এক্সক্লুসিভ
বিশ্বমানের স্টার্ট আপ নিয়ে আমাদের তরুণরাও কাজ করছে
কাজল ঘোষ
৭ আগস্ট ২০২০, শুক্রবার, ৭:২৯ পূর্বাহ্ন
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে হবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে সকল বিষয় যুক্ত করা প্রয়োজন তা করতে হবে। এসবের বাইরে বাংলা এবং ইংরেজি শুদ্ধ লেখার চর্চা করতে হবে। শুদ্ধভাবে লিখতে পারা জরুরি এই জন্য যে, মানুষের সৃজনশীল চিন্তার প্রকাশ সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হলে তা লেখার মাধ্যমেই করতে হবে
প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশে দক্ষ জনবলের অভাব বলে মনে করেন প্রযুক্তি বিজ্ঞানী নোবেল খন্দকার। তিনি এও মনে করেন, দেশে অনেক তরুণ যে ধরনের স্টার্ট আপ নিয়ে কাজ করছেন তা বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে ভালো। কিন্তু দুর্বল দিক হচ্ছে, যারাই তৈরি হচ্ছেন তারা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তরুণ এই প্রযুক্তি বিজ্ঞানীর মুখ্য ভূমিকায় ‘করোনা ট্রেসার বিডি’ অ্যাপস তৈরি হয়। যার মাধ্যমে আপনি কোনো করোনাবহনকারী ব্যক্তির সংস্পর্শে ছিলেন কিনা তার স্বয়ংক্রিয় সংকেত পেয়ে যাবেন। এটি সিঙ্গাপুর, ভারত, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই চালু হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিদ্যায় অনার্স করে নোবেল পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার নেব্রাস্কা ইউনিভার্সিটি থেকে করেন কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। তারপর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে করেন পিএইচডি। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই কাজ শুরু করেন অ্যাপলিকেশন ডেভেলপার হিসেবে। পরে ‘সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ইন টেস্ট’ পদে মাইক্রোসফটে যোগ দেন ২০১১ সালে। ২০১৩-তে মাইক্রোসফটে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে কাজ শুরু করেন। ২০১৮-তে ‘লিড সিনিয়র সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে আসীন হন। এ পদে কাজ করার সময়ই ২০১৯ সালে সিদ্ধান্ত নেন দেশে ফিরে কাজ করবেন এ সেক্টরে। যোগ দেন সহজ ডট কম-এ ভাইস প্রেসিডেন্ট (টেকনোলজি) পদে। বর্তমানে দেশের আইটি সেক্টর, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে দুর্বল দিকগুলো কি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তিনি কথা বলেন মানবজমিনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:
মাইক্রোসফট ছেড়ে দেশে এসেছেন এক বছর, কেমন দেখছেন ডিজিটাল বাংলাদেশ?
এক বছরের অভিজ্ঞতা মিশ্র। উনিশ বছর আগে দেশ ছেড়েছিলাম। তখন দেশকে যে অবস্থায় দেখে গিয়েছি বর্তমান তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কম্পিউটারের সহজলভ্যতা এবং ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনের ব্যাপ্তি বেড়েছে বহুগুণ। হাতে হাতে এখন পৌঁছে গেছে প্রযুক্তি। তবে অগ্রগতি যেমন হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়েছেও। বিশেষত প্রযুক্তি ক্ষেত্রে পড়াশোনার দৌড়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে আছে। দেশের বাইরে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে ধরনের গবেষণা হচ্ছে সে জায়গায় আমাদের যেভাবে এগিয়ে আসা দরকার তা একেবারেই হচ্ছে না। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তরুণরা যে ধরনের স্টার্ট আপ উদ্ভাবন করছে তা উৎসাহব্যঞ্জক। নতুন উদ্যোক্তারা চমৎকার সব কাজ করছে। অনেক ক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়েও ভালো কাজ করছে দেশের তরুণ-তরুণীরা।
গত এক বছরে দেশের প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
মিশ্র অভিজ্ঞতাই বলবো। এদেশে যারা নতুন কাজ করছে তেমন বেশকিছু ক্ষেত্রে আমি নেতৃত্ব দিচ্ছি। আমাদের দেশে এখন এ সেক্টরে প্রচুর পরিশ্রমী ও মেধাবী তরুণ কাজ করছে এটা আশার বিষয়। তবে সমস্যা হচ্ছে কোনো কোম্পানি বা সংস্থা চালাতে গেলে যে বিপুল পরিমাণ দক্ষ জনবল দরকার তার অভাব বা ঘাটতি রয়েছে। এর দুটি কারণ আমি দেখতে পাই। প্রথমত যারা কাজ শিখছেন তারা দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। আর ফিরছেন না। অন্যদিকে, আমাদের এখানে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে পরিমাণ জনশক্তি দরকার তত সংখ্যক জনবল তৈরি হচ্ছে না। শুধু প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকলেই সবটা হবে তা নয়, নিজেকে বিশ্বমানের হিসেবেও গড়ে তুলতে হবে। আমি নিজেও সহজ ডটকমের একটি স্টার্ট আপে যুক্ত আছি। তারা একটি বিশ্বমানের স্টার্ট আপ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সক্ষমতার সঙ্গে পরিচালনা করছেন। এটা যে শুধু সহজ ডটকম করছে তা নয়, এর বাইরেও আরো অনেকেই খুব ভালো কাজ করছেন।
করোনা ট্রেসার বিডি অ্যাপসের নেপথ্যের গল্প বলবেন কি? কেমন সাড়া পেয়েছেন?
