বাংলারজমিন
তিস্তাপাড়ে ফাতেমাদের চোখে জল
লালমনিরহাট প্রতিনিধি
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, বুধবার, ৮:৩৩ পূর্বাহ্ন
তিস্তাপাড়ের ফাতেমা। বয়স ৮০ ঊর্ধ্বে। বসতবাড়ি বলতে কুটির ঘর। সেই ভিটে এখন তিস্তার গর্ভে। নদীর জলস্রোতে বইছে ফাতেমা বেওয়ার চোখের জল। লালমনিরহাট সদরের তাজপুর ৩ নং স্পয়ার বাঁধের পাশে ছিল ফাতেমার বসতবাড়ি। কয়েক দিনের ভাঙনে তিস্তা কেড়ে নিয়েছে তার শেষ সম্বল ভিটেমাটি। এখন তাঁর বুক ফাটা আর্তনাদ। শুধু ফাতেমা না এই আর্তনাদ তাজপুরের শ শ মানুষের। কয়েক দিন ধরে তিস্তার হিংস্রতায় ভেঙে গেছে রাজপুুরের অনেকের ভিটেমাটি। ৪ দফা বন্যায় অনেকে ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাঁধে। এদের অনেকেই এক সময় রাজপুরের জোতদার ছিল। এখন নিঃস্ব। তাজপুর ভাঙন এলাকা সরজমিন পরিদর্শনে গেলে চোখে পড়ে ভাঙন দৃশ্য আর আর্তনাদের সুর। অনেকে হারিয়েছে আবাদি জমি। এদের ছিল গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ। গত দুই-তিন দিন আগে চতুর্থ দফা বন্যার পানিতে তাজপুরের ৩ নং স্পয়ার বাঁধে পানির স্রোতে সুড়ঙ্গ হয়েছে। সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে পানি প্রবেশ করে ২ দিনে প্রায় ৪ শতাধিক পরিবারের ভিটেমাটি চলে যায় তিস্তার গর্ভে। এরপর লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন রোধে চেষ্টা চালাচ্ছে। ৩০ ফুটের অধিক নিচে সুড়ঙ্গ হওয়ায় স্পয়ার রক্ষায় বেগ পেতে হচ্ছে পাউবো কর্মকর্তাদের। সুড়ঙ্গ বন্ধ না হলে রাজপুর ও গোকুণ্ডার আরো কয়েক শ’ বাড়ি নদীগর্ভে বিলীনের সম্ভাবনা রয়েছে। তাজপুরের ছইমুদ্দিন বলেন, ‘বাপই আর কদ্দিন হামরা গিলা এনথন থাকমো। মোর ২ দোন জমি গেইল নদীত। এলা মুই সংসার চালাইম কি দিয়া।’ তাজপুরের তিস্তার বাঁধে বসে রহিমা বেওয়া ফেলছে চোখের জল। বৃদ্ধা রহিমা বেওয়া জানান, ‘মুই মোর বিয়ের স্বামীর ভিটে হারানু। মুই এলা থাকিম কার বাড়িত। নদী ভাসি গেইল মোর স্বামীর কবর। এলা কার কবর দেকিমুই থাকিম।’ এভাবে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে রহিমা। বসতবাড়ি ও আবাদি জমি হারিয়ে আর্তনাদ করছে তাজপুরের নুর আলম। নুর আলম জানান- ‘বাপ-দাদার শেষ ভিটে খাইল মোর তিস্তা। মুই ভিটে ছাড়ি রাস্তাত থাকোং। চোখের জল থাকছে না রাজপুরের আক্কেল আলীর। আক্কেল আলী এক সময়ের রাজপুরের জোতদার ছিলেন। তিনি ৪ মেয়ে ও ৩ ছেলে নিয়ে পাচ্ছে না কোনো ভরসা। শুধু এরাই নয় লালমনিরহাটের রাজপুর- তাজপুরের আরো অনেকের চোখের জল। শরীয়তুল্লাহ বলেন- মেয়ের বিয়ে ঠিকঠাক। ঘরবাড়ি দেখি গেছে বরপক্ষ। সেই ভিটে চলে গেছে তিস্তার বুকে। এখন বাঁধে চালা তৈরি করে আছি। আর এই দেখে পাত্রপক্ষ ভেঙে দিছে বিয়ের সম্পর্ক। শরীয়তুল্লাহ এখন শুধু নদীর পানির দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। নদী ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো এখনো সরকারি কোনো সহযোগিতা পায়নি। অনাহারে-অর্ধাহারে তাদের দিন কাটাচ্ছে। অপরদিকে, ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন কাজ করলেও তিস্তা তার দিক পরিবর্তন করছে। লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, তাজপুর-রাজপুর আর তিস্তার ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন দিন-রাত কাজ করছে। তাজপুরে ৩ নং স্পয়ার রক্ষায় জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা চলছে। আরো ভাঙন এলাকাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোতেও কোনো কোনো স্থানে কাজ চলছে। ওদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড উত্তরাঞ্চল প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ লালমনিরহাটের তাজপুর তিস্তা নদী ভাঙন ৩ নং স্পয়ার এলাকা পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের জানান, সরকার তিস্তা ভাঙন রোধে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। দ্রুত ভাঙন রোধে কাজ শুরু হবে। তিনি আরো বলেন- প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় দ্রুততম সময়ে কাজ শুরু করা হবে।