মত-মতান্তর

তাহলে সিইসি কবুল করলেন

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, শনিবার, ১:০৮ পূর্বাহ্ন

ফসলের বাম্পার ফলন হয়, ফলের বাম্পার ফলন হয়, মাছের বাম্পার ফলন হয় আর আমাদের হয়েছে চোরের। দেশ স্বাধীনের পরপরই নাকি বঙ্গবন্ধু দুঃখ করে বলেছিলেন সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। সেই খনি গত এক যুগে কতটা বিস্তৃতি লাভ করেছে তা ভাবতে বসলে গালে হাত দিতে হয়। গত কয়েক মাস যাবৎ এক একটি নাম সামনে আসে আর আমরা হামলে পড়ি। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সর্বত্র থাকে একই আলোচনা। আর থাকবেই না বা কেন? হাজার কোটি টাকার নিচে কথা নেই। তা সে লোহা লক্করের ব্যবসায়ী হোক কিংবা ড্রাইভার। অবশ্য ধর-পাকড় কিংবা আলাপ আলোচনা সব এই লোহা ব্যবসায়ী কিংবা ড্রাইভার দারোয়ান ঘিরেই। এর উপরে উঠে ধরার সাধ্য কিংবা জানলেও সেটা নিয়ে বলার সাধ্য কারও আছে বলে মনে হয় না। শুরু হয়েছিল সম্রাট, জিকে শামীম, এনু, রুপম, রুবেল, বরকত, পাপিয়া, সাহেদ, আরিফ, সাবরিনা দিয়ে। হালে যুক্ত হয়েছেন মালেক। বেচারি ড্রাইভার। এক দুই জন বাদ দিলে তারা সকলেই একেবারে প্রান্তিক শ্রেণি থেকে উঠে আসা ক্ষমতাসীন দলের কর্মী। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের তৃতীয় শ্রেণির কর্মী। স্বাভাবিকভাবেই চক্ষু চড়ক গাছ করে মানুষ ভাবে ক্ষমতাসীন দলের এই শ্রেণির হাতে যদি এত টাকা আসে তাহলে এর মাধ্যম আরও উপর তলার হাতে না জানি কি আছে? যৌক্তিক প্রশ্ন, এড়াই কি করে!
তবে কিনা বুনিয়াদি গণতন্ত্র, একদলীয় গণতন্ত্র, বহুদলীয় গণতন্ত্র ইত্যাদি নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা এখন আছি ‘উন্নয়নের গণতন্ত্রের’ পথে। দিকে দিকে লেখা দেখি ‘এই সরকারের মূলমন্ত্র, উন্নয়নের গণতন্ত্র’। উন্নয়নের গণতন্ত্র বস্তুটা কি তা না বুঝলেও এটুকু মানি যে, ‘উন্নয়নের গণতন্ত্রে’ উন্নয়ন হবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে উন্নয়নটা ‘কার’, ‘কি প্রকারে’, ‘কতটা’,‘কোন পথে’ এই সব কুচুটে প্রশ্ন যারা করে তারা আর যাই হোক “উন্নয়নের” পক্ষের মানুষ যে না সেটা বলাই বাহুল্য। আর বর্তমান সরকার তো সব সময়ই বলে থাকে তারা আসলে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। তবে সেই মানুষগুলো কারা, কাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরে, কি করে ঘোরে এই সব প্রশ্ন দুষ্ট হিংসুটে লোকে সব সময়ই করে। তাদের কথায় কান দিলে চলে না। উন্নয়ন তাদের সহ্য হয় না।
তাছাড়া দেশের উন্নয়ন যে হয়েছে তা অস্বীকার করি কি করে? যে দেশে সরকার একটা বালিশ কেনে ৬০০০ টাকায়, বই কেনে ৮৫০০০ টাকায়, পর্দা ৩৭ লাখ টাকায়, টেলিফোন ১৫ লাখ টাকায়, লিফট ২ কোটি টাকায়, ব্লাড প্রেশার মেশিন ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকায়, অক্সিজেন জেনারেটিং প্লান্ট ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকায়, টেবিল ১২ লাখ টাকায়, চেয়ার ৬ লাখ টাকায় এই উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলে সাধ্য কার! চেয়ার তো চেয়ার, এমন কি বটিও জাতে উঠেছে। একটা বটি ১০ হাজার টাকা, কাটা চামচ ১ হাজার টাকা, দুধে পানি মাপার যন্ত্র ৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা, বর্জ্য রাখার পাত্রের দাম ২.৫ লাখ টাকা, তালা ৫৫৫০ টাকা, বালতি ১৮৯০ টাকা, বাশি ৪১৫ টাকা, ডাস্টবিন ৮৯৯৫ টাকা আর কোন দেশে আছে? দেশের মন্ত্রী, এমপি’রা বিনয় করে দেশকে সিডনি, ভেনিস, লাসভেগাস কিংবা লস এঞ্জেলেসের সাথে তুলনা করেন বটে তবে দেশ যে মোটামুটি বিশ্ব ব্রমাণ্ডেই এক নতুন দিগন্তের উন্মেষ ঘটিয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
