প্রথম পাতা

আমার হৃদয়ে তিনি নিত্য জাগ্রত

নূরে আলম সিদ্দিকী

১৫ আগস্ট ২০২০, শনিবার, ৮:৫১ পূর্বাহ্ন

আগস্ট মাসটি বাঙালি জাতির তথা বাংলাদেশের জন্য শোকের মাস। কিন্তু আমার জন্য এটি হৃদয়ে রক্তক্ষরণের মাস; অনুভূতি, উপলদ্ধি ও মননশীলতার পরতে পরতে অসহ্য ও তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা বহন করার মাস। আজকে ৪৫ বছর হলো, মুজিব ভাই আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু আমার অনুভূতিতে, বিশ্বাসে এটা আজও পুরোপুরি সত্যরূপে প্রতিভাত হয় না। আমার মননশীলতা, অনুভূতি, হৃদয়ের অনুরণন, কোনো জায়গায় বঙ্গবন্ধু নেই বা তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন- এটা মানতে পারে না। আমার স্বপ্নের মধ্যে তো বটেই, জাগরণেও তাঁর উপস্থিতি স্পষ্টভাবে উপলদ্ধি করি। এ অনুভূতি কাউকে বোঝানো যাবে না, বোঝানো যায় না। আমার হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে তিনি অমলিন। তাঁর সাথে সমস্ত স্মৃতি আমার হৃদয়ে নিত্য জাগ্রত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ বছরটিকে মুজিববর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। শোকাবহ আগস্টে আমার প্রাণের মুজিব ভাই’র প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। ১৫ই আগস্টের সেই নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে নিহত বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সকল সদস্যের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ, তার বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতায় যাদের অথবা যাদের পূর্বসূরিদের অবদান আছে, পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে এই রক্তস্নাত বাংলার যেসব দামাল ছেলেরা অভিষিক্ত, যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে; ৪৭ থেকে ৭১- এই দীর্ঘ পথপরিক্রমণে একেকটি আন্দোলনের সোপান উত্তরণের মাঝে একেকগুচ্ছ তরুণ তাজা তপ্ত প্রাণ অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। কিন্তু এই সবকিছুরই পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ প্রতীক ছিলেন জাতির জনক, আমার প্রাণের মুজিব ভাই।

নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে রাখি, দীর্ঘ কারারুদ্ধ জীবনের মধ্যে ১৭টি মাস প্রত্যহ এত দীর্ঘ সময় ধরে আমি যে তাঁর নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছি, বাস্তবে কারাগারের বাইরে অথবা ভিতরে অনুজ তার অগ্রজের, সন্তান তার পিতার এত নিবিড় সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য হয় না। যেটি আল্লাহ্‌র অশেষ রহমতে আমার হয়েছে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী উদ্ধত-উদ্‌গত-পূর্ণায়ত পদ্মটির মতো উদ্ভাসিত যৌবনের অধিকারী।

আমি অনেকবার কারাগারে যাওয়া-আসার কারণে আমাকে অনেকেই বি ক্লাস বলতেন। মামলায় বারবার জেলখানায় যাওয়া-আসা করলে, সে শাস্তি নিয়েই হোক অথবা বিভিন্ন মামলার জামিনযোগ্য আসামি হিসেবেই হোক, জেলখানার পরিভাষায় তাকে বি ক্লাস আসামি বলা হতো। বি ক্লাস হওয়া সত্ত্বেও আমি আগে কখনো নিরাপত্তা বন্দি বা রাজবন্দি ছিলাম না। ৬৬ সালের ৯ই জুন আমি ডিপিআর-এ রাজবন্দি হিসেবে কারাগারে ঢুকি এবং আমাকে কারাগারের পুরনো ২০ সেলে স্থান দেয়া হয়। এর সন্নিকটেই ছিল দেওয়ানি, যেখানে কারাগারে মুজিব ভাইয়ের অবস্থান ছিল। দেওয়ানির পাশেই ছোট্ট একটি রান্নাঘর, যেটি একান্তভাবেই মুজিব ভাই’র জন্য ব্যবহৃত হতো।

সেবার যখন আমাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন, ‘বারবার ঘু-ঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এইবার ঘু-ঘু তব বধিবে পরাণ’। তিনি দ্রুত এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং নিচু স্বরে বললেন, প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে, পরে সয়ে যাবে। তাঁর সেই সান্ত্বনার বাণীতে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। কারণ বি ক্লাস থেকে নিরাপত্তা বন্দি হয়ে জাতে উঠেছি। আর মুজিব ভাই-ই নন, নিরাপত্তা বন্দিরাই কুলীন ছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে কারাগার থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার আগ-পর্যন্ত ১৭টি মাস তাঁর নিবিড় সাহচর্য ও সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

