শেষের পাতা

এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে রপ্তানি কমতে পারে ২১ হাজার কোটি টাকা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

১ মার্চ ২০২১, সোমবার, ৯:১৮ অপরাহ্ন

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা
প্রত্যাহার করা হলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৮ থেকে ১০ শতাংশ কমতে পারে। এতে বছরে প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রপ্তানি আয় কমবে। বর্তমান বাজার দরে টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে রোববার ভার্চ্যুয়াল সভায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় এই তথ্য দেন তিনি।
উত্তরণের পর প্রস্তুতি পর্বে বাংলাদেশের করণীয় কী, তা জানাতে সাংবাদিকদের সঙ্গে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন ড. দেবপ্রিয়। এ সময় এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর আগামীতে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন তিনি।
ড. দেবপ্রিয় বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর প্রস্তুতি পর্বে একটি ‘উত্তরণকালীন কৌশলপত্র’ প্রণয়নের তাগিদ দেন। একই সঙ্গে তিনি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণে বেশি গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানান।
তিনি জানান, এলডিসি থেকে উত্তরণের পরপর ক্রমান্বয়ে বাণিজ্য সুবিধাগুলো হারাবে বাংলাদেশ। যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে উত্তরণের পরও বাড়তি তিন বছর শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা থাকবে। গত শুক্রবার রাতে জাতিসংঘের কমিটি ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে যাবে। এর আগে গত শনিবার এই খুশির খবর এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিকে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ স্বীকৃতি পেলেও উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেতে বাংলাদেশকে ৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
আলাপচারিতায় ড. দেবপ্রিয় বলেন, এ দেশে আলোচনাগুলো বেখাপ্পা মনে হয়। বিদেশ থেকে কীভাবে বেশি সাহায্য-সহায়তা পাবো- এ নিয়েই বেশি আলোচনা হয়। কিন্তু কোন কোন সমস্যার কারণে এই সাহায্য নিতে হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা বেশি হয় না। সমস্যাগুলোর সমাধানে বেশি মনোযোগী হই না। ড. দেবপ্রিয় বলেন, এলডিসি থেকে বের হলে রপ্তানি খাতের নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি নিয়েও বেশ আলোচনা হয়। অন্য প্রভাবের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় একধরনের অনীহা আছে। তার মতে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর মেধাস্বত্ব সংক্রান্ত শর্ত আরো কড়াকড়ি হবে। কৃষি খাতে ভর্তুকি আরো স্বচ্ছ ও সীমিত হতে হবে। নতুন শিল্পকে প্রণোদনা দেয়ার শর্ত কঠিন হবে।
অন্য দেশের কাছ থেকে বেশি সুবিধা আনার মানসিকতা বদলে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ভিত্তি আরো শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছেন দেবপ্রিয়। দাঁড়াতে হবে নিজেদের পায়ে। যদি বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাই, তাহলে ভুল হবে। বিশেষ সুবিধাকে বাড়তি পাওনা হিসেবে দেখতে হবে।
এ জন্য দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ৩টি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এগুলো হলো- ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়াতে পরিবেশ সৃষ্টি করা, কর আহরণ বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি। এ ছাড়া এলডিসি থেকে মসৃণ উত্তরণের জন্য একটি উত্তরণকালীন কৌশলপত্র তৈরির সুপারিশও করেন দেবপ্রিয়।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, জাতিসংঘ বলেছে, উত্তরণ-পরবর্তী বাংলাদেশের সামনে সম্ভাবনা আছে। এ জন্য ৫টি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলেছে তারা। এগুলো হলো- অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, রপ্তানিযোগ্য পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়ন ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন থেকে বের হয়ে আসা। তিনি বলেন, এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী যে কৌশলপত্র তৈরি করা হবে তাতে উল্লিখিত বিষয় যুক্ত করতে হবে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ভুটান এরই মধ্যে কৌশল তৈরি করেছে জানিয়ে ড. দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশের তো কৌশলপত্রের অভাব নেই। এসবের মধ্যেও এলডিসি উত্তরণকালীন কৌশল কীভাবে তৈরি করা যায়, তা এখন থেকে ভাবতে হবে।
এই কৌশলপত্র তৈরিতে ২০১৬ সালে গঠন করা জাতীয় টাস্কফোর্সকে দায়িত্ব দেয়ার প্রস্তাব করে তিনি জানান, টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করতে হবে। এতে বাণিজ্য, ইআরডি, পরিকল্পনা কমিশন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করে পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।
তবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর তা ধরে রাখতে সঠিক এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কি হবে, সেই পদক্ষেপ আগেই নিতে হবে। এ জন্য বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। তিনি জানান, প্রথমটি, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ সংগ্রহ করতে হবে। কর আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে এ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হিসেবে ধরতে হবে এবং প্রতিবছর কি পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে, তার সুষ্ঠু পরিসংখ্যান থাকতে হবে। তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত, অর্থনীতির বহুমুখীকরণ আর পঞ্চম পরামর্শ, টেকসই আর পরিবেশবান্ধব জ্বালানি নিশ্চিত করা। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে পরামর্শ দিয়েছেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হলে আন্তর্জাতিক আর্থিকখাতে আস্থা ফিরে পাবে বাংলাদেশ। বাড়বে বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিকভাবে মানদণ্ড দেবে বাংলাদেশকে। নিরবচ্ছিন্ন বিদেশি ঋণ পাবে বাংলাদেশ। সঙ্গে রেমিট্যান্সের পরিমাণও বাড়বে। তবে ইউরোপ আর কানাডায় পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধাবঞ্চিত হবে দেশ। তবে শুল্কমুক্ত সুবিধা ২০৩১ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর বৃটেন দেবে বাংলাদেশকে।
বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক কিংবা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণ কাঠামো পরিবর্তিত হবে বাংলাদেশের জন্য। জলবায়ু পরিবর্তনেও তহবিল পাবে না বাংলাদেশ। ৭ বছরের মধ্যে ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিতে বিশেষ সুবিধা হারাতে হবে। ওষুধ রপ্তানিতে গুনতে হবে অতিরিক্ত অর্থ। তবে অব্যাহত থাকবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সুবিধা আর মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status