এক্সক্লুসিভ

আদ্যোপান্ত একজন ‘স্টোরি টেলার’

কাজল ঘোষ

৮ আগস্ট ২০২০, শনিবার, ৭:৪৪ পূর্বাহ্ন

সাদাত হোসাইন। তরুণ প্রজন্মের জনপ্রিয় লেখক। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘আরশিনগর’ ব্যাপক সাড়া ফেলে। এরপরের গল্প সকলেরই জানা। মানুষটির স্বপ্ন ছিল দুটি। খেয়া নৌকার মাঝি হবেন আর ছাপার অক্ষরে নিজের নামটি দেখবেন। কিন্তু দু’টি স্বপ্নই পূরণ হয়েছে। তার নামটি ছাপার অক্ষরে ফি বছর বইমেলায় আসছে। অন্যদিকে পাঠক নামক খেয়া নৌকার মাঝিও হতে চলেছেন বোধকরি তিনি।

নৃ-বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সাদাত হোসাইন পড়েছেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। রুটি-রুজির জন্য চাকরি করেছেন বিভিন্ন পত্রিকায়, বিজ্ঞাপনী সংস্থায়, ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন থেকে শুরু করে ফ্রি-ল্যান্স আলোকচিত্রী হিসেবে। ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে বেড়িয়েছেন দেশের নানা প্রান্তে। মানুষটি বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে গল্প বলতে চেয়েছেন। আর তা করতে গিয়ে নিজেই এখন গল্প। বাকিটা সাদাত হোসাইনের জবানিতেই পড়ুন।

প্রশ্ন: এই যে এতো অল্প সময়ে এতো অসংখ্য পাঠকের কাছে পৌঁছে  গেছেন, এর রহস্য বা সূত্রটা আসলে কী?
এক টিভি সাক্ষাৎকারে ঠিক এই প্রশ্নটিই করেছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন। উত্তরে আমি বলেছিলাম যে, এর কোনো স্বতঃসিদ্ধ বা সর্বজনীন সূত্র আসলে নেই। যদি থাকতো তাহলে সবাই-ই হয়তো তা অনুসরণ করতে বা আত্মস্থ করতে চাইতো। আমার মনে হয় মূল রহস্য নিজের গল্পটাকে, অনুভবটাকে ভানহীন ভাবে, অকপটে, সহজতায় নিজের মতো করে বলতে পারা। আমরা বেশির ভাগ সময়ই গল্পের চেয়ে, গল্পের অনুভবের চেয়ে সেটি প্রকাশের ধরনেই বেশি আড়ম্বর করি, জাঁকজমকপূর্ণ করি যা শ্রোতাকে কানেক্ট করতে ব্যর্থ হয়। এখন যাদের উদ্দেশ্যে গল্পটা বলছি, তারাই যদি সেটি ফিল করতে না পারেন, কানেক্ট করতে না পারেন, তাহলে সেটি মানুষ পড়বে  কেন? আমার মনে হয়েছে, আমি হয়তো আমার ভেতরে অনুভূতির  যে সহজতা রয়েছে, ভানহীনতা রয়েছে সেটি অকপটে সহজভাবে কিছুটা হলেও প্রকাশ করতে পেরেছি। যা পাঠককে কানেক্ট করতে পেরেছে।

প্রশ্ন: লেখক হিসেবে সীমাবদ্ধতার জায়গা কী বলে মনে করেন?
সীমাবদ্ধতার জায়গা এতো অসীম যে, সেটি এক বাক্যে বা দুই বাক্যে ডিফাইন করা কঠিন। তবে ছোট্ট করে বলি, দিন যতো যাচ্ছে, যতো লিখছি, পড়ছি ততোই সেই সীমাবদ্ধতার তালিকাটাকে দীর্ঘ মনে হচ্ছে।

প্রশ্ন: ‘আরশিনগর’ দিয়ে শুরু, এরপর?
এরপর তো এক স্বপ্নযাত্রার শুরু। আরশিনগর দিয়ে মূলত আমি আমার লেখক সত্তাকে আবিষ্কার করতে পেরেছি। মনে হয়েছে আমার ভেতর অসংখ্য গল্প রয়েছে সেই গল্পগুলোকে আমি বলে  যেতে চাই। যার ফলশ্রুতি মানবজনম, অন্দরমহল, নিঃসঙ্গ নক্ষত্র, নির্বাসন, অর্ধবৃত্ত। মানে একজন লেখক সাদাত হোসাইন-এর জন্ম।

প্রশ্ন: এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ফ্রাস্ট্রেশন ইজ ইওর ইন্সপায়ারেশন, এটা কীভাবে? কেন?
মাই লাইফ ইজ ফুল অফ স্ট্রাগলস। শৈশব থেকেই নানাবিধ প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই আমার যাত্রা। ফলে জীবনে অসংখ্যবার হতাশার ভয়াবহ চোরাবালিতে ডুবতে বসেছিলাম। কিন্তু আজ এখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে প্রত্যেকবার ওই হতাশায় আসলে অনুপ্রেরণার উৎস হয়েছে।

