মত-মতান্তর

স্বাস্থ্যের নতুন ডিজি কি পারবেন জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে?

মো. রুহুল আমিন

২৬ জুলাই ২০২০, রবিবার, ৮:২৮ পূর্বাহ্ন

দুর্নীতির মহোৎসবের চিত্র উন্মোচিত হওয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসেবে নতুন মহাপরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি আমাদের কেমন স্বাস্থ্যখাত উপহার দিতে পারবেন, তা বুঝতে হলে অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকাতে হবে।

সংবাদ সংগ্রহ করতে আমি বেশকিছু সরকারি অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করি। এ অফিসগুলো আর্থিক খাত ও বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট। যার প্রধান পদে থাকেন সরকার মনোনিত ব্যক্তি।

বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এবং একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের মে মাসে ডক্টর আতিউর রহমানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ করে। সন্দেহ নেই, সে সময়ে ডক্টর আতিউর ছিলেন অত্যান্ত পরিচ্ছন্ন ইমেজের ব্যক্তি। তিনি প্রায় ৯ বছর এ পদে ছিলেন। অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তোলায় ডক্টর আতিউরের অবদান স্মরণীয়। তেমনি মনে রাখতে হবে, এই সময়ে খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, সুশাসনের অভাব ও নানা অনিয়মের কারণে প্রায় দিনই খবরের কাগজের শিরোনাম হত ব্যাংকিং খাত।

২০১৬ সালের মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি যাওয়ার ঘটনা সামনে এলে তিনি সরে যেতে বাধ্য হন। এরপর সরকার নিয়োগ দেয় বর্তমান গভর্নর ফজলে কবিরকে। চার বছরের বেশি সময় তিনি এ পদে আছেন। একাধিকবার পুনঃনিয়োগও পেয়েছেন। কিন্তু ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলোর সমাধান হয়েছে সামান্যই। এখনো খেলাপি ঋণ, সুশাসনের অভাব, ঋণ অনিয়ম ব্যাংক খাতকে দেশের সবচেয়ে নাজুক সেক্টরের তালিকায় রেখেছে।

উল্টো অভিযোগ উঠেছে, আগের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক স্বায়ত্তশাসন চর্চা করতে পারে না। ফাইভ স্টার হোটেলের মিটিং থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত আসে। গ্রাহকের চেয়ে পরিচালকদের স্বার্থ বেশি দেখে এই প্রতিষ্ঠানটি। অথচ গত এক যুগে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে কোনো আইন করা হয়নি। এর সুবিশাল পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক হয় নিয়মিত। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যোগ্য ব্যক্তিরা ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান। বিভিন্ন বিভাগ সামলানোর জন্য আছেন প্রায় দুই ডজন দক্ষ নির্বাহী পরিচালক। অন্য পদেও নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে তেমন প্রশ্ন ওঠে না।

এবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। সরকারের আয় যোগান দেয়ার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান এনবিআর। দীর্ঘদিন ধরেই এর প্রধান হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারের অভিজ্ঞ সদস্যরা। যারা চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান তাদের অনেকেরই আগে থেকে আয়কর, ভ্যাট, কাস্টমস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে হাতেকলমে জ্ঞান থাকে না। তবে অনেকেই অর্থনীতি ভাল বোঝেন ও জানেন।

সাধারণত দুই বছরের জন্য এনবিআর চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয়। আমরা যা দেখি, দায়িত্ব নেয়ার পর একজন চেয়ারম্যান শুরুতেই এনবিআরকে চেনার ও বোঝার চেষ্টা করেন। এর তিন শাখা আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাটের প্রধান প্রধান অফিস সম্পর্কে ধারনা নেন। এরপর গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলোর কর্মকর্তাদের রদবদল করেন। পাশাপাশি তিনি কিছু আইনকানুন বোঝার চেষ্টা করেন। এর মধ্যেই চলে আসে বাজেট(অর্থবিল) তৈরির কাজ। মোটামুটি ছয় মাসের অভিজ্ঞতায় বাজেট তৈরি করে ফেলেন তিনি।

দায়িত্ব নেয়ার পর একজন চেয়ারম্যানকে আমরা প্রশাসনিক রদবদলে, অর্থবিল তৈরিতে এবং রাজস্ব আদায়ে যতটা ব্যস্ত থাকতে দেখি এনবিআরের সংস্কারে ততটা ব্যস্ত দেখি না। এটা ঠিক যে, এগুলো এনবিআর চেয়ারম্যানের দায়িত্বের অংশ। কিন্তু একটি আধুনিক ও দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়াও তার অন্যতম দায়িত্ব।