এই অ্যাপসটি তৈরি করার জন্য তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সহজ ডটকমের সিইও মালিহা কাদিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আমরা যে রাইড শেয়ারিং অ্যাপসটি অপারেট করি তাতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কে কোথায় যাচ্ছেন বা কখন যাবেন তা নিয়েই মূল কাজ। আর আমরা তা করি অ্যাপস-এর মাধ্যমেই। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই সরকার এমন একটি অ্যাপস তৈরির কথা চিন্তা করে যাতে করোনা রোগী পাশে থাকলে অ্যালার্ট বা সংকেত প্রদান করবে। আমাদেরকে এটি তৈরিতে সময় দেয়া হয়েছিল মাত্র তিন সপ্তাহ।
অ্যাপসটি তৈরিতে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল দুটি। একটি হচ্ছে এত অল্প সময়ে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপস তৈরি করা। অন্যদিকে এটি পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের আদলে মানসম্পন্ন করে তৈরি করতে হবে। অ্যাপসটিকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন দিনে গড়ে ৫০ লাখ মানুষ তা ব্যবহার করতে পারে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের তথ্য ধারণ করা, অনুসরণ করার সক্ষমতাও থাকতে হবে অ্যাপসটির। আবার বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতেও পারবে। আমরা সেই চ্যালেঞ্জটিতে সফল হয়েছি। সরকারের পক্ষেও ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছি। বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এবং আমাদের সিইও মালিহা কাদির সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেছেন। মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যেই আমরা এই অ্যাপসটি নিয়ে মানুষের কাছে হাজির হতে পেরেছি। এ নিয়ে আমরা ভারতীয় আরোগ্য সেতু অ্যাপস তৈরি করেছে যারা সেই টিমের সঙ্গেও কথা বলেছি। এত অল্প সময়ে এ মুহূর্তের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় একটি অ্যাপস তৈরি সত্যিই ছিল চ্যালেঞ্জের কাজ।
এটি করতে গিয়ে আমরা আরও সহযোগিতা পেয়েছি আইইডিসিআর-এর পরিচালক ডা. মীর জাদি সাবরীনা এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের। কারণ এই অ্যাপসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে মেডিকেল টার্ম। কাছাকাছি দু’জন মানুষ অবস্থান করলে কীভাবে শনাক্ত করবো বা সেই সংকেত কীভাবে পাওয়া যাবে? এ বিষয়টির প্রায়োগিক জায়গাটির একটি বড় অংশ চিকিৎসা বিজ্ঞানের। তবে আশার দিক হচ্ছে এই অল্প সময়ে ৭ লাখ মানুষ এই অ্যাপসটি ব্যবহার করছে। প্রতিদিনই এতে নতুন নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছেন।
আমাদের তরুণরা দলে দলে আইটি মুখী হচ্ছে, সঠিকপথে এগুচ্ছে কিনা?