যাক, এই সব হিসেব হল উন্নয়নের হিসেব। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথা পিছু আয়, বিশ্বে অতি ধনী বৃদ্ধির হারে রেকর্ড, ধনী বৃদ্ধির হারে তৃতীয় কোথায় নেই বাংলাদেশ? কিন্তু দুষ্ট লোককে প্রশ্ন করেন, সেখানেও ঠিক খুঁত খুঁজে বের করবে তারা। এই যেমন জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথাই ধরেন না কেন। যতই বোঝান না কেন বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বিশ্বের বিস্ময় তারা ঠিকই প্রশ্ন তুলবে অর্থনীতিতে লেনদেন বাড়লেই জিডিপি বাড়ে। সেই অর্থে রাস্তা, ব্রীজ, ফ্লাইওভার নির্মাণে যতই লুটপাট হোক, মন্ত্রী, এমপি, নেতা, ঠিকাদার মিলে যতই ভাগ-বাটোয়ারা করুক, দফায় দফায় লাফিয়ে লাফিয়ে যতই প্রকল্প ব্যায় বাড়ুক লেনদেন বাড়লেই জিডিপি বাড়ে। এই যেমন, এক রাস্তা ১০০ বার কাটলেও জিডিপি বাড়ে, দেশের মানুষ পানি, বাতাস, শব্দ কিংবা সীসা দূষণে ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলেও জিডিপি বাড়ে। আবার খাল নালা দখল করে বহুতল মার্কেট বানালেও জিডিপি বাড়ে। ভারতে যখন জিডিপি ৮% ছাড়িয়েছে তখনও বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের তালিকায় ভারত ছিল শীর্ষে। সিপিডি’র গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে জিডিপি বাড়ার দিনগুলোতে সবচেয়ে ধনী ৫% মানুষের আয় বেড়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। আর সবচেয়ে গরীব ৫% মানুষের আয় কমেছে ১০৫৮ টাকা। জিডিপি’ র এই রমরমা সময়ে ওপরের দিকের ১০ শতাংশ মানুষের আয় নিচের দিকের ৪০ শতাংশ মানুষের আয়ের চেয়ে বেশি ছিল। পরিসংখ্যান ব্যুরো জানাচ্ছে ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে বছর ওয়ারি ১ দশমিক ৮ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমছিল যেটা ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে কমে দাঁড়ায় ১ দশমিক ২ শতাংশে।
সেই কারণেই অর্থনীতির পাঠ্য বইগুলোতে আবং দাভোসের মত উঁচু মাপের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্মেলনগুলোতে পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য বা আইনের শাসনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে শুধু জিডিপি’তে যে উন্নয়ন হয় না সে ধারণা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।
মজার বিষয় হল, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন মূখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়াম গত বছর তার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশিত গবেষণা পত্রে জানিয়েছিলেন ২০১১-২০১২ থেকে ২০১৬-২০১৭ সময়কালে বাস্তবে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি যে হারে হয়েছিল, সরকারি পরিসংখ্যান তার থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি দেখানো হয়েছিল। একইভাবে সানেম গত বছরের মে মাসে ‘কোয়াটারলি রিভিউ অফ বাংলাদেশ ইকোনমি’ শীর্ষক এক রিপোর্টে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে অধোগতি দেখিয়ে স্পষ্টভাবে বলেছিল বাংলাদেশের জিডিপি’ র প্রবৃদ্ধির হিসেব কোনভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। গত কয়েক বছর ধরে একই দাবি করে আসছে সিপিডি।