তারপর ১৯৬৯ এর শেষার্ধে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই এবং তাঁরই নির্দেশে একাত্তরে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করি, যার প্রতিটি সভায় সভাপতিত্ব করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এ সমস্ত দায়িত্ব পালনের সুবাদে স্বাভাবিকভাবেই মুজিব ভাই’র সাথে আমার অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। তাঁর অপার স্নেহে আমি সিক্ত হয়েছি।

মুজিব ভাই’র সাথে আমার অজস্র স্মৃতি থেকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে দু’-একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিষয়টি আইয়ুব খান চূড়ান্ত করে ফেললেন এবং মুজিব ভাইকে (তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হননি) আসামি করে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলানোরও তাদের দুরভিসন্ধি তখন পাকাপোক্ত হয়ে উঠল। তখন মুজিব ভাইকে সম্পূর্ণ বিছিন্ন করার তাদের সিদ্ধান্তটি সুস্পষ্টভাবে জানাজানি হয়ে গেল। তখনকার এক বিকেলে আমরা জেলখানার অভ্যন্তরে দেওয়ানি এবং ২০ সেল মিলে যে চত্বর ছিল তা হাঁটার জন্য তো বটেই এমনিতেও বিস্তীর্ণ। মুজিব ভাই ও আমি পাশাপাশি হাঁটছিলাম। হঠাৎ মুজিব ভাই আমার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আমি বিস্ময়াভিভূত নয়নে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। তখন তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আলম, কালকে তোর ভাবী দেখা করতে আসলে আমি তাকে আর খাওয়া আনতে নিষেধ করে দেবো। আমার খানেওয়ালাই যদি আমার কাছে না থাকে (জেলখানায় আমি এত খেতাম যে আমার সহযোদ্ধা রাজবন্দিরা আমাকে খাদক বলে অভিহিত করত) তাহলে বাহির থেকে এত খাওয়া এনে লাভ কী? শুধু শুধু রেনুর উপরে বাড়তি ঝামেলা চাপানোর তো কোনো মানে হয় না। আমরা তো আগেভাগেই জানতাম, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিই শুধু নয়, তাকেও নিঃশেষ করে দেয়ার একটা জঘন্য পাঁয়তারা চলছে। আমিও অবরুদ্ধ। বুকফাটা আর্তনাদ করারও সুযোগ নেই। কিন্তু অনুভূতির রক্তক্ষরণ অনেকটাই বৃদ্ধি পেলো। আমার দু’টি চোখ কেবল অশ্রুসিক্তই হয় নাই, আমি তাঁর হাতটা চেপে ধরা অবস্থাতেই সশব্দে কেঁদে দিয়ে বলেছিলাম, মুজিব ভাই, ওরা সত্যিই কি আপনাকে মেরে ফেলবে? ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে তো আপনি বিশ্বাস করেন না। আপনি বিচ্ছিন্নতাবাদীও নন, তবে আপনার প্রতি কেন তাদের এত আক্রোশ? আইয়ুব জান্তার কেন এত জেদ? আপনি আপসহীন পূর্ব-পাকিস্তানের ন্যায্য হিস্যার দাবিতে।
পরে যখন মুজিব ভাইকে দেওয়ানি থেকে সরিয়ে সমস্ত বন্দিদের লকআপের পরে তাঁকে অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমি দেওয়ানির পাশের সেল নতুন ২০-এ ছিলাম। তখন আমাদের তত্ত্বাবধানে থাকা ডেপুটি জেলারগণ, বিশেষ করে শামসুর রহমান ও তোফাজ্জল হোসেন আমাদের সমবয়সী ও বন্ধুপ্রতিম ছিলেন, তাদেরকে অনুরোধ করায় তারা নিজেদের চাকরির ঝুঁকি নিয়ে আমাকে সুযোগ করে দিতে সেদিন নতুন ২০-এ লকআপ করেননি। ফলে যে রাস্তা দিয়ে মুজিব ভাইকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেই রাস্তার সন্নিকটে একটি কলাপসিবল গেট ধরে আমি অঝোরধারায় কাঁদছিলাম। মুজিব ভাই তার স্বভাবসুলভ পাজামা-পাঞ্জাবি, মুজিব কোট পরা অবস্থায় হাতে পাইপ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরে খুবই গম্ভীর মননশীলতা ও মননে ধীর পদক্ষেপে জেল পুলিশদের সাথে হেঁটে যাচ্ছিলেন। যদিও অবলীলাক্রমে তিনি পাইপ টানছিলেন, তবুও তাঁর মুখমণ্ডলে একটা চরম দুশ্চিন্তার ছাপ পরিস্ফুট হয়েছিল, যা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। আমি চরম আবেগাপ্লুত হৃদয়ে চিৎকার করে বললাম- মুজিব ভাই, তোমাকে কি ওরা মেরে ফেলবে? আর কখনো কি তোমার দেখা পাবো না? আমরা পূর্ব-বাংলাকে জীবনের বিনিময়ে মুক্ত করবো, ইনশাআল্লাহ্‌। তবুও তোমার শেষ নির্দেশনা দিয়ে যাও। মুজিব ভাই ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। ডান হাতে পাইপ ছিল। বাঁ হাত উঁচিয়ে বললেন- ওরা যদি আমাকে মেরেও ফেলে, তবুও চলমান আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেও। পাকিস্তানিদের অপশাসন হতে পূর্ব-বাংলাকে মুক্ত করতেই হবে। এ দায়িত্ব আমি তোমাদের হাতে রেখে গেলাম। পথবিচ্যুত হয়ো না। ভয়ভীতি নির্যাতন নিগ্রহকে তোমাদের উপেক্ষা করতে হবে। এর বেশি কথা বলার সুযোগ তখন আর ছিল না।