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে হবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে সকল বিষয় যুক্ত করা প্রয়োজন তা করতে হবে। এসবের বাইরে বাংলা এবং ইংরেজি শুদ্ধ লেখার চর্চা করতে হবে। শুদ্ধভাবে লিখতে পারা জরুরি এই জন্য যে, মানুষের সৃজনশীল চিন্তার প্রকাশ সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হলে তা লেখার মাধ্যমেই করতে হবে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃজনশীল চিন্তা করার যে ক্ষমতা তার বিশাল ঘাটতি আছে। একজন শিক্ষার্থী হয়তো অঙ্ক শিখেছে, বিজ্ঞান শিখেছে কিন্তু তার সেই অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখছে তা আর কার্যক্ষেত্রে মিলছে না। সৃজনশীল চিন্তার চর্চা কম থাকায় এমনটি হচ্ছে। কিন্তু এই শিক্ষার্থীই যখন বাইরে যাচ্ছে তখন সেই দেশের পদ্ধতিগুলো সে খুব দ্রুতই আয়ত্ত করতে পারছে। কীভাবে সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ ঘটানো যায় তা আমাদের শিক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা খুবই জরুরি বলে মনে হয়। ইংরেজিতে একেই ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং বা ক্রিটিক্যাল অ্যানালাইসিস বলা হয়।
দেশের আইটি সেক্টরে কোনো ভুলভ্রান্তি চোখে পড়ে কিনা?
ভুলভ্রান্তি বলবো না তবে আমাদের এখানে দরকার ব্যাপক সংখ্যায় দক্ষ জনবল। যারা আমাদের তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কাজ করবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যারাই একটু দক্ষ হয়ে উঠছেন তারা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। বিশ্বে যে ধরনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদেরও এক্ষেত্রে দক্ষ জনবল তৈরির কাজটি আগে করতে হবে।
দেশ একদিকে ডিজিটাল হচ্ছে আবার নানামুখী নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টাও হচ্ছে- এটা দ্বিমুখিতা নয় কি?
এর ভালোমন্দ দু’টি দিকই রয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তিকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করার একটি ভয়াবহ দিক আছে। শুধু আমাদের এখানে নয় বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারের কারণে অনেক তরুণ তরুণী আত্মহত্যা করেছে। এত প্রয়োজনীয় যে মাধ্যম তার একটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে এটি। তাই বলে প্রযুক্তিকে তো আর থামিয়ে রাখা যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এর নিয়ন্ত্রণ কীভাবে হবে? এটা কি রাষ্ট্র করবে? এটা কি তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা করবেন? তা নির্ধারণ করবেন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে যুক্ত যারা। কিন্তু প্রযুক্তির প্রসার এখন এতটাই ব্যাপক তা একেবারে উন্মুক্ত করে দিলে ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। মুহূর্তে কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভুল তথ্য প্রচারিত হলে বা ছড়িয়ে পড়লে রাষ্ট্র পর্যন্ত বিপর্যস্ত হতে পারে। তবে কথা থাকে, এই নিয়ন্ত্রণ করার সময় যে আইন বা মাধ্যম দিয়ে করা হবে তার অপব্যবহার বা বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিনা সেক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন জরুরি।
তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি এ খাতে নতুন নতুন অনেক বিষয় নিয়ে কাজের সুযোগ আছে। আমি সামনের দিনগুলোতে নিজের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তরুণদের নেয়া নতুন নতুন উদ্যোগ বা স্টার্ট আপে পরামর্শক হিসেবে কাজ করতে চাই।
দেশে ফিরে পরিবার পরিজন নিয়ে কেমন কাটছে?
আমার দু’সন্তানের মূল আকর্ষণ তাদের দাদা দাদি, নানা নানি। দেশের বাইরে ছিলাম উনিশ বছর। এই লম্বা সময়ে আমিও বাবা মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে ছিলাম। কাজেই সেই সময়টায় সবাইকে খুব মিস করতাম। যদিও করোনার কারণে সর্বত্র যেতে পারছি না।
সিয়াটল মিস করেন কিনা? মাইক্রোসফট মিস করেন কিনা?
মিস করছি কিছুটা। সেখানে যে এলাকায় আমার বাস ছিল তার খুব কাছাকাছি সুন্দর সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার সুযোগ ছিল। দেশে এসে ভেবেছিলাম বেশকিছু জায়গায় যাব এখনো সে সুযোগ করতে পারিনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা নেই অনেকদিন। মাইক্রোসফটকে খুব মিস করি। সেখানে আটবছর কাজের সময় অনেক প্রযুক্তি ক্ষেত্রের জায়ান্টদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে। যারা বিশ্বের অনেক প্রযুক্তিগত বিষয়ের পাইওনিয়ার। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিটি মানুষেরও জীবনের লক্ষ্য বদলায়। আমিও সেই লক্ষ্য পূরণে নিজ দেশে ফিরে এসেছি। এখানে এসেও অনেক যোগ্য মানুষদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।
আবার যদি দেশের বাইরে যাওয়ার ডাক আসে?
