এক্সক্লুসিভ

‘আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে’ বলেই ডিবি পরিচয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়

রুদ্র মিজান

২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, শনিবার, ৮:০১ পূর্বাহ্ন

ফাইল ছবি

টার্গেট করেই মাঠে নামে তারা। আসা-যাওয়ার রাস্তাটিও আগে থেকেই রেকি করা থাকে। অপারেশন শুরুর আগেই পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা অনুসারেই ‘পুলিশ পরিদর্শক’ কখনো কখনো ‘সহকারী কমিশনার’-এর নেতৃত্বে শুরু হয় অভিযান। ‘আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, আমাদের সঙ্গে চলুন’ বলেই টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে শত শত লোকজনের সামনে থেকেই তুলে নেয় নিজেদের গাড়িতে। তারপর নির্জন স্থানে নিয়ে গাড়ির ভেতরেই মারধর করে সর্বস্ব লুটে নেয়। নিজেদের মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয় দিয়ে ডাকাতি, ছিনতাই করে এই চক্র। দেখে বুঝার উপায় নেই তারা ভুয়া ডিবি। মাথার চুলগুলো ছোট করে ছাঁটা। শার্ট, টি-শার্টের উপরে পরনে থাকে ডিবি লেখা জ্যাকেট। ব্যবহৃত গাড়ির সামনেও কখনো কখনো ডিবি লেখা সংবলিত কাগজ লাগানো থাকে। সঙ্গে থাকে ওয়াকিটকি, সিগন্যাল লাইট। এমনকি পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র থাকে তাদের সঙ্গে। এসব চক্রের মূল হোতারা প্রভাবশালী। আড়ালে থেকে সহযোগিতা করে ছিনতাইয়ের টাকার ভাগ নেয় তারা। এই নকল ডিবি ধরতে গিয়ে প্রায়ই অভিযান চালায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেপ্তারও হয়। তারপরও থামছে না তাদের অপতৎপরতা। প্রায়ই ডিবি পরিচয়ে মানুষকে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে এসব চক্রের সদস্যরা। গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, একের পর এক তাদের গ্রেপ্তার করা হলেও জামিনে বের হয়ে আবারো এই অপকর্মে জড়িত হয় চক্রের সদস্যরা। নিজেদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে আশেপাশের লোকজনের কাছে কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখে। ঘন ঘন বাসস্থান পরিবর্তন করে চক্রের সদস্যরা। তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন এসব চক্রের সদস্যরা। যে কারণে তাদের গ্রেপ্তার করতে অনেক সময় বেগ পেতে হয়। এসব চক্রের মূল হোতারা সমাজে বিভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত। ভুয়া ডিবি’র চক্র পরিচালনা করে ছিনতাইয়ের বিপুল টাকার ভাগ পায় তারা। এরকম বেশ কয়েক জন মূলহোতা সম্পর্কে তথ্য পেয়েছে ডিবি। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। গত ৭ই সেপ্টেম্বর রাজধানীর ডেমরার বাঁশেরপুল এলাকার সুফিয়া রি-রোলিং মিলসের পরিচালক এস এম ফিরোজ হোসেন বাদী হয়ে ডেমরা থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলা সূত্রে জানা গেছে, রিকশাযোগে মোট ১৫ লাখ ১৭ হাজার ৬শ’ টাকা নিয়ে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ডেমরা শাখায় যাওয়ার পথে একটি সাদা প্রাইভেট কার মাসুদের গতিরোধ করে। ‘আমরা ডিবির লোক। আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে।’ বলেই রিকশা থেকে টেনে হিঁচড়ে টাকার ব্যাগসহ মাসুদকে প্রাইভেট কারে উঠিয়ে নিয়ে যায় তিন জন। গাড়ি চালাচ্ছিলো আরো একজন। প্রাইভেট কারে উঠিয়েই কাপড় দিয়ে তার চোখ বেঁধে নেয়। তখনও টাকার ব্যাগটি আগলে রাখতে চেষ্টা করছিলেন মাসুদ। এসময় ভয়ভীতি দেখিয়ে মারধর করে টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় চক্রের সদস্যরা। প্রায় দুই ঘণ্টা বিভিন্নস্থানে ঘুরিয়ে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে টাকার ব্যাগ রেখে মেঘনা ব্রিজের ঢালে কাউঢাইল নামক স্থানে গাড়ি থেকে ফেলে দেয় মাসুদ রানাকে। গত ৬ই সেপ্টেম্বর এ ঘটনা ঘটে। বেলা আড়াইটার দিকে মাসুদকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় ভুয়া ডিবি পুলিশ। তার আগে দুপুর ১২টায় সুফিয়া রি-রোলিং মিলসের ক্রেতা যাত্রাবাড়ীর একটি দোকান থেকে ৯ লাখ ৪৩ হাজার ১শ’ টাকা নেন কারখানার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মাসুদ রানা। তারপরও ডেমরার কোনাপাড়ার আল-আরাফাহ্‌ ব্যাংক থেকে ৫ লাখ ৭৪ হাজার ৫শ’ টাকা উত্তোলন করেন। ওই টাকা নিয়ে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রবিউল (৩২) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডেমরা থানা পুলিশ। সোমবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে সে। ছিনতাইয়ের সময় গাড়িচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে রবিউল। এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের সম্পর্কেও তথ্য দিয়েছে সে। রোববার দিবাগত রাতে মাদারটেক থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। সহকারী পুলিশ কমিশনার রাকিবুল হাসানের নেতৃত্বে ডেমরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. রফিকুল ইসলামের সহযোগিতায় এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। গ্রেপ্তারের পর রবিউলের দেয়া তথ্যানুসারে কিশোরগঞ্জে থাকা রবিউলের দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছ থেকে ছিনতাইয়ের এক লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। বাকি টাকা অন্যদের কাছে রয়েছে বলে জানায় সে। পরিদর্শক (তদন্ত) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, এটি একটি বড় চক্র। ধারণা করা হচ্ছে, দেশের বিভিন্নস্থানে ডিবি পরিচয়ে ছিনতাই করে এই চক্রটি।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, চক্রটি ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-সিলেট, চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই করে। ছিনতাইকালে তারা পুলিশের মতোই চেইন অব কমান্ড মেনে আচরণ করে। তারা নেতৃত্বদানকারীকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে। আচরণে পুলিশি ভাব প্রকাশ করে। গত ১৯শে আগস্ট এরকম আরো একটি চক্রের ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। চক্রের সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রতিদিন মাঠে নামে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ও ব্যক্তিকে টার্গেট করে তারা। ওই চক্রটি সন্ধ্যার দিকেই বেশি ছিনতাই করে। পরিকল্পনা অনুসারে নির্দিষ্ট এলাকায় অবস্থান নিয়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে অনুসরণ করে। পরে ডিবি পরিচয় দিয়ে ওই ব্যক্তির গতিরোধ করে। কখনো গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। নির্জন স্থান হলে তাৎক্ষণিকভাবে দেহ তল্লাশির নামে টাকা পয়সা ও মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয়। গত ১৭ই আগস্ট কোতোয়ালি থানার জনসন রোডে ডিবি পরিচয়ে এক কাপড় ব্যবসায়ীর ৫৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় এই চক্র। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়। পরবর্তীতে ঘটনাস্থলের আশেপাশের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ১৯শে আগস্ট ভোরে রায়সাহেব বাজার মোড় থেকে সোহাগ নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২০শে আগস্ট টঙ্গীর চেরাগ আলী থেকে সরোয়ার খাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তী সময়ে সরোয়ারকে নিয়ে পল্টন ও নর্দা এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুলাল, আনোয়ার, আমির, নাসির, ইমন ও রমজানদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরমধ্যে সোহাগ, ইকবাল ও দুলাল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এই চক্রটি পুরান ঢাকা, মতিঝিল, পল্টন, উত্তরা, গাজীপুর ও কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ডিবি পরিচয়ে ছিনতাই করে। এসব বিষয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ভুয়া ডিবি চক্রের সদস্যরা ঢাকার বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে আছে। চক্রের এসব সদস্যকে প্রায়ই গ্রেপ্তারও করা হয়। জামিনে বের হয়ে আবারো একই অপকর্মে লিপ্ত হয়। তাদের মূল হোতারা প্রভাবশালী।
আড়ালে থেকে তাদের সহযোগিতা করে। এসব বিষয়ে তথ্য রয়েছে। তদন্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।



   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status