বিশ্বজমিন
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন
কাঁচের টুকরা, ঝাঁঝালো ধোঁয়া ও রক্তাক্ত সিঁড়ি
মানবজমিন ডেস্ক
৬ আগস্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৮:১৫ পূর্বাহ্ন
পুরো বিশ্ব যখন কেঁপে উঠলো, ঘড়ির কাঁটা তখন সন্ধ্যা ৬টার ঘর পার করেছে। বিস্ফোরণস্থল হতে এক মাইল দূরে অবস্থিত সাসিন স্কয়ার থেকে মনে হচ্ছিল, যেন কোনো গাড়িবোমা বা গ্যাস বিস্ফোরণ ঘটেছে- একটি বিপর্যয়, কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ের বিপর্যয়। কেবল ভূমধ্যসাগরগামী রাস্তা থেকে ধ্বংসের মাত্রা পরিষ্কারভাবে বোঝা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ভবনগুলো থেকে ছিটকে পড়ে ভাঙা কাঁচের টুকরার চাদরে ঢেকে গিয়েছিল রাস্তাগুলো। একাধিক রাস্তার এক ব্যস্ত সংযোগস্থলে রক্তাক্ত মাথার তিন নারী হাতে কাপড়ের টুকরা নিয়ে বসে ছিল। সবদিক দিয়েই মনে হচ্ছিল বৈরুতে হামলা হয়েছে: টায়ারের নিচে ভাঙা কাঁচের টুকরা পড়ে ছিল, সাইরেন বাজছিল, বাতাসে ঝাঁঝালো ধোঁয়ার গন্ধ ছড়িয়েছিল।
৪ঠা আগস্ট বৈরুতের বন্দরে ঘটা বিস্ফোরণের মাত্রা ছিল বিশাল। সুদূর সাইপ্রাসের বাসিন্দারাও এর প্রভাব অনুভব করেছে। জর্ডানের সিসমোলজিক্যাল পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিয়েছে, এটি ছোটখাটো ভূমিকমেপর সমান ছিল। এর প্রভাবে বৈরুতের বেশির ভাগ অংশই পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। বিস্ফোরণের পর একদিনের মাথায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে অন্তত ১৩৫ জনে পৌঁছায়। উদ্ধারকর্মীরা এখনো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। মৃতের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বাড়বে। আহত হয়েছেন আরো ৫ হাজার মানুষ। ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য কয়েকশ’ কোটি ডলার ছাড়াবে নিশ্চিতভাবেই। এমন পরিমাণ অর্থ খরচের সক্ষমতা নেই লেবাননের।
যতদূর বোঝা যাচ্ছে, এই বিস্ফোরণ অবহেলার ফল। লেবানন সরকারের অধঃপতিত মানদণ্ড বিবেচনায়ও এ অবহেলা পিলে চমকে দেয়ার মতো। ২০১৩ সালে লেবানন সরকার অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইটের একটি রুশ মালিকানাধীন কার্গো জব্দ করে। এই রাসায়নিক পদার্থটি কৃত্রিম সার এবং খনন ও পাথর খোঁড়ার বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। জব্দ করা ২৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম মজুত করে রাখা হয়েছিল বন্দরের এক গুদামঘরে। জনবহুল একটি জায়গায় বিশাল এই বোমা মজুত করার বিপদ সম্পর্কে অনেক রাজনীতিকই তখন সতর্ক করেছিলেন। তবে তাদের সতর্কবার্তা কেউ আমলে নেননি। উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা শহরে বোমারুরা মাত্র ২ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইট ব্যবহার করে ১৬৮ জন মানুষকে হত্যা করেছিল।
ঠিক কীভাবে অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইটের গুদাম ঘরে আগুন লেগেছিল তা এখনো অস্পষ্ট। স্থানীয় গণমাধ্যম অনুসারে, ভবনটির কাছেই ঝালাই দেয়ার কাজ করছিল। তবে যে কারণেই হোক, এর ফলে সৃষ্টি হয়েছিল আগুনের বিশাল এক গোলা, যার প্রভাবে সৃষ্ট শকওয়েভ বৈরুতের অর্ধেকজুড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। সারারাত ধরে শহরের আকাশে উড়ছিল লালচে ধোঁয়া। টিভিতে দেয়া বক্তব্যে বিজ্ঞানীরা স্থানীয় বাসিন্দাদের তাদের জানালা বন্ধ রাখতে বলেছে ও মাস্ক পরতে বলেছে। কারণ, সে লালচে ধোঁয়ায় মিশে ছিল নাইট্রিক এসিড।
