শেষের পাতা

চট্টগ্রামে পুলিশের সঙ্গেও বাটপাড়ি শাহেদ করিমের

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম থেকে

১৬ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৮ পূর্বাহ্ন

২০১৬ সালের শেষের দিকের মেগা মোটরসের নামে আমদানি করা ১৭টি সিএনজি অটোরিকশা জব্দ করে সিএমপি’র গোয়েন্দা শাখার একাধিক কর্মকর্তা। চেসিস নম্বর জালিয়াতি করে বিক্রির জন্য রাখা হয়েছিল এসব সিএনজি অটোরিকশা। কিন্তু রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. শাহেদ ওরফে শাহেদ করিম চট্টগ্রামে এসে হুমকি-ধামকি দেয়ার পর পুলিশ অটোরিকশাগুলো ছেড়ে দেয়। এরপরও অভিযানে থাকা চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ ঠুকে দেন পুলিশের ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড (ডিএনপিএস) বিভাগে।
অভিযোগে এএসআই সাদেক মোহাম্মদ নাজমুল হক ও মো. আজমির শরীফকে লঘু শাস্তি দেয়া হয়। কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগে কর্মরত পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া ও আফতাব হোসেন গত তিন বছর ধরে নিয়মিত ওই অভিযোগের শুনানিতে হাজিরা দিচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পরিচয় দিয়ে দাপট দেখিয়ে চট্টগ্রামেও পুলিশের সঙ্গে এমন বাটপাড়ি করেন মো. শাহেদ ওরফে শাহেদ করিম। সিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার পলাশ কান্তি নাথ বুধবার সকালে এই তথ্য জানান।
তিনি বলেন, আমাদের দুজন অফিসার শাহেদ করিমের রোষানলে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। শাহেদ করিম নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পরিচয় দিয়ে সিএমপিতে এসে দাপট দেখান। একটি সাধারণ অভিযানের কারণে দুজন এএসআই লঘু শাস্তি পেয়েছেন। দুজন পরিদর্শককে নিয়মিত ঢাকায় গিয়ে হাজিরা দিতে হচ্ছে। এককথায় তারা শাহেদের বাটপাড়ির শিকার হয়েছেন। মেগা মোটরসের অটোরিকশা জব্দের সেই ঘটনা পুনঃতদন্তের পক্ষেও মত দিয়েছেন সিএমপি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ।
কর্মকর্তারা জানান, ২০১৬ সালের ৫ই নভেম্বর নগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হুমায়ূন কবীর ও পরিদর্শক রাকিব হোসেনের নেতৃত্বে একটি টিম কর্ণফুলী এলাকায় মেগা মোটরসের গুদামে অভিযান চালিয়ে ১৭টি অটোরিকশা জব্দ করে। এসব অটোরিকশার প্রত্যেকটির দুইটি করে চেসিস নম্বর ছিল। অভিযানে ওই চার পুলিশ সদস্যও ছিলেন। অটোরিকশা জব্দের সঙ্গে তারা মেগা মোটরসের মালিক জিয়াউদ্দিন ও কর্মকর্তা শহীদুল্লাহকেও আটক করেন।
অটোরিকশাগুলো মনসুরাবাদে ডামিপং স্টেশনে রেখে রাতে অভিযানকারী দল ফিরে আসেন নগরীর লালদীঘির পাড়ে গোয়েন্দা শাখার কার্যালয়ে। এরপর বিভিন্নভাবে চাপ আসায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রাতেই আটক দু’জনকে এক আইনজীবীর জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়। একটি অটোরিকশা আলামত হিসেবে রেখে বাকি ১৬টি ফেরত দেয়া হয়। কিন্তু পরদিন পাতলা প্লেটের নিচে বডিতে আরেকটি চেসিস নম্বর থাকার কথা উল্লেখ করে জব্দ অটোরিকশাটি বিআরটিএ’র মাধ্যমে আমদানি ও পরীক্ষিত কিনা এবং প্রকৃত চেসিস নম্বর কোন্‌টি তা জানতে চিঠি দেয়া হয়।
বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক তৌহিদুল হাসান ১লা জানুয়ারি এই মোটরযানের কোনো রেজিস্ট্রেশন বিআরটিএ দেয়নি এবং প্রতিটি গাড়িতে শুধু একটিই চেসিস নম্বর থাকবে বলে জানান। এরপর তদন্ত চলমান অবস্থায় শাহেদ করিম ২০১৭ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি সিএমপিতে আসেন। তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পরিচয় দেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তাকে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান।
কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে বের হওয়ার পর লালদীঘির পাড়ে সিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ের সামনে শাহেদ করিমের সামনে পড়েন রাজেশ ও আফতাব। এসময় শাহেদ তাদের হুমকি দেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ঢাকায় গিয়ে পুলিশের সিকিউরিটি সেলে অভিযোগ করবেন বলে জানান। হুমকি-ধামকির বিষয়ে শাহেদের বিরুদ্ধে আফতাব হোসেন অভ্যন্তরীণ জিডি করেন।
ফলে যে অটোরিকশাটি জব্দ অবস্থায় ছিল সেটিও ফেরত দেয়া হয়। কার্যত পুরো ঘটনাই কাগজে-কলমে ধামাচাপা দিতে বাধ্য হয় সিএমপি। এরপরও শাহেদ করিম নিজে অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে পুলিশের ডিএনপিএস বিভাগে চার জনের বিরুদ্ধে বৈধ অটোরিকশা আটকে হয়রানি এবং ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ আনেন।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে হয়রানির অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার কথা বলা হয়। তবে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগের সত্যতা মেলেনি বলে উল্লেখ করা হয়। দুই এএসআইকে তিরস্কারের মাধ্যমে লঘু শাস্তি দেয়া হয়। রাজেশ ও আফতাবের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে। শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আব্দুস সালাম মামলাটি তদন্ত করছেন।
মেগা মোটরসের মালিক জিয়াউদ্দিন মো. জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন- এটা পুলিশের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। সেজন্য পুলিশ গাড়িগুলো আটক করেও পরে ছেড়ে দিয়েছে। সেগুলো ভারতের পুনে থেকে আমদানি করা। একটিই চেসিস নম্বর ছিল। পরে বিআরটিএ আমাদের লিখিত দিয়েছে যে, গাড়িগুলো বাংলাদেশের রাস্তায় চলাচলের উপযোগী।