আপাতত দেশে থাকার চিন্তা। বাইরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। ভবিষ্যতে কানসালটেন্সি করতে হয়তো স্বল্প সময়ের জন্য যাওয়া হতে পারে।
প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশে দক্ষ জনবলের অভাব বলে মনে করেন প্রযুক্তি বিজ্ঞানী নোবেল খন্দকার। তিনি এও মনে করেন, দেশে অনেক তরুণ যে ধরনের স্টার্ট আপ নিয়ে কাজ করছেন তা বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে ভালো। কিন্তু দুর্বল দিক হচ্ছে, যারাই তৈরি হচ্ছেন তারা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তরুণ এই প্রযুক্তি বিজ্ঞানীর মুখ্য ভূমিকায় ‘করোনা ট্রেসার বিডি’ অ্যাপস তৈরি হয়। যার মাধ্যমে আপনি কোনো করোনাবহনকারী ব্যক্তির সংস্পর্শে ছিলেন কিনা তার স্বয়ংক্রিয় সংকেত পেয়ে যাবেন। এটি সিঙ্গাপুর, ভারত, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই চালু হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিদ্যায় অনার্স করে নোবেল পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার নেব্রাস্কা ইউনিভার্সিটি থেকে করেন কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। তারপর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে করেন পিএইচডি। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই কাজ শুরু করেন অ্যাপলিকেশন ডেভেলপার হিসেবে। পরে ‘সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ইন টেস্ট’ পদে মাইক্রোসফটে যোগ দেন ২০১১ সালে। ২০১৩-তে মাইক্রোসফটে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে কাজ শুরু করেন। ২০১৮-তে ‘লিড সিনিয়র সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে আসীন হন। এ পদে কাজ করার সময়ই ২০১৯ সালে সিদ্ধান্ত নেন দেশে ফিরে কাজ করবেন এ সেক্টরে। যোগ দেন সহজ ডট কম-এ ভাইস প্রেসিডেন্ট (টেকনোলজি) পদে। বর্তমানে দেশের আইটি সেক্টর, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে দুর্বল দিকগুলো কি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তিনি কথা বলেন মানবজমিনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:
মাইক্রোসফট ছেড়ে দেশে এসেছেন এক বছর, কেমন দেখছেন ডিজিটাল বাংলাদেশ?
এক বছরের অভিজ্ঞতা মিশ্র। উনিশ বছর আগে দেশ ছেড়েছিলাম। তখন দেশকে যে অবস্থায় দেখে গিয়েছি বর্তমান তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কম্পিউটারের সহজলভ্যতা এবং ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনের ব্যাপ্তি বেড়েছে বহুগুণ। হাতে হাতে এখন পৌঁছে গেছে প্রযুক্তি। তবে অগ্রগতি যেমন হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়েছেও। বিশেষত প্রযুক্তি ক্ষেত্রে পড়াশোনার দৌড়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে আছে। দেশের বাইরে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে ধরনের গবেষণা হচ্ছে সে জায়গায় আমাদের যেভাবে এগিয়ে আসা দরকার তা একেবারেই হচ্ছে না। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তরুণরা যে ধরনের স্টার্ট আপ উদ্ভাবন করছে তা উৎসাহব্যঞ্জক। নতুন উদ্যোক্তারা চমৎকার সব কাজ করছে। অনেক ক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়েও ভালো কাজ করছে দেশের তরুণ-তরুণীরা।
গত এক বছরে দেশের প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
মিশ্র অভিজ্ঞতাই বলবো। এদেশে যারা নতুন কাজ করছে তেমন বেশকিছু ক্ষেত্রে আমি নেতৃত্ব দিচ্ছি। আমাদের দেশে এখন এ সেক্টরে প্রচুর পরিশ্রমী ও মেধাবী তরুণ কাজ করছে এটা আশার বিষয়। তবে সমস্যা হচ্ছে কোনো কোম্পানি বা সংস্থা চালাতে গেলে যে বিপুল পরিমাণ দক্ষ জনবল দরকার তার অভাব বা ঘাটতি রয়েছে। এর দুটি কারণ আমি দেখতে পাই। প্রথমত যারা কাজ শিখছেন তারা দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। আর ফিরছেন না। অন্যদিকে, আমাদের এখানে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে পরিমাণ জনশক্তি দরকার তত সংখ্যক জনবল তৈরি হচ্ছে না। শুধু প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকলেই সবটা হবে তা নয়, নিজেকে বিশ্বমানের হিসেবেও গড়ে তুলতে হবে। আমি নিজেও সহজ ডটকমের একটি স্টার্ট আপে যুক্ত আছি। তারা একটি বিশ্বমানের স্টার্ট আপ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সক্ষমতার সঙ্গে পরিচালনা করছেন। এটা যে শুধু সহজ ডটকম করছে তা নয়, এর বাইরেও আরো অনেকেই খুব ভালো কাজ করছেন।
করোনা ট্রেসার বিডি অ্যাপসের নেপথ্যের গল্প বলবেন কি? কেমন সাড়া পেয়েছেন?