সম্প্রতি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় লেবাননের হাসপাতালগুলোর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) অবস্থা আগ থেকেই নাজুক ছিল। কোনো হাসপাতালই একরাতে হাজার হাজার মানুষকে জরুরি সেবা দেয়ার অবস্থায় ছিল না। বিস্ফোরণস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সেইন্ট জর্জ হাসপাতাল এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, চিকিৎসকদের সার্জারি থামিয়ে ভবন খালি করতে হয়েছে। ভবনের ভেতরই মারা যান চার নার্স ও ১৫ রোগী। অন্য রোগীদের হাসপাতালের গাউন পরে, হাতে আইভি লাইন লাগানো অবস্থায় রক্তাক্ত ও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রাস্তার ওপারের পার্কে বসে থাকতে হয়েছে। হাসপাতালটির এক নিউরোসার্জন বলেন, এটা সর্বনাশা। এর জন্য আর কোনো শব্দ নেই। নিকটবর্তী অপর এক এপার্টমেন্ট ভবনের সিঁড়ি রক্তে পিচ্ছিল হয়ে যায়। ভবনের বাসিন্দারা তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঘর ছেড়ে পালান। অসংখ্য ঘরের দরজা খুলে উড়ে গেছে, বাদ যায়নি ফার্নিচারও। লেবাননের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ শতাংশ, আনুমানিক ৩ লাখ মানুষ ঘরহারা হন এদিন। কেউ কেউ বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছেন। বাকিদের যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। মেঝের ভাঙা কাঁচ পরিষ্কার করে, দরজা-জানালা বিদ্যুৎবিহীন ঘরেই রাত কাটিয়েছে তারা। পরদিন সকালেও অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। পরিষ্কার করা কাঁচের টুকরো ফেলার জায়গা সংকুলান হয়নি। পথচারীরা সন্ত্রস্ত হয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে, কে জানে কখন মাথার উপর কোনো ভবনের ধ্বংসাবশেষ পড়ে যায় কিনা।
দেশের ভালো সময়েই এই ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করতে দীর্ঘ সময় লাগার কথা। লেবাননে এখন ভালো সময় চলছে না। অক্টোবর থেকে ধস নেমেছে অর্থনীতিতে। দেশটির মুদ্রাস্ফীতি এক দশকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশটির মুদ্রা পাউন্ডের বিনিময়মূল্য কয়েক দশক ধরে এক ডলার সমান ১৫০০ পাউন্ড ছিল। কিন্তু এই নির্দিষ্ট বিনিময়মূল্য ধরে রাখার জন্য পর্যাপ্ত ডলার নেই লেবাননে। ক্রমেই বাড়ছে তাদের বাণিজ্য ঘাটতি। কয়েক বছর ধরে লেবাননের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে মোটা সুদে ডলার ঋণ নিয়ে চলছিল। কিন্তু এই পনজি স্কিমও আর বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না তারা। কালোবাজারে এক ডলার সমান এখন ৮ হাজার পাউন্ড ধরে বিনিময় হচ্ছে। সরকারি দরের চেয়ে এই মুদ্রাস্ফীতি ৮০ গুণ বেশি। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গত মার্চে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়।
বেশির ভাগ লেবানিজের জন্য জীবনযাপন সীমাহীন সংকটে জর্জরিত। মুদ্রাস্ফীতি চলছে ৫০ শতাংশের বেশি। খাদ্যের জন্য তা প্রায় ২০০ শতাংশ। নেসক্যাফের একটি ৫০০ গ্রামের বয়াম সর্বনিম্ন মাসিক মজুরির ১০ শতাংশের সমান। এক কেজি মাংসের মূল্য ১৫ শতাংশের সমান। সেনাবাহিনীতে সেনাদের মাংস খাওয়ানো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ৩০শে জুন সরকার পাউরুটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে এক-তৃতীয়াংশ। দেশের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা দরিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। এই বছরের শেষে চার ভাগের তিন ভাগেরই ত্রাণ লাগতে পারে।
