প্রথম পাতা

মরেনি কেউ, কম্বোডিয়া যেভাবে করোনা রুখে দিলো

তারিক চয়ন

২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৪ পূর্বাহ্ন

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়া। করোনার উৎপত্তিস্থল হিসেবে পরিচিত চীন থেকে মাত্র আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরত্বের দেশটি এখন সারা পৃথিবীর কাছে বিস্ময়। সফলভাবে করোনাকে ‘রুখে’ দিয়েছে বলে প্রচার পাচ্ছে যে গুটিকয়েক দেশ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম কম্বোডিয়া। সেখানে ২৭শে জানুয়ারি উহান থেকে আসা একজন চীনা নাগরিক প্রথম করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হন। ১০ই ফেব্রুয়ারি সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়। ৭ই মার্চ প্রথম একজন স্থানীয় কম্বোডিয়ান নাগরিকের করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। এক সপ্তাহ পর ১৫ই মার্চ ১২ জন রোগী শনাক্ত হন। কিন্তু পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী দেড় কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশটিতে এখন পর্যন্ত মাত্র ২৭৫ জন মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন! মারা যাননি একজনও! কি এমন জাদু আছে কম্বোডিয়ার কাছে, যে কারণে এই অভাবনীয় সাফল্য?

বিশ্বব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক প্রোগ্রামের প্রধান হিসেবে কম্বোডিয়ায় দায়িত্বরত ড. জিয়াউদ্দিন হায়দারের কথায় বোঝা গেল জাদু বলতে কিছু নেই। একেবারে শুরু থেকেই করোনাকে হাল্কাভাবে না নেয়ার মানসিকতা এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নেরই ফসল আজকের এই সাফল্য।
‘বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা করোনার জন্য জরুরি ঘোষণা দেয়ার পরপরই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে থাকে কম্বোডিয়া। রাজনৈতিকভাবেও তারা ছিল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক ডেকে সেখান থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে প্রধান করে করোনা মোকাবিলায় জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করে সরকার। এতে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টকেও যুক্ত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত ৯টি অ্যাকশনের সঙ্গে সমন্বয় করে কোভিড মাস্টার প্ল্যান ঘোষণা করে। পাশাপাশি ৩টি সিনারিও ঠিক করে তারা। একজন বা দুজন আক্রান্ত হলে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে, ক্লাস্টার বা গুচ্ছ সংক্রমণ হলে কি করা হবে, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হলেই বা কি করা হবে।
মার্চে অর্থ মন্ত্রণালয় মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহে উন্নয়ন সহযোগী যেমন- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, এডিবি, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদির সঙ্গে বৈঠকে বসে এবং জানতে চায় কে কীভাবে সাহায্য করতে পারবে। সরকার জানিয়ে দেয়, মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে প্রয়োজন ৭০ মিলিয়ন ডলার। উন্নয়ন সহযোগীদের সহযোগিতার পর যা বাকি থাকবে তা জাতীয় বাজেট থেকে বরাদ্দ দেবে। আমরা বিশ্বব্যাংক থেকে ৩৪ মিলিয়ন ডলার দিয়ে সাহায্য করেছিলাম।
এভাবেই খুব দ্রুত এগুতে থাকে কম্বোডিয়া- বলছিলেন ড. জিয়া।

