শেষের পাতা

করোনাকালে ভাড়াটিয়াদের নানা অজুহাত

তামান্না মোমিন খান

৯ আগস্ট ২০২০, রবিবার, ৯:৫৩ পূর্বাহ্ন

করোনার সুযোগ নিতে চান এক শ্রেণির ভাড়াটিয়া। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ভাড়া দিচ্ছেন না, এমন কি বাড়ি ছেড়েও যাচ্ছেন না। জীবনের সকল সঞ্চয় বিনিয়োগ করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি করেও বাড়ির মালিক এখন অসহায়। এক ভুক্তভোগী বাড়িওয়ালা জানান, ইন্দিরা রোডে তার একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এই ফ্ল্যাটে যিনি ভাড়া থাকেন কয়েক মাস থেকে তিনি ভাড়া দিচ্ছেন না। এক লাখ দশ হাজার টাকা তার কাছে পাওনা। ভাড়া চাইলেই বলেন- করোনার মধ্যে কোথা থেকে দেবো? টাকা পয়সার অবস্থা ভালো না। অথচ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাটটি কিনেছি। যা ভাড়া পেতাম ঋণ শোধে দিয়ে দিতাম। এখন ঋণের কিস্তি দিতে আমার হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ ভাবে ভাড়া বন্ধ রাখলে ক’দিন পরে হয়তো ঋণের কিস্তিও দিতে পারবো না। ব্যাংক কি আমাদের ঋণের কিস্তি মওকুফ করবে? যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে করোনাকালীন সময়ে বাড়িওয়ালাদের বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে তো বাড়িওয়ালাদের এরকম কোনো সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে না। ভাড়া না পেলে আমি চলবো কি করে? এ বছর আমি কোরবানি দিতে পারিনি। কিন্তু আমার  সেই ভাড়াটিয়া ঠিকই গরু কোরবানি দিয়েছে। সামর্থ্য থাকার পরও সে ভাড়াও দিচ্ছে না এমন কি বাড়িও ছাড়ছে না। আরেক ভুক্তভোগী বাড়িওয়ালা বলেন, বনানীতে আমার একটি ফ্ল্যাট আছে, সেখানে যিনি ভাড়া থাকতেন মার্চ মাসের শেষদিকে আমাকে না জানিয়ে তিনি বাড়ি চলে গেছেন। এখন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ নেই। তাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। ভাড়াও দিচ্ছে না। এমন কি ফ্ল্যাটের ভেতর মালপত্র রেখেই তালা মেরে দিয়ে গেছেন। এই ভাড়াটিয়া  আদৌ ফিরবে কিনা- তাও আমি জানি না। এখন আমি কী করবো সেটাও বুঝতে পারছি না। ফ্ল্যাট খালি না করলে তো ভাড়াও দিতে পারবো না। এদিকে গত এপ্রিল মাস থেকে ফ্ল্যাটের ইউটিলিটি বিল, সোসাইটির বিল আমাকেই সব দিতে হচ্ছে। এখন নিজেকে বড় অসহায় লাগছে। মনে হচ্ছে ফ্ল্যাটটি না কেনা-ই ভালো ছিল। নিজেই ভাড়াটিয়ার কাছে জিম্মি হয়ে গেছি। তেজকুনীপাড়ার এক বাড়িওয়ালি জানান,  গ্রামের ভিটামাটি বিক্রি করে, গহনা বিক্রি করে এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বহু কষ্টে তিনতলা পর্যন্ত বাড়ি করেছি। বাড়ি করতে গিয়ে আমার স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাড়ি ভাড়াই  আমাদের একমাত্র আয়ের উৎস। দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, ঋণের কিস্তির টাকা বাড়ি ভাড়া থেকেই চালাই। কিন্তু করোনার পর থেকে কিছু ভাড়াটিয়া ভাড়া দিতে চায় না। নানা অজুহাতে প্রতি মাসেই ভাড়া কম দিচ্ছে। আবার কেউ দুই মাস পর এক মাসের ভাড়া দিচ্ছে। আমার বাসায় ভাড়া থাকেন একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। তিনিও প্রতি মাসে ভাড়া কম দিতে চান। অথচ যারা সরকারি চাকরি করেন তারা তো করোনার কারণে বেতন-বোনাস কম পাচ্ছেন না। লকডাউনের সময় তারা তো অফিস না করেও পুরো মাসের বেতন পেয়েছেন। তবে তারা কেন করোনার অজুহাত দেখিয়ে কম ভাড়া দিতে চাইবেন। করোনাকে কোনো কোনো ভাড়াটিয়া সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে। অথচ সৎ রোজগারে একটি বাড়ি বানাতে গেলে কত শ্রম, কত ঘাম, কত চাপা কান্না এর মধ্যে নিহিত থাকে এটা যিনি ভুক্তভোগী তিনি ছাড়া আর কেউ বুঝবেন না। এদিকে  মোহাম্মদপুরের এক বাড়িওয়ালা জানান, দুই মাস ধরে এক ভাড়াটিয়া ভাড়া দিচ্ছে না। ভাড়া চাইতে গেলে উল্টো পুলিশের ভয় দেখায়। সেই বাড়িওয়ালা বলেন- করোনার শুরুতে অর্ধেক ভাড়া দিতো। এখন তো ভাড়া দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ভাড়া চাইতে গেলে বলে অমুক বাড়িওয়ালা ভাড়া মাফ করে দিয়েছে। অমুক বাড়িওয়ালাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে- এসব গল্প শোনায়। অথচ তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে। ফার্মগেটের এক বাড়িওয়ালা দুঃখ করে বলেন- আমরা কেমন আছি- এটা কি কেউ খবর নিয়েছে! করোনায়  যেন কিছু কিছু ভাড়াটিয়ার ভিন্নরূপ দেখতে পাচ্ছি। আমরা বাড়িওয়ালারা অমানবিক নই। যারা আসলেই করোনার কারণে সমস্যায় পড়েছে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভাড়া দিতে বলেছি। কিন্তু যারা সামর্থ্যবান- তারাই এখন ভাড়া দিতে চাইছে না। ভাড়া কমিয়ে দেয়ার বায়না ধরছে। সরকার তো আমার ঋণ কমিয়ে দিচ্ছে না। করোনার শুরুতেই ধুয়া তোলা হয় ভাড়া মওকুফের- সেখান থেকে কিছু ভাড়াটিয়া আজ সুযোগ খুঁজছে। নিজে একটি ফ্ল্যাটে থাকেন, আরেকটির ভাড়া দিয়ে সংসার চলে মণিপুরীপাড়ার এক বাড়িওয়ালার। স্বামী মারা গেছেন বছর পাঁচেক হলো। একটি কন্যা সন্তান নিয়ে তার সংসার। ফ্ল্যাট ভাড়াই তার একমাত্র আয়ের উৎস। সেই বাড়িওয়ালা জানান- আমার কষ্টের কথা আমি কাকে বলবো? করোনা আসার পর থেকে ঠিকমতো ভাড়া পাচ্ছি না। সংসার চালানো দায় হয়ে গেছে। নিজের পুঁজি ভেঙে খেতে হচ্ছে। একসময় পুঁজি শেষ হয়ে গেলে মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে। ভাড়া চাইতে গেলে বলে বাসা ছেড়ে দেবো। অথচ বাসাও ছাড়ছে না, ভাড়াও দিচ্ছে না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status