জ্বালানি ঘাটতিতে বাড়ছে লোডশেডিং। বৈরুতে প্রতিদিন অন্তত তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। জুলাইয়ে এক পর্যায়ে তা ২০ ঘণ্টা ছাড়িয়েছিল। দেশটির শীর্ষ টেলিকম কোমপানি ওগেরো জানিয়েছে, জ্বালানির অভাবে তাদের স্টেশনগুলোয় বিদ্যুৎ না থাকলে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এদিকে, বাড়ছে ছিঁচকে অপরাধ। আর্থিক খাতের লোকসান নিয়ে বিতর্ক চলছে পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিপরিষদে। গত এপ্রিলে প্রকাশিত এক পরিকল্পনা প্রকাশ করে সরকার। ওই পরিকল্পনা মেনে চললে, সরকার অনুমান করেছে যে, কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১৫৪ ট্রিলিয়ন পাউন্ড লোকসান হতে পারে। এরপরই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আলোচনা শুরু হয় সরকারের। কিন্তু সরকারের পরিকল্পনা নিয়ে ক্ষুব্ধ ব্যাংকগুলো। এই পরিকল্পনায় চরম ক্ষতির শিকার হবে অসংখ্য শেয়ারহোল্ডার, আমানতকারী। দেশের এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আঘাত হানলো মঙ্গলবারের বিপর্যয়। কেবল বন্দরের মেরামতেই খরচ হবে কয়েক কোটি ডলার। বিস্ফোরণে লেবাননের প্রধান খাদ্যশস্যের ভাণ্ডারটিও ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশে মাত্র একমাসেরও কম গম সরবরাহ মজুত রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের মালিকরা বাড়ি মেরামতের খরচ নিয়ে উদ্বিগ্ন। অনেকে হয়তো মেরামতই করবেন না। সরকার এ বিস্ফোরণের পেছনে দায়ীদের খুঁজে বের করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে আদতে তা হবে কেবল পাঁঠার বলি খুঁজে বের করার চেষ্টা, গুরুতর কোনো তদন্ত নয়।
লেবাননের রাস্তায় ক্ষোভ দেখা গেছে। কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়া মানুষও আছেন। আধুনিক ইতিহাসের বেশির ভাগজুড়েই দুর্দশা দেখেছে লেবানন: ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ, ইসরাইল ও সিরিয়ার দখলীকরণ, ২০০৬ সালে ইসরাইলের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধসহ অন্যান্য আরো বহু সংঘাত। একসময় লেবানিজরা ভেঙে পড়া সমাজ গড়ায় গর্বের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তো। তবে এবারের পরিস্থিতি অন্যরকম লাগে। অর্থনৈতিক মডেল ব্যর্থ হয়েছে, গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে ক্ষমতার ধর্মভিত্তিক বণ্টনও খুব কাজে দেয়নি। হারিয়ে গেছে গত অক্টোবরের সপৃহা, যখন হাজারো লেবানিজ সরকার উৎখাতে রাস্তায় নেমে এসেছিল। এখন অনেকের কাছে দেশ ছেড়ে যেতে পারাটাই যেন এক ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা স্বপ্নের মতো।
(দ্য ইকোনমিস্টের অনলাইন সংস্করণে ৫ই আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনের সংক্ষেপিত ভাবানুবাদ।)
৪ঠা আগস্ট বৈরুতের বন্দরে ঘটা বিস্ফোরণের মাত্রা ছিল বিশাল। সুদূর সাইপ্রাসের বাসিন্দারাও এর প্রভাব অনুভব করেছে। জর্ডানের সিসমোলজিক্যাল পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিয়েছে, এটি ছোটখাটো ভূমিকমেপর সমান ছিল। এর প্রভাবে বৈরুতের বেশির ভাগ অংশই পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। বিস্ফোরণের পর একদিনের মাথায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে অন্তত ১৩৫ জনে পৌঁছায়। উদ্ধারকর্মীরা এখনো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। মৃতের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বাড়বে। আহত হয়েছেন আরো ৫ হাজার মানুষ। ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য কয়েকশ’ কোটি ডলার ছাড়াবে নিশ্চিতভাবেই। এমন পরিমাণ অর্থ খরচের সক্ষমতা নেই লেবাননের।