কিন্তু একটি দেশে যেকোনো জাতীয় সমস্যা সমাধানে শুধু সরকারের সদিচ্ছা এবং পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন জনগণের সম্পৃক্ততাও। কম্বোডিয়ার সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করে করোনা নিয়ে জনগণকে সচেতন করতে এবং কোনো বিষয়ে বিভ্রান্ত না হতে টেলিভিশনসহ অন্যান্য গণমাধ্যম এবং ফেসবুকে (কম্বোডিয়ায় তুমুল জনপ্রিয়) প্রচারণা চালাতে থাকে। সেখানে কেন হাত ধুতে হবে, কীভাবে হাত ধুতে হবে থেকে শুরু করে সবকিছু সহজভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।
দেশের বাইরে থেকে যেনো করোনার আগমন না ঘটতে পারে সেজন্য নেয়া হয় নানা পদক্ষেপ। ড. জিয়া যেমনটি বলছিলেন, ‘শুরু থেকেই কম্বোডিয়া সীমান্তে কড়া নজরদারি চালিয়েছিল। ২টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘হেলথ স্ক্রিনিং’-এর ব্যবস্থা করা হয়। বাইরে থেকে কেউ আসলে সন্দেহজনক হলেই পিসিআর টেস্ট করা হয় এবং সবাইকে বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। এ ব্যাপারটিতে বিন্দুমাত্র গাফিলতি বা ছাড় দেয়া হয়নি। এমনকি যাদের বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস রয়েছে, তাদের নিয়মিত ফলোআপ করা হতো। এপ্রিল-জুলাই ফ্লাইট পুরোপুরি বন্ধ ছিল। আর ট্যুরিস্ট ভিসা তো একদমই বন্ধ। শুধু ব্যবসায়ী এবং কূটনীতিকদের প্রবেশাধিকার আছে দেশটিতে। এখন বিমানবন্দর থেকে যাত্রীদের সরকারি বাসে করে সরকারি তত্ত্বাবধানে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। হোটেলে প্রবেশের সময়ই স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের নমুনা নিয়ে নেন। টেস্টের রেজাল্ট পেতে এক রাত সবাইকে হোটেলেই কাটাতে হয়। কোনো ফ্লাইটের একজনেরও যদি রিপোর্ট পজেটিভ হয়, তাহলে সব যাত্রীকে ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়।’

কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো, কম্বোডিয়া কিন্তু একবারও লকডাউনে যায়নি। কিন্তু ত্যাগ স্বীকার করেছে অনেকভাবেই। এ বছরের ঐতিহ্যগত খেমার নতুন বর্ষ (বড় এবং জাতীয় উৎসব) উদ্‌যাপন বাতিল করা হয়েছিল। ড. জিয়ার ভাষায়, ‘বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় দেয় এপ্রিল মাসে। কিন্তু তার জন্য বসে থাকেনি কম্বোডিয়া। শুরুর দিকেই চীন থেকে নিজেরা পিপিই সংগ্রহ করে সব জায়গায় স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বণ্টন করা হয়। বিশ্বব্যাংকের সাহায্যের পর আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ইত্যাদিতে জোর দেয়া হয়। চিকিৎসকদের জন্য বোনাস, যাতায়াত ভাতার ব্যবস্থা করা হয়। গ্রাম পর্যায়েও কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংয়ের ব্যবস্থা নেয়া হয়।’
কিন্তু এতো কিছুর পরেও রয়েছে সমালোচনা। প্রতি দশ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে দেশটিতে মাত্র সাড়ে সাত হাজারের কিছু বেশি টেস্ট করানো হয়েছে, বিষয়টি উল্লেখ করে ড. জিয়া বলেন, ‘অকারণে কেন টেস্ট করানো হবে! শুধু যারা সন্দেহভাজন তাদেরই টেস্ট করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে সব নাগরিকদের জন্য টেস্ট বিনামূল্যে করা হয়। এমনকি চিকিৎসাও বিনামূল্যে! এরকম হলে কেউ নিজেকে আক্রান্ত মনে করলে লুকোনোরও কারণ নেই। তাছাড়া ২৫টি প্রদেশের সব জায়গাতেই নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মানুষকে কষ্ট করে দূরে কোথাও যেতে হয় না। সরকারিভাবেই নমুনাগুলো রাজধানীতে পিসিআর টেস্টের জন্য পাঠানো হয়ে থাকে। তবে বিদেশিদের টেস্ট খরচ এবং চিকিৎসা খরচ নিজেদের বহন করতে হয়।’
কম্বোডিয়াতে সরকারিভাবে কড়া নির্দেশনা দেয়া আছে সব প্রাদেশিক হাসপাতালেই যে কেউ নিজেকে করোনাক্রান্ত মনে করলে ভর্তি হয়ে যেতে পারবেন। হাসপাতাল তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য।
তুলনামূলক দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিয়েও কম্বোডিয়ার এই বিস্ময়কর এবং ঈর্ষণীয় সাফল্যের কারণ কি জানতে চাইলে ড. জিয়া বলেন, তাদের শৃঙ্খলা এবং দক্ষতাই মূল কারণ। যে কারণে গত তিন মাসে দেশটিতে স্থানীয়ভাবে কোনো করোনা সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি। যে কয়েকজন সংক্রমিত পাওয়া গেছে, তারা সবাই ‘ইম্পোর্টেড কেইসেস’ বা বাইরে থেকে আসা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status