শেষের পাতা

গণধর্ষণের নেপথ্যে

ড. মাহফুজ পারভেজ

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, সোমবার, ৯:৩৮ পূর্বাহ্ন

একটি মাত্র কারণে এতো বড় ও নৃশংস অপরাধ ঘটেনি। নেপথ্যে রয়েছে আরো অনেক কার্যকারণ। সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে পালাক্রমে গণধর্ষণের ঘটনাটি আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও অপরাধমূলক অনেকগুলো কারণের ফলে সৃষ্ট একটি নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
অপরাধটি মোটেও বিচ্ছিন্ন নয়। কিংবা সিলেটে ঘটেছে এমনও নয়। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই ধর্ষণ, গণধর্ষণের মতো অপরাধ প্রায় প্রতিদিনই সংঘটিত হচ্ছে। ধর্ষিতা হিসেবে যেমন শিশু, কিশোর, বয়েসী মহিলাকে ভিকটিম হতে দেখা যাচ্ছে, ধর্ষক হিসেবেও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন বয়স ও পেশার লোকজনকে। চাঞ্চল্যকর গণধর্ষণের অপরাধীচক্র কতো পাওয়ারফুল ছিল, সেটা তো ঘটনার ধারাক্রম থেকেই প্রমাণ হয়। প্রকাশ্যে গাড়ির ভেতরে গণধর্ষণ করলো তারা। একজন দুইজন নয়, আট দশজন শহরের কেন্দ্রস্থলের একটি প্রতিষ্ঠানে স্বামীকে আটক করে নির্ভয়ে ও পালাক্রমে গণধর্ষণের বর্বর উল্লাস করলো, কেউ কিছুই বলার সাহস পেলো।
অপরাধীদের ক্ষমতার গভীরতা টের পাওয়া যায় মিডিয়ায় প্রকাশিত অধ্যাপক সালেহ আহমেদ, অধ্যক্ষ, এমসি কলেজ-এর বক্তব্যে: ‘আপনি সারা বাংলাদেশের অবস্থা দেখছেন, আমাদের সমাজের অবস্থা দেখছেন। আমরা কী করতে পারি বলেন। আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা। এগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিষয়, অনেক কিছু আছে যেগুলো বিচারিক আদালতের বিষয়, যেটা সরকারের বিষয়, সরকারি যে বিভিন্ন সংস্থা আছে তাদের বিষয়।  আপনি আমার দিকটাও বোঝেন, আমার কী সীমাবদ্ধতা, আমি কতোটা অসহায়। একটা কলেজের অধ্যক্ষকে ধরে পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে আপনার মাধ্যমেই আমরা খবর পাই, টিভিতে দেখি। আমাদের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করেন।’
এই প্রবল ক্ষমতাধর ধর্ষক কারা? ছাত্র। বয়সে তরুণ-যুবক। এখন বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ২৫-৪০ বয়সের মানুষ সর্বাধিক। এই তরুণ-যুবকগণ, যতো না পড়াশোনা ও দক্ষতা অর্জনে ইচ্ছুক, তার চেয়ে বেশি বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ ও কনজিউমারিজম ভিত্তিক  সংস্কৃতি দেখে দেখে ভোগপ্রবণ বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মহীবুল আজিজ আমাকে বলেছেন, তাদের যোগ্যতা থাক বা না থাক, তাদের মধ্যে প্রচণ্ডভাবে উচ্চাকাঙ্খা তৈরি হয়েছে। ফলে তারা রাজনীতির ছত্রছায়া গ্রহণ বা অপরাধ করে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা হাসিলের জন্য। এই অপরাধীদের সঙ্গে রাজনীতি, আদর্শ, দর্শন, মূল্যবোধ, চেতনা ও কমিটমেন্টের কোনো সম্পর্ক নেই। এরাই সময়ে সময়ে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে নিজের হীন স্বার্থে ও ব্যক্তিগত সুবিধার কারণে দল বদলায়। দলের অসৎ ও কুচক্রী রাজনীতিবিদগণ সংখ্যায় নগণ্য হলেও ক্ষমতাবান হয়ে উঠছেন। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থে এই তরুণ-যুবকদের কাজে লাগান। এরাই তাদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে তরুণ-যুবকদের বিপথগামী করেন। তরুণ-যুবকরাও ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে মাদক, ধর্ষণ বা অর্থ উপার্জনে লিপ্ত হয়। ফলে ক্ষমতা ও রাজনীতির আড়ালে একটি অপরাধচক্র প্রতিষ্ঠা পায়। তারা নৃশংস অপকর্ম করতেও পিছপা হয় না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক সাবেক সহকর্মী, বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পীস স্টাডিজ ও রাজনীতি বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞানের প্রফেসর ড. হেলাল মহিউদ্দিনের সঙ্গেও গণধর্ষণ সমস্যা নিয়ে কথা বলি। এই তরুণ সমাজ বিজ্ঞানী মনে করেন, সরকারে থাকা দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের একাংশ ছাত্র না হয়ে গুণ্ডা হয়, ধর্ষক হয়, ডাকাত হয়। কেন হয়? পেশির কারণে। পেশি বা ইংরেজি ‘মাসল’ মানে শুধুই কি গায়ের জোর? না, মোটেও তা নয়। এই ‘মাসল’-এর অর্থ ক্ষমতার জোর। দল ক্ষমতায়, ফলে ‘যা ইচ্ছে তাই করে পার পেয়ে যাওয়া যাবে’ বিশ্বাসের জোর। সিনিয়র নেতারা যারা ছাত্রদের স্বীয় স্বার্থে ব্যবহার করেন, তাদের আস্কারা ও মদদের জোর। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিরব থাকার জোর।
অপরাধ বিজ্ঞানীরা ধর্ষণ নামক অপরাধ কর্মের সঙ্গে পাশবিকতা ও কামপ্রবণতার সম্পর্ক পেয়েছেন, যার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতা, যেমন আর্থিক, সামাজিক, শারীরিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাও জড়িত। বিশেষ করে, গণধর্ষণকাণ্ডে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাও বিশেষভাবে দায়ী। সিলেটে গৃহবধূকে গণধর্ষণের অপরাধের নেপথ্যে কাজ করেছে এমনই বহুবিধ  কারণ।
সিলেট একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ এবং এমসি কলেজ একটি স্বনামধন্য প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। সেখানে আবাসিক হল দখল করে একটি নির্দিষ্ট কক্ষকে অপরাধের কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা কেমন করে সম্ভব হলো? জায়গাটি তো আকাশ থেকে পতিত হয়নি। কলেজ কর্তৃপক্ষ ছিল, আশেপাশে সমাজের মানুষজন ছিলেন এবং পুরো শহরের মতো ঐ জায়গাটিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরের বাইরে থাকার কথা নয়। সবাই যে সেখানকার অপরাধচক্র সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন, সে কথাও বলতে হবে। যদি সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগেভাগে সতর্ক হতেন ও প্রতিরোধ করতেন, তাহলে এমন অপরাধচক্রই গড়ে উঠতে পারতো না এবং এহেন নৃশংস গণধর্ষণের ঘটনা ঘটাও সম্ভব ছিল না।
ফলে অপরাধীদের ধরা ও শায়েস্তা করার পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অপরাধ হওয়ার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি ঠেকানোর উদ্যোগ গ্রহণ করাও অতীব জরুরি। সেটা শুধু সিলেটের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, দেশের সব জায়গার জন্যই দরকার। অপরাধ হওয়ার পর উত্তেজনা ও স্পর্শকাতরতা সৃষ্টির প্রবণতায় শরিক না হয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে বর্জন করতে হবে, যে কর্তৃপক্ষের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, পরিবার থেকে সকলেই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status