এই অ্যাপসটি তৈরি করার জন্য তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সহজ ডটকমের সিইও মালিহা কাদিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আমরা যে রাইড শেয়ারিং অ্যাপসটি অপারেট করি তাতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কে কোথায় যাচ্ছেন বা কখন যাবেন তা নিয়েই মূল কাজ। আর আমরা তা করি অ্যাপস-এর মাধ্যমেই। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই সরকার এমন একটি অ্যাপস তৈরির কথা চিন্তা করে যাতে করোনা রোগী পাশে থাকলে অ্যালার্ট বা সংকেত প্রদান করবে। আমাদেরকে এটি তৈরিতে সময় দেয়া হয়েছিল মাত্র তিন সপ্তাহ।
অ্যাপসটি তৈরিতে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল দুটি। একটি হচ্ছে এত অল্প সময়ে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপস তৈরি করা। অন্যদিকে এটি পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের আদলে মানসম্পন্ন করে তৈরি করতে হবে। অ্যাপসটিকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন দিনে গড়ে ৫০ লাখ মানুষ তা ব্যবহার করতে পারে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের তথ্য ধারণ করা, অনুসরণ করার সক্ষমতাও থাকতে হবে অ্যাপসটির। আবার বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতেও পারবে। আমরা সেই চ্যালেঞ্জটিতে সফল হয়েছি। সরকারের পক্ষেও ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছি। বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এবং আমাদের সিইও মালিহা কাদির সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেছেন। মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যেই আমরা এই অ্যাপসটি নিয়ে মানুষের কাছে হাজির হতে পেরেছি। এ নিয়ে আমরা ভারতীয় আরোগ্য সেতু অ্যাপস তৈরি করেছে যারা সেই টিমের সঙ্গেও কথা বলেছি। এত অল্প সময়ে এ মুহূর্তের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় একটি অ্যাপস তৈরি সত্যিই ছিল চ্যালেঞ্জের কাজ।
এটি করতে গিয়ে আমরা আরও সহযোগিতা পেয়েছি আইইডিসিআর-এর পরিচালক ডা. মীর জাদি সাবরীনা এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের। কারণ এই অ্যাপসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে মেডিকেল টার্ম। কাছাকাছি দু’জন মানুষ অবস্থান করলে কীভাবে শনাক্ত করবো বা সেই সংকেত কীভাবে পাওয়া যাবে? এ বিষয়টির প্রায়োগিক জায়গাটির একটি বড় অংশ চিকিৎসা বিজ্ঞানের। তবে আশার দিক হচ্ছে এই অল্প সময়ে ৭ লাখ মানুষ এই অ্যাপসটি ব্যবহার করছে। প্রতিদিনই এতে নতুন নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছেন।
আমাদের তরুণরা দলে দলে আইটি মুখী হচ্ছে, সঠিকপথে এগুচ্ছে কিনা?
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে হবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে সকল বিষয় যুক্ত করা প্রয়োজন তা করতে হবে। এসবের বাইরে বাংলা এবং ইংরেজি শুদ্ধ লেখার চর্চা করতে হবে। শুদ্ধভাবে লিখতে পারা জরুরি এই জন্য যে, মানুষের সৃজনশীল চিন্তার প্রকাশ সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হলে তা লেখার মাধ্যমেই করতে হবে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃজনশীল চিন্তা করার যে ক্ষমতা তার বিশাল ঘাটতি আছে। একজন শিক্ষার্থী হয়তো অঙ্ক শিখেছে, বিজ্ঞান শিখেছে কিন্তু তার সেই অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখছে তা আর কার্যক্ষেত্রে মিলছে না। সৃজনশীল চিন্তার চর্চা কম থাকায় এমনটি হচ্ছে। কিন্তু এই শিক্ষার্থীই যখন বাইরে যাচ্ছে তখন সেই দেশের পদ্ধতিগুলো সে খুব দ্রুতই আয়ত্ত করতে পারছে। কীভাবে সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ ঘটানো যায় তা আমাদের শিক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা খুবই জরুরি বলে মনে হয়। ইংরেজিতে একেই ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং বা ক্রিটিক্যাল অ্যানালাইসিস বলা হয়।
দেশের আইটি সেক্টরে কোনো ভুলভ্রান্তি চোখে পড়ে কিনা?
