শেষের পাতা

মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁস

বিভিন্ন ব্যাংকে জসিমের ২৭ অ্যাকাউন্ট

রুদ্র মিজান

২৮ জুলাই ২০২০, মঙ্গলবার, ৯:১৮ পূর্বাহ্ন

নিজে লেখাপড়া না করলেও ডাক্তার বানিয়েছে অনেককে। মেধার লড়াই ছাড়াই দেশের কাঙ্ক্ষিত মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে অনেককে। বিনিময়ে হাতিয়ে নিয়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছে। রিমান্ডে সিআইডি’র জিজ্ঞাসাবাদে এসব বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসের মূল হোতা জসিম উদ্দিন মুন্নু। তবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে তথ্য না দিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে জসিম। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে ২৭টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে তার। এসব অ্যাকাউন্টে জমা হতো বিপুল টাকা। এর আগেও ২০১৩ সালে র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছিলো জসিম উদ্দিন মুন্নু। জেল থেকে বের হয়ে আবারো একই অপকর্মে লিপ্ত হয় সে। সিআইডি’র জিজ্ঞাসাবাদে জসিম উদ্দিন মুন্নু জানিয়েছে, প্রশ্নপত্র বিক্রি করার সময় প্রতিদিন বিপুল টাকা জমা হতো। এত টাকা দু’একটি অ্যাকাউন্টে রাখা দুষ্কর। ব্যাংক কর্মকর্তাদের নজরে পড়তে পারে। বিষয়টি অনেক দূর গড়াতে পারে। এসব চিন্তা করেই বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করে জসিম। এসব অ্যাকাউন্টে কী পরিমাণ টাকা আছে বা লেনদেন হয়েছে এসব তথ্য উদ্‌ঘাটন করছে সিআইডি। ধারণা করা হচ্ছে দেশের বাইরে বিপুল টাকা পাচার করেছে জসিম উদ্দিন মুন্নু। আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ী হিসেবে বিভিন্নস্থানে নিজেকে পরিচয় দিতো। প্রায়ই দেশের বাইরে আসা-যাওয়া করতো। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাপান, কোরিয়া সহ বিভিন্ন দেশে আসা- যাওয়া করেছে জসিম। ২০১৩ সালের পর হঠাৎ করেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয় সে। রাতারাতি মিরপুরে একটি বহুতল বাড়ি নির্মাণ করে। এরকম আরো তিন বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে ঢাকায়। এ ছাড়া রয়েছে একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি। এসবই করেছে প্রশ্নপত্র বিক্রির টাকায়।

প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নিতো সে। মোট কতজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছে তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি সিআইডি। তবে শত শত শিক্ষার্থী টাকার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করেছে। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি। যেসব শিক্ষার্থী টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করেছে তাদের তালিকা করা হচ্ছে। ওই তালিকা অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হবে। যারা এখনো অধ্যয়নরত মেডিকেল থেকে তাদের বহিষ্কার ও ডিগ্রি অর্জনকারীদের সনদ বাতিলের সুপারিশ করা হতে পারে।

সিআইডি’র তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলায় ১২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে সিআইডি। ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৭ শিক্ষার্থীকে আজীবন বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ বিষয়ে সিআইডি’র অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার কামরুল আহসান মানবজমিনকে জানান, মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় অসাধু উপায়ে যারা প্রশ্ন সংগ্রহ করে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে সুপারিশ করবে সিআইডি। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জের সিংগাইর এলাকার জসিম উদ্দিন মুন্নুর খালাতো ভাই আবদুস সালাম ও ভাতিজা পারভেজ খানের বাবা চাকরি করতেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেসে। আবদুস সালাম খান প্রেসের মেশিনম্যান। তাদের মাধ্যমেই প্রশ্ন সংগ্রহ করতো জসিম ও পারভেজ। এক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল জসিম। পারভেজের বাবা মারা যাওয়ায় জসিমের ওপর নির্ভরশীল পুরো চক্র। জসিমকে প্রশ্ন সরবরাহ করতো সালাম। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে চক্রটি। পরিবার থেকে শুরু করে দেশব্যাপী একটি চক্র গড়ে তুলেছিল জসিম উদ্দিন মুন্নু। প্রশ্ন আনা-নেয়া ও শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করতো জসিমের স্ত্রী শারমিন আরা জেসমিন, ছোট বোনের স্বামী জাকির হোসেন দিপু, বড় বোনের স্বামী আলমগীর হোসেন।  এ ছাড়াও সারা দেশে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করতো তাদের এজেন্টরা। এই চক্রের জসিম উদ্দিন মুন্নু, পারভেজ খান ও জাকির হোসেন দিপুকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। গত ২৪শে জুলাই সাতদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাদের। এ ছাড়াও অন্যদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান।

এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, নিশ্চয়ই প্রশ্ন কেনার মতো এত টাকা শিক্ষার্থীদের নেই। তাদের অভিভাবকরা অসৎ উপায়ে প্রশ্ন সংগ্রহ করে তাদের দিয়েছেন। এটি একটি অশুভ প্রতিযোগিতা। এই প্রবণতা সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর। এটি প্রমাণ করে নৈতিকতা বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, অসাধু উপায়ে যারা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন তাদের ডিগ্রিসহ সকল অর্জন বাতিল করতে হবে। তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে কেউ এই পথে পা বাড়াবে না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status