যতদূর বোঝা যাচ্ছে, এই বিস্ফোরণ অবহেলার ফল। লেবানন সরকারের অধঃপতিত মানদণ্ড বিবেচনায়ও এ অবহেলা পিলে চমকে দেয়ার মতো। ২০১৩ সালে লেবানন সরকার অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইটের একটি রুশ মালিকানাধীন কার্গো জব্দ করে। এই রাসায়নিক পদার্থটি কৃত্রিম সার এবং খনন ও পাথর খোঁড়ার বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। জব্দ করা ২৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম মজুত করে রাখা হয়েছিল বন্দরের এক গুদামঘরে। জনবহুল একটি জায়গায় বিশাল এই বোমা মজুত করার বিপদ সম্পর্কে অনেক রাজনীতিকই তখন সতর্ক করেছিলেন। তবে তাদের সতর্কবার্তা কেউ আমলে নেননি। উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা শহরে বোমারুরা মাত্র ২ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইট ব্যবহার করে ১৬৮ জন মানুষকে হত্যা করেছিল।
ঠিক কীভাবে অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইটের গুদাম ঘরে আগুন লেগেছিল তা এখনো অস্পষ্ট। স্থানীয় গণমাধ্যম অনুসারে, ভবনটির কাছেই ঝালাই দেয়ার কাজ করছিল। তবে যে কারণেই হোক, এর ফলে সৃষ্টি হয়েছিল আগুনের বিশাল এক গোলা, যার প্রভাবে সৃষ্ট শকওয়েভ বৈরুতের অর্ধেকজুড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। সারারাত ধরে শহরের আকাশে উড়ছিল লালচে ধোঁয়া। টিভিতে দেয়া বক্তব্যে বিজ্ঞানীরা স্থানীয় বাসিন্দাদের তাদের জানালা বন্ধ রাখতে বলেছে ও মাস্ক পরতে বলেছে। কারণ, সে লালচে ধোঁয়ায় মিশে ছিল নাইট্রিক এসিড।
সম্প্রতি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় লেবাননের হাসপাতালগুলোর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) অবস্থা আগ থেকেই নাজুক ছিল। কোনো হাসপাতালই একরাতে হাজার হাজার মানুষকে জরুরি সেবা দেয়ার অবস্থায় ছিল না। বিস্ফোরণস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সেইন্ট জর্জ হাসপাতাল এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে, চিকিৎসকদের সার্জারি থামিয়ে ভবন খালি করতে হয়েছে। ভবনের ভেতরই মারা যান চার নার্স ও ১৫ রোগী। অন্য রোগীদের হাসপাতালের গাউন পরে, হাতে আইভি লাইন লাগানো অবস্থায় রক্তাক্ত ও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রাস্তার ওপারের পার্কে বসে থাকতে হয়েছে। হাসপাতালটির এক নিউরোসার্জন বলেন, এটা সর্বনাশা। এর জন্য আর কোনো শব্দ নেই। নিকটবর্তী অপর এক এপার্টমেন্ট ভবনের সিঁড়ি রক্তে পিচ্ছিল হয়ে যায়। ভবনের বাসিন্দারা তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঘর ছেড়ে পালান। অসংখ্য ঘরের দরজা খুলে উড়ে গেছে, বাদ যায়নি ফার্নিচারও। লেবাননের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ শতাংশ, আনুমানিক ৩ লাখ মানুষ ঘরহারা হন এদিন। কেউ কেউ বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছেন। বাকিদের যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। মেঝের ভাঙা কাঁচ পরিষ্কার করে, দরজা-জানালা বিদ্যুৎবিহীন ঘরেই রাত কাটিয়েছে তারা। পরদিন সকালেও অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। পরিষ্কার করা কাঁচের টুকরো ফেলার জায়গা সংকুলান হয়নি। পথচারীরা সন্ত্রস্ত হয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে, কে জানে কখন মাথার উপর কোনো ভবনের ধ্বংসাবশেষ পড়ে যায় কিনা।
দেশের ভালো সময়েই এই ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করতে দীর্ঘ সময় লাগার কথা। লেবাননে এখন ভালো সময় চলছে না। অক্টোবর থেকে ধস নেমেছে অর্থনীতিতে। দেশটির মুদ্রাস্ফীতি এক দশকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশটির মুদ্রা পাউন্ডের বিনিময়মূল্য কয়েক দশক ধরে এক ডলার সমান ১৫০০ পাউন্ড ছিল। কিন্তু এই নির্দিষ্ট বিনিময়মূল্য ধরে রাখার জন্য পর্যাপ্ত ডলার নেই লেবাননে। ক্রমেই বাড়ছে তাদের বাণিজ্য ঘাটতি। কয়েক বছর ধরে লেবাননের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে মোটা সুদে ডলার ঋণ নিয়ে চলছিল। কিন্তু এই পনজি স্কিমও আর বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না তারা। কালোবাজারে এক ডলার সমান এখন ৮ হাজার পাউন্ড ধরে বিনিময় হচ্ছে। সরকারি দরের চেয়ে এই মুদ্রাস্ফীতি ৮০ গুণ বেশি। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গত মার্চে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়।