ভুলভ্রান্তি বলবো না তবে আমাদের এখানে দরকার ব্যাপক সংখ্যায় দক্ষ জনবল। যারা আমাদের তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কাজ করবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যারাই একটু দক্ষ হয়ে উঠছেন তারা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। বিশ্বে যে ধরনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদেরও এক্ষেত্রে দক্ষ জনবল তৈরির কাজটি আগে করতে হবে।
দেশ একদিকে ডিজিটাল হচ্ছে আবার নানামুখী নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টাও হচ্ছে- এটা দ্বিমুখিতা নয় কি?
এর ভালোমন্দ দু’টি দিকই রয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তিকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করার একটি ভয়াবহ দিক আছে। শুধু আমাদের এখানে নয় বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারের কারণে অনেক তরুণ তরুণী আত্মহত্যা করেছে। এত প্রয়োজনীয় যে মাধ্যম তার একটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে এটি। তাই বলে প্রযুক্তিকে তো আর থামিয়ে রাখা যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এর নিয়ন্ত্রণ কীভাবে হবে? এটা কি রাষ্ট্র করবে? এটা কি তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা করবেন? তা নির্ধারণ করবেন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে যুক্ত যারা। কিন্তু প্রযুক্তির প্রসার এখন এতটাই ব্যাপক তা একেবারে উন্মুক্ত করে দিলে ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। মুহূর্তে কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভুল তথ্য প্রচারিত হলে বা ছড়িয়ে পড়লে রাষ্ট্র পর্যন্ত বিপর্যস্ত হতে পারে। তবে কথা থাকে, এই নিয়ন্ত্রণ করার সময় যে আইন বা মাধ্যম দিয়ে করা হবে তার অপব্যবহার বা বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিনা সেক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন জরুরি।
তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি এ খাতে নতুন নতুন অনেক বিষয় নিয়ে কাজের সুযোগ আছে। আমি সামনের দিনগুলোতে নিজের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তরুণদের নেয়া নতুন নতুন উদ্যোগ বা স্টার্ট আপে পরামর্শক হিসেবে কাজ করতে চাই।
দেশে ফিরে পরিবার পরিজন নিয়ে কেমন কাটছে?
আমার দু’সন্তানের মূল আকর্ষণ তাদের দাদা দাদি, নানা নানি। দেশের বাইরে ছিলাম উনিশ বছর। এই লম্বা সময়ে আমিও বাবা মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে ছিলাম। কাজেই সেই সময়টায় সবাইকে খুব মিস করতাম। যদিও করোনার কারণে সর্বত্র যেতে পারছি না।
সিয়াটল মিস করেন কিনা? মাইক্রোসফট মিস করেন কিনা?
মিস করছি কিছুটা। সেখানে যে এলাকায় আমার বাস ছিল তার খুব কাছাকাছি সুন্দর সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার সুযোগ ছিল। দেশে এসে ভেবেছিলাম বেশকিছু জায়গায় যাব এখনো সে সুযোগ করতে পারিনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা নেই অনেকদিন। মাইক্রোসফটকে খুব মিস করি। সেখানে আটবছর কাজের সময় অনেক প্রযুক্তি ক্ষেত্রের জায়ান্টদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে। যারা বিশ্বের অনেক প্রযুক্তিগত বিষয়ের পাইওনিয়ার। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিটি মানুষেরও জীবনের লক্ষ্য বদলায়। আমিও সেই লক্ষ্য পূরণে নিজ দেশে ফিরে এসেছি। এখানে এসেও অনেক যোগ্য মানুষদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।
আবার যদি দেশের বাইরে যাওয়ার ডাক আসে?
আপাতত দেশে থাকার চিন্তা। বাইরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। ভবিষ্যতে কানসালটেন্সি করতে হয়তো স্বল্প সময়ের জন্য যাওয়া হতে পারে।