্পর্ক সর্বদাই ঐক্যমতের  একাত্মতা থাকবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, হঠাৎ করে তেলের দাম বাড়ানো সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এটা অনেকটা আগুনের মধ্যে ঘি ঢেলে দেয়ার মতো অবস্থা। করোনার এই বিপর্যয়ের মধ্যে  তেলের দাম বাড়িয়ে মানুষের দুঃখ-কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনিতেই বাজারে সব কিছুর দাম আকাশচুম্বী অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন আবার এমন সিদ্ধান্তের কারণে মানুষের জীবনযাত্রার বিপর্যয় ঘটবে। যারা দেশের মানুষের জন্য কাজ করেন, কিংবা জনগণের কথা ভাবেন, তাদের উচিত এমন পরিস্থিতিতে তেলের দাম কমিয়ে আগের দামে রাখা। অন্যথায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। এছাড়া একটা শ্রেণি সুযোগ বুঝে আগেই গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে। সরকার কোনো ভাড়া নির্ধারণ করে না দিলেও তারা নিজেদের ইচ্ছামতো আদায় করছে। সরকারের এ বিষয়ে নজরদারি করা উচিত।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status