বাকশালের বিরোধিতা করে সংসদ ছেড়ে আসার পর ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসায় আমার যাতায়াত প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফুর রহমান মারা যাবার পর মণি ভাই তাঁর সঙ্গে করে আমাকে ৩২ নম্বরে নিয়ে যান। আত্মীয়স্বজন ও শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়া বাসার ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। আমি ৩২ নম্বরের বাড়ির ছাদে গিয়ে পৌঁছালাম। সেখানে বঙ্গবন্ধু অবস্থান করছিলেন। একটি ইজিচেয়ারে বসা অবস্থায় তিনি আমাকে দেখলেন। তাঁর ঠোঁট দু’টি কেঁপে উঠলো, চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। তিনি ইশারায় আমাকে কাছে ডেকে নিলেন। আমি ভীষণভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। তখন হেলিকপ্টারে টুঙ্গিপাড়ায় যাওয়ার জন্য আত্মীয়দের ও শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছিল। মরহুম জিল্লুর রহমান তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে তালিকা প্রস্তুত করতে ব্যস্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি টুঙ্গিপাড়ায় যাবি? প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হেলিকপ্টারে স্থান সংকুলানের অভাবের কথা চিন্তা করে আমি মুজিব ভাইকে না করেছিলাম।

১৫ই আগস্টের দু’-একদিন আগে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ হয়। আমি বাকশালে যোগ দিইনি বিধায় আমার সংসদ সদস্য পদ তো এমনিতেই বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। বঙ্গবন্ধু আমাকে পরামর্শ দিলেন, গোপালগঞ্জে তাঁর বাবার নামে স্থাপিত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেয়ার জন্য। জবাবে আমি বলেছিলাম, আমার মনটা এখন খুব খারাপ। আপনাকে পরে জানাব। এই ছিল তাঁর সাথে আমার শেষ কথা।

স্বাধীনতার পূর্বকাল হতেই ভ্রান্তবামেরা বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে আসছিল। বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে তাদের সেই চেষ্টা সফল হয় এবং যত কষ্টদায়কই হোক এটা নির্মম বাস্তব, বাকশাল গঠন ১৫ই আগস্টের পটভূমিকা রচনায় অনেকটাই প্রণোদনা প্রদান করে। নেতা অবশ্য আমাকে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আমি আমার মানুষকে বলেছিলাম, সাড়ে তিন বছর কিছুই দিতে পারবো না। তারা তা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছে। এখন আমি কী করে তাদের শান্ত রাখবো? তাই এখন একটা রেজিমেন্টেশনের মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান একটা উন্নয়ন আনতে চাই। তারপর আবার বহুদলীয় ব্যবস্থায় ফিরে আসবো, ইনশাআল্লাহ্‌। কিন্তু ১৫ই আগস্ট তাঁর সেই ওয়াদা পূরণ করার সুযোগ দেয়নি। দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর, মর্মান্তিক শাহাদাতের পূর্বে তিনি বুকভরা বেদনা নিয়ে উপলদ্ধি করে গেলেন, তিনি কতটা একা, নিঃস্ব ও রিক্ত !

লেখক: স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতা ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status