আর মাথাপিছু আয়ের হিসেবতো সব সময়ই লেজেগোবরে। এই হিসেবে সোনালি, জনতা, ফার্মারস, বিসমিল্লাহ, হলমার্ক্স, শেয়ার বাজার লুটেরাদের কুক্ষিগত সম্পদকেও সমাজের দশজনের গড় সম্পদ বলে চালিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে সমাজের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষগুলোও মধ্যবিত্তের তালিকায় ঢুকে যায় আর ঢাকা পড়ে লুটেরাদের ফুলে ফেঁপে ওঠার দৃশ্য। এই যেমন ধরেন, দায়মুক্তির সনদ নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানিয়ে এক মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ ও উৎপাদন না করে যারা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ৫৫ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেল কিংবা যাদের কারণে ব্যাংকগুলোতে মন্দ ঋণ এসে দাঁড়াল ৩ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। কিংবা যারা গত ১০ বছরে কেবল পাচারই করলো সাড়ে ৮ লক্ষ কোটি টাকা তাদের আয়ের সাথে যখন সলিমুদ্দিন, কলিমুদ্দিনের আয়ের গড় হয় তখন অংকটা বিশাল দেখাবে বৈকি।
বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয় বহুল মহাসড়ক, রেলপথ, ফ্লাইওভার আর সেতু দিয়ে চলাচল করি আমরা। ইউরোপ, চীন বা ভারতে যেখানে ৪ লেন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় যথাক্রমে ১৮ কোটি, ১৩ কোটি ও ১০ কোটি টাকা সেখানে বাংলাদেশে ৩ টি মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে ব্যয় করা হয়েছে কিলোমিটার প্রতি ৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক ৪ লেন নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয়েছে ২০০ কোটি টাকা।
আবার চীন, ভারতে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ১২ কোটি টাকা যেখানে উন্নত দেশগুলোতে ব্যয় সর্বোচ্চ ৩০ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশের দোহাজারি ঘুমধুম ১৩৯ কোটি টাকা, ঢাকা-যশোর ২০৩ কোটি টাকা, আর পায়রা বন্দর ২৫০ কোটি টাকা। সড়ক বা রেলপথের মতই ফ্লাইওভারেও একই অবস্থা। ভারতে প্রতি কিলোমিটার ফ্লাইওভার বানাতে খরচ হয় ৪৮-৮৮ কোটি টাকা, চীন, মালয়েশিয়ায় ৮০-৯০ কোটি টাকা আর বাংলাদেশে ১৫০-১৮০ কোটি টাকা। সেতু নির্মাণে ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই এসব দেশে কিলোমিটার প্রতি খরচ পড়ে ৫০০-৭০০ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে আমাদের মত দেশে প্রতি কিলোমিটার এর ব্যয় ৫০০ কোটি আর রেলসেতুসহ ৭০০ কোটি হতে পারে। তবে নদীর জটিল ভূ-প্রকৃতি বিবেচনায় কোন কোন ক্ষেত্রে এটি সর্বোচ্চ দ্বিগুন হতে পারে। অর্থাৎ রেলসেতুসহ সর্বোচ্চ ১৫০০ কোটি টাকা প্রতি কিলোমিটার। অথচ অতি আলোচিত পদ্মা সেতু নির্মাণে এই মুহূর্তে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় হচ্ছে ৪৭০০ কোটি টাকা।
সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, রাতে ভোট হবার সুযোগ নেই উপ নির্বাচনে। এর সাদা বাংলা করলে দাঁড়ায় আগে এই সুযোগ ছিল এবং তার যথাযথ সদ্ব্যবহারও হয়েছে। অর্থাৎ এতদিন যাবত বিরোধী দল, টিআইবি, সুজন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, দেশী, বিদেশী পর্যবেক্ষক এমনকি সাংসদ রাশেদ খান মেনন পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যা বলে এসেছেন সেটাই সত্য বলে প্রমাণিত হল। একটা দেশে মানুষ যখন তার প্রতিনিধিই নির্বাচন করতে পারে না, দিনের ভোট রাতে চুরি হয়ে যায় সেদেশে অন্য সব চুরিই তুচ্ছ। সেই সব তুচ্ছ চুরি নিয়ে তাই হয়তো দুই একদিন হইচই হয়। তারপর সব নিশ্চুপ, নিস্তরঙ্গ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status