বাংলারজমিন

সমুদ্রের গ্রাসে কুয়াকাটার সৈকত

কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি

১৪ জুলাই ২০২০, মঙ্গলবার, ৯:০৩ পূর্বাহ্ন

বিশ্বনন্দিত পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটাকে ক্রমশই গ্রাস করছে ক্ষুধার্ত সাগর। ছোট হয়ে আসছে কুয়াকাটার মানচিত্র। রূপ ঐশ্বর্য্যের সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের বেলাভূমি কুয়াকাটা হারাতে চলছে তার নিজস্ব জৌলুস। প্রতিবছরের ন্যায় অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোঁ’তে সাগরে সৃষ্টি হয় প্রকাণ্ড ঢেউ। শোঁ শোঁ শব্দে ভয়ানক ঢেউগুলোর ঝাঁপটাতে বালু ক্ষয় করে সৈকতের পরিধি ছোট করে চলছে। ঝুঁকিতে আছে সৈকতের টুরিজম পার্ক, কুয়াকাটা মাদ্রাসা পয়েন্ট বেড়ি বাঁধ মাত্র তিনের একাংশ বাকি আছে বিলীন হতে। এনিয়ে পর্যটন এলাকায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে প্রতিদিন আতঙ্কে আছেন বিনিয়োগকারীরা। কুয়াকাটার চৌমাথা থেকে মাত্র ২শ’ ফুট বাকি আছে বিলিন হতে সৈকত। স্থানীয় সংগঠনগুলি সৈকত রক্ষায় গ্রোয়েন বাঁধ নির্মাণ করার দাবিতে  প্রতিবছর বিভিন্ন কর্মসূচি দিলেও সরকারের কোনো টনক নড়ছে না। পাউবো কর্তৃপক্ষ বলছে সার্ভে চলছে উর্ধ্বতম কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। তার আগে পর্যটকদের পদচারণার জায়গাটুকু কুয়াকাটার সৈকত চলে যাচ্ছে সাগরের গর্ভে। পুরানো কোনো চিহ্ন নেই নন্দিত স্থান এ সৈকতের। এ ভাঙ্গনের কবলে পরে পর্যটকদের গুরুত্বপূর্ণ ৫টি দর্শণীয় স্পট বিলীন হয়ে যাচ্ছে যার মধ্যে সৈকত লাগোয়া নারিকেল বাগানের ঐতিহ্য ও জাতীয় উদ্যান অন্যতম।
৫ বছরের ব্যবধানে ২ কিলো জায়গা চলে গেছে সাগরের ভিতরে। বালু ক্ষয়ের শিকার হয়ে সীমানা প্রাচীরসহ পুরো বায়োগ্যাস প্লান্ট সরকারি ভবনটি এখন অদৃশ্য। অপর দিকে সৈকত লাগোয়া অর্ধশত বছর আগের ফয়েজ মিয়ার হাজার হাজার নারিকেল বাগান, তালবাগান, শালবাগান, ৩টি লেক, ঝাউবন, গঙ্গামতির স্পট লেম্বুরবন এসব বিলীন হয়ে গেছে আরো একবছর আগে। সাগরের কোল ঘেষে বলু ক্ষয় করে স্রোতে নিয়ে যায়। ওই স্রোতের গ্রোয়েন বাঁধের মাধ্যমে স্রোতের গতি পরির্বতন করলেই সৈকতটি রক্ষা পাবে এমন দাবি উঠেছে। এভাবে চলতে থাকলে এদেশের দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এ সৈকতটি খুব দ্রুত বিলীনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বেড়াতে আসা পর্যটকরা।
সরজমিনে সৈকত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে যে, প্রতিবছর মে থেকে ৫ মাস পূর্ণিমা- অমাবস্যা জোঁ’তে সাগর ভয়ানকভাবে ফুঁসে ওঠে। এক একটা বিশাল ঢেউ এসে সজোরে আঘাত হানে সমুদ্র পাড়ে। উপকূলীয় অঞ্চল বালু এলাকা হওয়ায় ঢেউয়ের ঝাপঁটায় বালু সরিয়ে পশ্চিমদিকে মোহনায় নিয়ে যায়। এতে পাড়ের বিশাল অংশ ফাটল ধরে বিলীন হয়ে যায় সাগরে। স্থানীয় ও বিশেষজ্ঞ মতে সাগরের স্রোতের গতি পরির্বতনের একটি গ্রোয়েন বাঁধ রক্ষা করতে পারে বিশ্বের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা। মাত্র একদিনের ব্যবধানে তালগাছ, রেইনট্রি গাছ ও নারিকেল গাছসহ নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ঢলে পড়ে সৈকতে। গত দুই মাসে প্রায় ৪০ ফুট পাড় ভেঙে বিলীন হয়ে গেছে সাগরগর্ভে। এভাবে বালু ক্ষয় অব্যাহত থাকলে অতি কম সময়ের ব্যবধানে কুয়াকাটা বৈড়িবাঁধ ভেঙে আবাসিক এলাকা ও ফসলি জমিতে পানি ঢুকে পড়বে।