বেশির ভাগ লেবানিজের জন্য জীবনযাপন সীমাহীন সংকটে জর্জরিত। মুদ্রাস্ফীতি চলছে ৫০ শতাংশের বেশি। খাদ্যের জন্য তা প্রায় ২০০ শতাংশ। নেসক্যাফের একটি ৫০০ গ্রামের বয়াম সর্বনিম্ন মাসিক মজুরির ১০ শতাংশের সমান। এক কেজি মাংসের মূল্য ১৫ শতাংশের সমান। সেনাবাহিনীতে সেনাদের মাংস খাওয়ানো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ৩০শে জুন সরকার পাউরুটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে এক-তৃতীয়াংশ। দেশের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা দরিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। এই বছরের শেষে চার ভাগের তিন ভাগেরই ত্রাণ লাগতে পারে।
জ্বালানি ঘাটতিতে বাড়ছে লোডশেডিং। বৈরুতে প্রতিদিন অন্তত তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। জুলাইয়ে এক পর্যায়ে তা ২০ ঘণ্টা ছাড়িয়েছিল। দেশটির শীর্ষ টেলিকম কোমপানি ওগেরো জানিয়েছে, জ্বালানির অভাবে তাদের স্টেশনগুলোয় বিদ্যুৎ না থাকলে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এদিকে, বাড়ছে ছিঁচকে অপরাধ। আর্থিক খাতের লোকসান নিয়ে বিতর্ক চলছে পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিপরিষদে। গত এপ্রিলে প্রকাশিত এক পরিকল্পনা প্রকাশ করে সরকার। ওই পরিকল্পনা মেনে চললে, সরকার অনুমান করেছে যে, কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১৫৪ ট্রিলিয়ন পাউন্ড লোকসান হতে পারে। এরপরই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আলোচনা শুরু হয় সরকারের। কিন্তু সরকারের পরিকল্পনা নিয়ে ক্ষুব্ধ ব্যাংকগুলো। এই পরিকল্পনায় চরম ক্ষতির শিকার হবে অসংখ্য শেয়ারহোল্ডার, আমানতকারী। দেশের এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আঘাত হানলো মঙ্গলবারের বিপর্যয়। কেবল বন্দরের মেরামতেই খরচ হবে কয়েক কোটি ডলার। বিস্ফোরণে লেবাননের প্রধান খাদ্যশস্যের ভাণ্ডারটিও ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশে মাত্র একমাসেরও কম গম সরবরাহ মজুত রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের মালিকরা বাড়ি মেরামতের খরচ নিয়ে উদ্বিগ্ন। অনেকে হয়তো মেরামতই করবেন না। সরকার এ বিস্ফোরণের পেছনে দায়ীদের খুঁজে বের করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে আদতে তা হবে কেবল পাঁঠার বলি খুঁজে বের করার চেষ্টা, গুরুতর কোনো তদন্ত নয়।
লেবাননের রাস্তায় ক্ষোভ দেখা গেছে। কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়া মানুষও আছেন। আধুনিক ইতিহাসের বেশির ভাগজুড়েই দুর্দশা দেখেছে লেবানন: ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ, ইসরাইল ও সিরিয়ার দখলীকরণ, ২০০৬ সালে ইসরাইলের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধসহ অন্যান্য আরো বহু সংঘাত। একসময় লেবানিজরা ভেঙে পড়া সমাজ গড়ায় গর্বের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তো। তবে এবারের পরিস্থিতি অন্যরকম লাগে। অর্থনৈতিক মডেল ব্যর্থ হয়েছে, গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে ক্ষমতার ধর্মভিত্তিক বণ্টনও খুব কাজে দেয়নি। হারিয়ে গেছে গত অক্টোবরের সপৃহা, যখন হাজারো লেবানিজ সরকার উৎখাতে রাস্তায় নেমে এসেছিল। এখন অনেকের কাছে দেশ ছেড়ে যেতে পারাটাই যেন এক ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা স্বপ্নের মতো।
(দ্য ইকোনমিস্টের অনলাইন সংস্করণে ৫ই আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনের সংক্ষেপিত ভাবানুবাদ।)