তিনি বলেন, শাহেদ করিম বিআরটিএ থেকে রুট পারমিট নিয়ে দিতে আমাদের সহযোগিতা করেন। মেগা মোটরসের কর্মকর্তা শহীদুল্লাহর সঙ্গে শাহেদ করিম সিএমপিতে গিয়ে আমাদের আস্থা অর্জন করেন। ফলে ঢাকার রাস্তায় অটোরিকশা চালানোর রুট পারমিট করিয়ে দেয়ার নামে ৯১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় শাহেদ। এ ঘটনায় জিয়াউদ্দিন মো. জাহাঙ্গীর অসুস্থ হয়ে পড়েন।
সম্প্রতি রিজেন্ট হাসপাতালে করোনার ভুয়া রিপোর্ট নিয়ে শাহেদ করিম প্রশাসনের নজরে আসার পর ১৩ই জুলাই নগরীর ডবলমুরিং থানায় প্রতারণা মামলা দায়ের করেন মো. সাইফুদ্দিন। মামলায় মেগা মোটরসের সাবেক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহকেও (৬১) আসামি করা হয়। এতে অটোরিকশা চলাচলের জন্য বিআরটিএ’র ভুয়া রুট পারমিট সরবরাহ করে ৯১ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। মূলত এই মামলা তদন্তে সিএমপি কর্মকর্তাদের সঙ্গে শাহেদ করিমের প্রতারণা ও জালিয়াতির বিভিন্ন তথ্য বেরিয়ে আসে।
 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status