প্রথম পাতা

কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে মিশন বাড়াচ্ছে সরকার

মিজানুর রহমান

২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ৯:৫৮ পূর্বাহ্ন

করোনা পরবর্তী বিশ্বে কূটনৈতিক কার্যক্রমের পরিধি বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে ঢাকা। দুনিয়ার যেসব দেশ বা অঞ্চলে এখনো বাংলাদেশের মিশন বা উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নেই সেসব এলাকায় প্রকৃত প্রতিনিধির  মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ তৈরি করতে চায় বাংলাদেশ। এতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং ওই সব অঞ্চলে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের স্বার্থ-সুরক্ষা নিশ্চিতের পাশাপাশি বহুমাত্রিক বিশ্বে ক্রমঅগ্রসরমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ওই উদ্যোগের অংশ হিসেবে নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিংটন, আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিন, আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে পূর্ণাঙ্গ মিশন খুলছে বাংলাদেশ। তাছাড়া বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা চীনের গুয়াংজো, ব্রাজিলের সাওপাওলো এবং জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটেও কনস্যুলেট খোলার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র মানবজমিনকে জানিয়েছেন, আগামী জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে প্রস্তাবিত ৬ মিশনের কার্যক্রম শুরুর টার্গেট নির্ধারিত হয়েছে। তবে লক্ষ্য বাস্তবায়নের বিষয়টি একান্তভাবে নির্ভর করছে বিদ্যমান বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয় তার ওপর। এরইমধ্যে দুনিয়ার দেশে দেশে কোভিডের সেকেন্ড ওয়েব বা দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এটা কতটা আগ্রাসী রূপ নেবেÑ তা নিয়ে খোদ গবেষকরা বিভ্রান্তিতে রয়েছেন।

নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও আর্জেন্টিনায় দূতাবাস খোলার যৌক্তিকতা
 বাংলাদেশের বিদেশনীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মতে, প্রস্তাবিত ৬টি মিশনসহ বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে এমন দেশ এবং অঞ্চলে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এটি বহু আগেই নেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নের গতি শ্লথ নানা কারণে। চলতি বছরে অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং আর্জেন্টিনায় দূতাবাস খোলার বিষয়টি অনেক দূর এগিয়েছে। বিশ্ব ব্যবস্থায় দেশ ৩টির নিজস্ব অবস্থান রয়েছে উল্লেখ করে এক কর্মকর্তা বলেন, দেশত্রয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব অপরিহার্য। তাছাড়া বাণিজ্যসহ অন্যান্য স্বার্থ তো রয়েছেই। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র নিউজিল্যান্ডের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য শুঙ্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা পায়। পাশাপাশি নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচির সুবিধাভোগী বাংলাদেশ। বন্ধুপ্রতিম ওই দ্বীপ রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি এতোদিন ধরে ক্যানবেরাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন দেখভাল করে আসছে। ভৌগোলিক কারণে মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন নিউজিল্যান্ডে অস্ট্রেলিয়া থেকে দূতাবাস প্রতিনিধিদের উড়ে গিয়ে কনস্যুলার সেবা দিতে হয়, যা অনেক সময়ই দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে গত বছর নিউজিল্যান্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর ক্রাইস্টচার্চে দেশটির ইতিহাসে ঘৃণ্যতম সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনায় বহু বাংলাদেশি হতাহত হলে দেশটিতে বাংলাদেশ মিশন না থাকার বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকদের মাঝে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। অবশ্য সেই ঘটনায় অস্ট্রেলিয়াস্থ বাংলাদেশ মিশনের কুইক রেসপন্সের বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ঢাকা মনে করে নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের একটি মিশন স্থাপিত হলে তা দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধির পথ সুগম হবে, যা পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের জন্য বড় সাপোর্ট হবে। স্মরণ করা যায় নিউজিল্যান্ডে ভারত, পাকিস্তানসহ ৬৬টি দেশের কূটনৈতিক মিশন রয়েছে। ইউরোপের অন্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র আয়ারল্যান্ড জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আয়ারল্যান্ডে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে সেখানে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের গমন ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। কর্মকর্তারা মনে করেনÑ আয়ারল্যান্ডে বাংলাদেশের মিশন স্থাপিত হলে তা দুই দেশের মধ্যে ওষুধ শিল্প ও চিকিৎসা সেবা, পোশাক শিল্প, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বৃদ্ধিসহ প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বার্থ সুরক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আয়ারল্যান্ডে ভারত ও পাকিস্তানসহ ৫৮টি দেশের মিশন রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃত আর্জেন্টিনা বাংলাদেশি পণ্য বিশেষত তৈরি পোশাক শিল্পের অন্যতম বাজার। সুলভ কৃষিজ কাঁচামালের অনন্য ক্ষেত্র হওয়ায় দেশটিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের যাতায়াত এবং অবস্থান সাম্প্রতিক সময়ে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশাল সম্ভাবনাময় এ দেশে দূতাবাস স্থাপিত হলে তা বাংলাদেশের তৈরি  পোশাক ও শ্রমশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাছাড়া, মিশন খোলা হলে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পাবে যা ভবিষ্যতে ওই অঞ্চলে বাংলাদেশের ক্রমবিকাশমান বহুমাত্রিক স্বার্থ সুরক্ষায় সুদৃঢ় ভূমিকা পালন করবে। বুয়েন্স আয়ার্সে বিশ্বের প্রায় ৮৬টি দেশের কূটনৈতিক মিশন রয়েছে।