ঢেউয়ের আঘাতে বিধ্বস্ত সৈকত এলাকা পরিদর্শনকালে সাক্ষাৎ হয় স্থানীয় বাসিন্দা ফেরেস্তালী খলিফা (৬০)-র সঙ্গে তিনি অশ্রুসজল চোখে বলেন, সেই ৩৫-৪০ বছর আগে ৪-৫ মাইল দূরে শুটকির ব্যবসা করতাম সাগর পাড়ে। আর আজ বেরিবাঁধের সঙ্গে ঢেউয়ের পানি বলতে গেলে অনেক কষ্ট হচ্ছে। কি হবে কুয়াকাটার ভবিষ্যৎ কি। এখনো নজর দিচ্ছেনা সরকার। সৈকতের ছোট্ট চায়ের দোকানি রেজাউল করিম বলেন, এই চায়ের দোহান দিয়া মোর সোংসার চলে। গত রাইতে দোহান বন্ধ হইর‌্যা বাড়ি যাই। বেইন্যা হালে (সকালে) আইয়া দেহি দোহানডা সাগরের চরে পইড়্যা রইছে। কতো বচ্ছর ধইর‌্যা হোনতেছি সরকার কুয়াকাডার উন্নয়ন হরবে। এহন দেহি ভাঙ্গলই ফিরাইতে পারছে না।
কুয়াকাটায় বেড়াতে আসা রাশিয়ান স্থাপত্য প্রকৌশলী ইউরা টিউরিয়াজিন (বিদেশি পর্যটক)‘র সঙ্গে গল্প করার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘ অ্যা লঙ ডিফেন্স ওয়োল মে বি ইনাফ সাপোর্ট টু প্রিভেন্ট স্যান্ড ইরৌজন অ্যাজ আই সী ইন মাই কান্ট্রি। বালুক্ষয় রোধ করতে সুদীর্ঘ রক্ষাপ্রাচীর যথেষ্ট সহায়ক হতে পারে। যেমনটা আমার দেশেও দেখে থাকি। দীর্ঘদিন ধরে কুয়াকাটা উন্নয়নকর্মী শফিকুল আলম শফি বলেন, কুয়াকাটা সৈকতে ভাঙ্গন দীর্ঘদিনের সমস্যা।  সাগরের সামান্য ভিতরে মাত্র ১.৫ সেন্টিমিটার পানি এটি গ্রোয়েন বাঁধের মধ্যে রক্ষা পেতে পারে। গ্রোয়েন বাঁধ দিয়ে সাগরের পানির স্রোতের গতি পরির্বতন করলে খুব সহজে আমাদের কুয়াকাটার সৈকত রক্ষা হতে পারে। আমি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছি যার অনেক প্রমাণ আমার কছে আছে।
এবিষয়ে আলাপকালে কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, ‘ভারতীয় একটি বিশেষজ্ঞ টিম সৈকতের বালু ক্ষয় রোধে কাজ করবে বলে আশা করছি। তিনি আরো বলেন, জিইও টিউব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বালু ক্ষয় রোধ করা যেতে পারে। তবে কবে নাগাদ কাজ শুরু হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। পটুয়াখালী পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান দৈনিক মানবজমিনকে বলেন, কুয়াকাটা সৈকত রক্ষার জন্য স্থায়ীভাবে (টিপিপি) প্লানিং তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে আশা করি দ্রুত ব্যবস্থা হবে।  
উল্লখ্য, দেশের বাহিরে পর্যটন শিল্পের সাফল্য অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারে। মানবসৃষ্ট নিদর্শন হিসেবে মালয়েশিয়ার কৃত্রিম সৈকত ‘লাঙ্কাভি’ অন্যতম মনোরম স্পট। এ স্পটে সরকার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ প্রচুর রাজস্ব আয়ের পথ তৈরি করেছে। থাইল্যান্ডের মাত্র ৩ কিলোমিটার ‘পাতায়া বীচ’ বিশ্ব পর্যটকদের মনে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। দক্ষিণ থাইল্যান্ডের কোল্যান্ড আইল্যান্ড, কোচামাই ও সাগরের মাঝে ‘পুকেট’ আকর্ষণীয়ভাবে সাজানো হয়। ফলে সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ পর্যটকের কাছে অত্যাধুনিক বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে এটা প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। থাইল্যান্ড সরকার পর্যটন খাত থেকে দেশের মোট আয়ের ৮০ শতাংশ রাজস্ব আয় করে থাকে। কিন্ত প্রকৃতির অপার দান ১৮ কিলোমিটারের সমুদ্র সৈকত পেয়েও দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ রয়েছে উদাসীন। দ্রুত বালু ক্ষয় রোধসহ কুয়াকাটার উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র রক্ষায় বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসবেন কর্তা ব্যক্তিরা এমনটাই আশা করেছেন বিনিয়োগকারীসহ কুয়াকাটায় আসা পর্যটক ও স্থানীয় সচেতন মহল।  
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status