মানে ধরুন আপনি একটি মসৃণ সোজা রাস্তায় রোজ গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। কখনো প্রচুর এবড়োথেবড়ো কিংবা দুর্গম রাস্তায় গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা আপনার নেই। এখন হঠাৎ করেই তেমন পথ যদি আপনার সামনে এসে পড়ে, তখন কিন্তু আপনার পক্ষে আর  কোনোভাবেই সেটাকে অতিক্রম করা সম্ভব হবে না। কিন্তু যেই মানুষটি অমন দুর্গম পথে ড্রাইভ করে অভ্যস্ত তিনি ওই দুর্গম পথে যেমন চলতে পারবেন তেমনি মসৃণ পথেও চলতে পারবেন। অর্থাৎ তিনি সব ভাবেই প্রস্তুত। এখন আপনার জীবনে যদি সবসময় ইতিবাচক ঘটনাই ঘটতে থাকে, তাহলে হঠাৎ আসা কোনো দুঃসময়, দুর্যোগ কিংবা দুর্বিপাক কিন্তু আপনি ফেস করতে পারবেন না। কারণ সেটির অভিজ্ঞতা আপনার নেই। হতাশাটা ঠিক এইজন্যই দরকার যে, আপনি কোনো ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়লে সেটি থেকে উত্তরণের পথ আপনি খুঁজবেন। কারণ আমরা হতাশাগ্রস্ত থাকতে চাই না। আমরা হতাশা কাটিয়ে উঠতে চাই। তো হতাশা কাটিয়ে উঠতে হলে আপনাকে কী করতে হবে? ইতিবাচক কিছু করতে হবে যা আপনাকে আপনার আগের ব্যর্থতা কাটিয়ে সফল করতে সাহায্য করবে। আর এটি আপনাকে আরো কৌশলী করে, আরো দক্ষ, সতর্ক ও শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলবে।

প্রশ্ন: ফটোগ্রাফি দিয়ে গল্প বলতে গিয়ে পুরো জীবনটাই একটা গল্প হয়ে গেল, এভাবে বলা যায় কি?
যায়। আসলে আমি মনে করি জগতের সকল সৃষ্টিশীল মাধ্যমই মূলত গল্প বলে। সিনেমা, ভাস্কর্য, পেইন্টিং, উপন্যাস, ফটোগ্রাফি। সব। সো আমি আসলে গল্প বলতে চেয়েছিলাম। সেটা যেকোনো মাধ্যমেই হোক। ফটোগ্রাফি তেমন একটি গল্প বলার মাধ্যম। আমি আমার নিজেকে কিন্তু সিনেমা নির্মাতা, আলোকচিত্রী কিংবা  লেখক হিসেবে পরিচয় দেয়ার চেয়েও স্টোরি টেলার হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।

প্রশ্ন: পথ অনন্ত, আবার সময় সীমিত, তার বিপরীতে একজন সাদাত হোসাইন কে কোথায় দেখতে চান সামনের দিকে?
আমি আসলে পরিকল্পনা করে এগুতে পারি না। এর কারণও অবশ্য আছে। ছোটবেলা থেকেই আমি আমার নিজেকে বুঝতে চাইতাম। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে বুঝতে পারা। তো এই বুঝতে গিয়ে আমার মনে হলো মানুষ নিজেকেই সবচেয়ে কম  চেনে, কম খোঁজে... কারণ ধরেন, আমি আজ কিছু একটা চাইছি, কিছুদিন পরে গিয়ে মনে হলো আমি আসলে ওটা চাইনি। আমি অন্যকিছু  চেয়েছিলাম, কিন্তু ভুল করে ওটা তখন চেয়েছিলাম। এই  যে ভাবনা, এটা আমাদের অহরহ হয়। এ কারণে আমি আগেভাগে কিছু চাই না। পরিকল্পনা করি না। তবে হ্যাঁ, যদি সেভাবে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, তবে বলবো আমি গল্প বলে যেতে চাই। আমি অন্যের ক্ষতি না করে আমার ভালোলাগার কাজগুলো করে যেতে চাই। এটুকুই।

প্রশ্ন: লেখালেখি নিয়ে সিরিয়াস স্বপ্ন ছিল না তাহলে লেখা থেকে উপার্জনই কি লেখক হতে বাধ্য করলো?
আপনি চাইলেই কিন্তু লেখালেখি করে উপার্জন করতে বা সেটি দিয়ে পুরোপুরি জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন না। এবং আমাদের  দেশের পারসপেক্টিভ-এ সেটি আরো কঠিন। আমি আসলে আমার ভালো লাগা এবং সক্ষমতা বা সামর্থ্যকে একীভূত করতে চেয়েছি। এটি কঠিন কাজ। প্রথমত নিজের সক্ষমতা খুঁজে বের করা। দ্বিতীয়ত, সেটির সঙ্গে নিজের ভালো লাগাটাকে মেলানো। তো ফরচ্যুনেটলি আমার ক্ষেত্রে এই দুটি মিলে গেছে। এবং সেই মিলে যাওয়াটা পরবর্তীতে আপনা আপনিই উপার্জনের উৎস হয়ে উঠেছে। এমন নয় যে, আমি পরিকল্পনা করে এটি করেছি।

প্রশ্ন: বাণিজ্যিক লেখালেখির বাণিজ্যিক মূল্য একটা নিশ্চয়ই আছে কিন্তু বাণিজ্যিক বা ফরমায়েশি লেখায় সৃজনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিনা? আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায় কি?
আমি মনে করি, এই দুটোর মধ্যে তফাৎ খুব সূক্ষ্ম। কারণ আপনি সৃজনশীল না হলে কখনোই বাণিজ্যিক হতে পারবেন না। বরং বাণিজ্যিক হতে হলেও আপনাকে আরো বেশি সৃজনশীল হতে হবে। আপনিই বলুন, যে সিনেমাটি তথাকথিত বাণিজ্যিকভাবে সফল, সেটি যে অসংখ্য মানুষের মনোজগৎকে স্পর্শ করেছে, এই স্পর্শ করা কি একজন চিত্রনাট্যকার, নির্মাতা কিংবা অভিনয় শিল্পীর পক্ষে সম্ভব, যদি তাদের সৃজনশীলতা না থাকে? সম্ভব নয়। লিটারেচারের ক্ষেত্রেও একই কথা। এখন প্রশ্ন হতে পারে সৃজনশীলতার ধরন নিয়ে যেকোনোটিকে আপনি সৃজনশীল বলবেন আর কোনটিকে বলবেন না। তো এটাও খুবই রিলেটিভ টার্ম বা আইডেন্টিফিকেশন। আমি মনে করি না ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা নিয়ে আমার বিশদ ব্যখ্যা আছে।

প্রশ্ন: নানা মাধ্যমে কাজ করেন। ফটোগ্রাফি, নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, কথাসাহিত্যিক। কোন পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চান বা বড় মনে হয়?
উপরেই বলেছি, স্টোরি ট্রেলার। আমি আমার সক্ষমতা রয়েছে এমন সকল সৃজনশীল মাধ্যমে গল্প বলতে চাই
প্রশ্ন: ব্যক্তি সাদাত আর লেখক সাদাত এই দু’জনের মধ্যে কোন বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব  তৈরি হয় কিনা?
কম। আমি আমার অনুভূতি, গল্প ও চিন্তার জায়গায় ভানহীন থাকতে চাই। তবে লেখকের যাপন আর চিন্তার ফারাক থাকেই।

প্রশ্ন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদেরকে অনেক অ-জনপ্রিয় বিষয়েও জনপ্রিয়তা এনে দিচ্ছে। আমরাও সেই দৌড়ে আছি। আপনার কি মনে হয়, লেখকের সৃষ্টিশীলতা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সেই চাকুর মতো যা একজন খুনির হাতে থাকলে মানুষের জীবন সংহার করে আর ডাক্তারের কাছে থাকলে মানুষের জীবন বাঁচায়। এখন সিদ্ধান্ত আপনার, সেটিকে আপনি কীভাবে ব্যবহার করবেন। আমি খুব ইতিবাচকভাবে দেখি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে।

প্রশ্ন: করোনাকালে কি লিখলেন, কি পড়লেন? এ সময়ের লেখালেখি আর লেখা নিয়ে আপনার ভাবনা?
প্রথম আলো পত্রিকার ঈদ সংখ্যার জন্য উপন্যাস লিখলাম, ‘বিভা ও বিভ্রম’। কলকাতার বিখ্যাত পত্রভারতীর শিশুভারতী পত্রিকার শারদীয় সংখ্যার জন্য গল্প লিখছি। রেজা সিরিজ নামে আমার একটি থ্রিলার উপন্যাস আছে। সেটির পরের বইটি লিখছি ‘শেষ অধ্যায় নেই’। আমি আসলে সবসময়ই কিছু না কিছু লিখতে থাকি। আমি এটা উপভোগ করি।

পড়েছি অনেক এই সময়ে। প্রচুর সিনেমা, টিভি সিরিজ  দেখেছি। ওই যে বললাম না, আমার গল্প বলায় ভীষণ আগ্রহ। গল্প  শোনায়ও। সো সকল মাধ্যমেই আমি গল্পটা শুনতেও চাই। সেটি বই, সিনেমা, টিভি সিরিজ  যেকোনো কিছু।

এই সময়ে তরুণরা দারুণ লিখছে। প্রচুর পাঠক তৈরি করছে তারা। এটি চমৎকার একটি ব্যাপার।



   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status