চীনে তো মিশন রয়েছে, তারপরও কেন?
বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল চীনে তো মিশন রয়েছে, তারপরও নতুন কনস্যুলেট খোলার তোড়জোড় কেন? এক কর্মকর্তা বলেন, চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে বাংলাদেশের দূতাবাস এবং পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ ইউনানের কুনমিংয়ে একটি কনস্যুলেট রয়েছে। কিন্তু বিশাল গণচীনের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ও বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ শহর গুয়াংজোতে একটি মিশন খোলা হলে সেই নেটওয়ার্ক রাশিয়ার বর্ডার পর্যন্ত কভার করবে। চীনের বিশাল ভৌগোলিক আয়তন, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের মাত্রা ও গভীরতা বিবেচনায় দেশটির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরেও পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের মিশন স্থাপন করার প্রয়োজন রয়েছে মন্তব্য করে ওই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থ বিবেচনায় চীনের শহরগুলোর মধ্যে গুয়াংজো শহর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বন্দরনগরী এবং ব্যবসায় বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র গুয়াংজো শহরের অর্থনীতি গতবছর প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে এবং প্রতিবছর এটি প্রায় ১৩% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে বর্তমানে প্রায় সহস্রাধিক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থী বসবাস করেন এবং এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ব্যবসায় বাণিজ্যের বেশির ভাগ গুয়াংজো শহরকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে বেইজিং ও কুনমিং মিশন হতে এ শহরে এসে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ব্যবসায়িক ও কনস্যুলার সেবা প্রদান কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। চীনের গুরুত্বপূর্ণ এই পর্যটন নগরীর। ঢাকা থেকে সরাসরি বিমান যোগাযোগ থাকায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ থেকেও প্রতিনিয়ত এ শহরে অসংখ্য পর্যটক আসা-যাওয়া করেন। গুয়াংজোতে একটি নতুন মিশন স্থাপন করা হলে তা বাংলাদেশের সঙ্গে চীন তথা গুয়াংজোর ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন এবং সেখানে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের কনস্যুলার সেবাসহ সার্বিক সহায়তা প্রদানে সহজ হবে। বর্তমানে গুয়াংজো শহরে প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার কনস্যুলেটসহ প্রায় ৫৯টি বৈদেশিক কনস্যুলেট অফিস রয়েছে।

ব্রাজিল ও জার্মানিতে দ্বিতীয় মিশন প্রশ্নে যা বললেন কর্মকর্তারা-
সেগুনবাগিচার কর্মকর্তাদের মতে, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ব্রাজিলে বাংলাদেশের দূতাবাস রয়েছে। সেটি রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় অবস্থিত। বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় ব্রাজিলের বেশির ভাগ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর সাওপাওলোতে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৃহদাংশের অবস্থানও ওই শহরের কয়েক শ’ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে। ব্রাসিলিয়া থেকে সাওপাওলোর দূরত্ব প্রায় ১০০০ কিলোমিটার দূর। ফলে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণ এবং বাংলাদেশিদের কনস্যুলার সেবা নিশ্চিতে সাওপাওলোতে একটি কনস্যুলেটের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সাওপাওলোতে ভারতসহ বিশ্বের ৪৭টি দেশের কূটনৈতিক মিশন রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ জার্মানির রাজধানী বার্লিনে বাংলাদেশের একটি মিশন থাকলেও এর বাণিজ্যিক রাজধানী ফ্রাঙ্কফুর্ট-এ বাংলাদেশের কোনো মিশন নেই। ফ্রাঙ্কফুর্ট ইউরোপের শিল্প, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও যোগাযোগের অন্যতম কেন্দ্র। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদর দপ্তর সেখানে। অর্থনৈতিক গুরুত্বের জন্য জার্মান প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রায় ৪০ ভাগ ফ্রাঙ্কফুর্টে বসবাস করেন। তৈরি  পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রেও জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই সব বিবেচনায় সেখানে বাংলাদেশে মিশন খুলছে। বার্লিন থেকে ৬০০ কি.মি. দূরবর্তী ফ্রাঙ্কফুর্টে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৪১টি মিশন রয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status