প্রথম পাতা

স্বাস্থ্যে দুর্নীতি

৪৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ মিলেছে

মারুফ কিবরিয়া

২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, শনিবার, ৯:১৩ পূর্বাহ্ন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আব্দুল মালেক। শত কোটি টাকার মালিক। হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন। দেশ-বিদেশে কয়েকটি বাড়িসহ হাজার কোটি টাকার মালিক। ঠিকাদার মিঠু। হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে এখন লাপাত্তা। এমন অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন যারা সামান্য বেতনের চাকরিকে পুঁজি করে টাকার কুমির বনে গেছেন। একেকজন যে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সুস্থ রাখার জন্য কাজ করছে। কিন্তু স্বাস্থ্যের প্রতিটি খাত আক্রান্ত দুর্নীতি নামক অসুখে।
ছোট পদে কাজ করা কর্মচারীদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ দেখে চোখ কপালে উঠছে অনেকের। তারা মাঝে মাঝে ধরাও পড়েন। কারো কারো বিচারও হয়। কিন্তু বড় স্যারেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থেকে যান আড়ালে। গত বছর থেকে কেরানি আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমসহ স্বাস্থ্যের একাধিক কর্মচারীর হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার বিষয় নিয়ে চলা বিতর্কের মাঝেই যোগ হয় সদ্য গ্রেপ্তার হওয়া অধিদপ্তরের গাড়িচালক আব্দুল মালেকের আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার গল্প। গাড়িচালক হয়ে ঢাকায় সাত প্লটে তৈরি করেছেন চার বাড়ি। তাকে নিয়ে হই চই শুরু হতেই জানা গেলো স্বাস্থ্যের অন্তত ৪৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে দুদক। সংস্থাটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এরই মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতিও চলমান। এদের মধ্যে সদ্য গ্রেপ্তার হওয়া চালক আব্দুল মালেক ও তার স্ত্রীও রয়েছেন।
দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়টি কয়েকদিন আগেই গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন সংস্থার সিনিয়র সচিব দিলোয়ার বখ্‌্‌ত। তিনি বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী সিন্ডিকেট করে সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচার করছেন এমন অভিযোগ পেয়ে ২০১৯ সাল থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে এই ৪৫ জনের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। দুদকের উপ-পরিচালক সামছুল আলমের নেতৃত্বে একটি টিম এই অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই টিমের অন্য দুই সদস্য হলেন উপ-সহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান ও ফেরদৌস রহমান।
দুদকের সূত্র জানিয়েছে, যে ৪৫ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান তারা অধিদপ্তরের নানা প্রান্তে বর্তমানে কর্মরত। এই তালিকায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সংখ্যাই বেশি। কর্মকর্তাদের নাম খুব বেশি আসেনি। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অবশ্য বলছেন, দুর্নীতি নির্মূল করতে হলে রাঘব-বোয়ালদের দিকে নজর দিতে হবে। কারণ মাথার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এই দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হবে না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, দুর্নীতিবাজ উচ্চ পর্যায়ের বা নিম্ন পর্যায়েরই হোক না কেন কেউ এককভাবে দুর্নীতি করে না। আটক গাড়িচালক যে পর্যায়ের চাকরিচজীবী তার পক্ষে এতো সম্পদ অর্জন করা অসম্ভব। কাজেই তার সম্পদ অর্জন যে অবৈধ পন্থায় এটা অত্যন্ত পরিষ্কার। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই দুর্নীতি তিনি এককভাবে করেননি। এই দুর্নীতির সঙ্গে তার সহযোগীদের বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ এই দুর্নীতি তিনি করতে পারতেন না যদি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ না থাকতো। কাজেই শুধু কান নিয়ে টানাটানি করলে হবে না মাথা টানতে হবে।
স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক মানবজমিনকে বলেন, স্বাস্থ্যখাতের এ অবস্থা অনেক দিনের। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবেই এমনটা হচ্ছে। শুধু মন্ত্রী, সচিব, ডিজি বদল করে দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না। এক্ষেত্রে পুরো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয় সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিচালিত করতে হবে।
জানা যায়, আবজাল গ্রেপ্তারের পরই একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে স্বাস্থ্যের দুর্নীতিবাজদের নাম। বেরিয়ে আসতে থাকে স্বাস্থ্য খাতের ১৯ মাফিয়া ঠিকাদারের নাম। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ঘুরে ফিরে এ ঠিকাদাররাই বেশিরভাগ কাজ পেয়েছেন। স্বাস্থ্য খাতের যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনার নামে জালিয়াতি করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় প্লট, বাড়ি, গাড়িসহ বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তারা। শুধু দেশে নয়, এ সিন্ডিকেট অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছে। স্বাস্থ্য বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে গত পাঁচ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ সিন্ডিকেট। বিশেষ করে স্বাস্থ্যে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর সিন্ডিকেটটি এখনো সক্রিয় বলে জানা গেছে। চলমান করোনা পরিস্থিতির মাঝেও বিদেশ থেকে মিঠুর নির্দেশনায় চক্রটি নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status