অর্থবিল তৈরির কাজ অতিমাত্রায় আইনকেন্দ্রিক হওয়ায় চেয়ারম্যানদের খুব বেশি মেধার পরিচয় দেয়ার সুযোগ কম। আবার মাঠ প্রশাসনের ফাঁকি-ঝুঁকি সম্পর্কে তেমন অভিজ্ঞতা না থাকায় শুধু রদবদলের মাধ্যমে দুর্নীতি বন্ধ করাও সম্ভব হয় না। কিন্তু চেয়ারম্যানরা যদি এনবিআরের আধুনিকায়নে নেয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে অধিক মনযোগী হতেন, এনবিআরের প্রয়োজন পূরণে সরকারের সাথে আরও নেগোসিয়েশন করতেন, স্টেকহোল্ডার মতামতে আরও গুরুত্ব দিতেন, তাহলে আমরা গর্ব করার মতো একটা প্রতিষ্ঠান পেতাম।

উল্লেখ্যঃ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রধান পদ চেয়ারম্যান। তার অধীনে আয়কর, ভ্যাট, কাস্টমস তিন বিভাগের কয়েকজন করে সদস্য থাকেন। যাদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। কেউ প্রশাসন সদস্য। কেউ নীতি সদস্য। কেউ বাস্তবায়ন সদস্য। আর মাঠ পর্যায়ে রয়েছে অনেকগুলো কমিশনারেট।

এবার মোটামুটি ভাল মানের একটা প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ দেয়া যাক। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ বেজা। প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি খুবই ছোট। কিন্তু দায়িত্ব অনেক বড়। সারাদেশে একশো অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা। দেশি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো।

এখন পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠান ভাল পথেই এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। পরিকল্পিত শিল্পায়ন, দেশি বিদেশি বিনিয়োগ, হয়রানি ও দুর্নীতিমুক্ত সেবা, ডিজিটাল ব্যবস্থাপনাসহ নানা বিষয়ে বেজা দেশে-বিদেশে অনেকের নজর কেড়েছে। হোন্ডা, সুমিতমো, সজিত, আদানি, টিআইসি, এশিয়ান পেইন্টসের মতো বিশ্বখ্যাত অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করছে।

বেজার চেয়ারম্যানও কিন্তু সরকার মনোনিত ব্যক্তি। বিনিয়োগকারীদের সেবা দেয়ার জন্য ও নিজের প্রয়োজনেও বেজাকে অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুয়ারে যেতে হয়। তারপরও বেজা কেন অন্যদের থেকে আলাদা? এর কারণ কী?

প্রথমত, বেজা পরিকল্পিত শিল্পায়ন, দেশি বিদেশি বিনিয়োগ, হয়রানি ও দুর্নীতিমুক্ত সেবা, ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত, আইনের প্রয়োগ করছে। তৃতীয়ত, লোকবল নিয়োগসহ অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পথ খোলা উন্মুক্ত রেখেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশাল একটি প্রশাসনিক কাঠামো আছে। আছে মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতের আইনি শক্তিও। সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালকের মতো নতুন মহাপরিচালকও একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। সরকারি চিকিৎসকরা কীভাবে সিস্টেম দ্বারা আর বেসরকারি চিকিৎসকরা কীভাবে মালিকদের দ্বারা অবহেলিত তা তিনি জানেন। তিনি এও জানেন, স্বাস্থ্য সেবা সাধারণ মানুষের জন্য কত দুর্মূল্য।

নতুন মহাপরিচালক অন্য অফিস প্রধানদের মতো অধীনস্তদের কাজ নিজে করবেন নাকি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবেন?
একটি ডিজিটাল তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন নাকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবেন? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের বেশি সময় হয়তো লাগবে না। তবে আমাদের অভিজ্ঞতা আনন্দিত হওয়ার মতো না।

তারপরও নতুন মহাপরিচালকের উদ্দেশে, 'কোনো প্রতিষ্ঠান একজন ব্যক্তি দ্বারা চলে না, চলতে পারে না। কিন্তু একজন ব্যক্তি ভিশন, মিশন, গোল সেট করে দেন। এবং তা অর্জনের পথ তৈরি করতে পারেন। ভালোর পথে বাধা যেমন পাবেন, সহযোগীও পাবেন।'

লেখকঃ গণমাধ্যম কর্মী
[email protected]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status