প্রথম পাতা

যেভাবে ভিয়েতনামে পাচার হন ফরিদুলরা

রোকনুজ্জামান পিয়াস

১২ জুলাই ২০২০, রবিবার, ৯:২৪ পূর্বাহ্ন

ময়মনসিংহের ফরিদুল ইসলাম। দেশে পাইলিংয়ের কাজ করতেন। ভালোই চলছিলো তার সংসার। কিন্তু গতবছরের শেষের দিকে পার্শ্ববর্তী এলাকার এক দালাল পিছু লাগে তার। তাকে ভিয়েতনামে মোটা অংকের আয়-রোজগারের প্রলোভন দেখায়। বলে, মাসিক ৮০-৯০ হাজার টাকা আয়। তবে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শিখতে হবে। সে ব্যবস্থাও ওই দালালই করে দেবে। আর ভিয়েতনাম যেতে খরচ হবে ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সেখানে তাকে একটি শিপইয়ার্ড কোম্পানিতে কাজ দেয়া হবে। এমন চমকপ্রদ প্রলোভনে পড়ে ফরিদুল জমি বিক্রি আর ২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তুলে দেয় দালাল মোশাররফ হোসেনের হাতে। জানুয়ারি মাসে ভিয়েতনামের উদ্দেশ্যে বিমানে তুলে দেয়া হয় তাকে। কিন্তু ওই দেশে পৌঁছানোর পর আয়-রোজগার তো দূরের কথা, তাকে কাজ-ই দেয়া হয়নি। কাজ দেয়ার কথা বলে দালালচক্র তাকে বিভিন্ন কোম্পানিতে ঘুরিয়েছে। জানা গেছে, ফরিদুলকে এক মাসের ভিসা দিয়ে সেদেশে পাঠানো হয়। এরপর নানা ছলচাতুরি ও কাজ দেয়ার নাম করে আবারো টাকা দাবি করে দালালচক্র। কিন্তু টাকা না দেয়ায় তাকে হুমকি-ধামকি দেয় তারা। বন্ধ করে দেয় খাবার-দাবার। এ অবস্থায় বাড়ি থেকে আরো ৫০ হাজার টাকা নিয়ে কোনো রকমে দিন চালান তিনি। এখন ফিরতে পারছেন না দেশেও। উপায় না পেয়ে এলাকার দালাল মোশাররফসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও ত্রিশালে অনলাইনে মামলা করেন তিনি। গ্রেপ্তার হন মোশাররফ। ঘটনা গড়ায় ভিয়েতনামে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসেও। দূতাবাস দেশে তাদেরকে ফেরত পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছে। তবে কবে তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। শুধু ফরিদুল নয়, দেশটিতে তার সঙ্গে একই পরিণতি ভোগ করছেন বিভিন্ন এলাকার আরো ১৭ বাংলাদেশি। বর্তমানে তারা দেশটির হো চি মিন সিটির পার্শ্ববর্তী এলাকা গুয়েন্তা এলাকার একটি ১০০ স্কয়ার ফিটের রুমে গাদাগাদি করে থাকছেন। স্থানীয়দের দেয়া হালকা খাবার-দাবার খেয়ে তাদের দিন চলছে। অন্যদিকে সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে তাদের ওপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে সেদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দালালরা। এই অবস্থায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারা। এই প্রতিবেদকের কাছে ফরিদুল তার পাচার হওয়া ও সেদেশে পৌঁছানোর পর নানা দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেন।

ফরিদুল জানান, তার বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানায়। পার্শ্ববর্তী উপজেলার রাধানগর গ্রামের মোশাররফ হোসেন তাকে ভিয়েতনামে যাওয়ার প্রলোভন দেখায়। মোশাররফ তাকে সেদেশে একটি শিপইয়ার্ড কোম্পানিতে কাজ দেয়ার কথা জানান। বলেন, ওভারটাইমসহ বেতন দাঁড়াবে মাসে ৮০-৯০ হাজার টাকা। এজন্য তাকে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শিখতে হবে। তার কথামতো মোশাররফের হাতে ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা তুলে দেন ফরিদুল। এছাড়া ঢাকার আব্দুল্লাহপুরের কামারপাড়া এলাকার টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে দেন। এজন্য বাড়তি আরো ৫০ হাজার টাকা গুনতে হয় ফরিদুলকে। গত ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে তাকে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। ৭ তারিখে তাকে এলাকায় ফেরত যেতে বলা হয়। আরো বলা হয়, যেকোন দিন তার ফ্লাইট, তৈরি থাকতে। ওইদিন বাড়ি পৌঁছতেই রাত ১০টার দিকে দালাল মোশাররফ তাকে ফোন দিয়ে জানান- আগামীকাল ফ্লাইট, দ্রুত ঢাকায় চলে আসেন। পরদিন ঢাকায় আসার পথে টঙ্গি থেকে তার কাছে পাসপোর্টসহ ২৫০০ ডলার দেন মোশাররফ।  এই ডলার ভিয়েতনামের বিমানবন্দরে তাকে রিসিভ করতে আসা ওই দেশের এক ব্যক্তির কাছে দিতে বলেন তিনি। ওই ভিয়েতনামী সেদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি দালাল মোস্তফার শ্যালক। ফরিদুল বলেন, ঢাকা থেকে তারা মোট ৬ জন ভিয়েতনামের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কলকাতায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ট্রানজিট নিয়ে তারা ভিয়েতনামে পৌঁছান। ভিয়েতনামের বিমানবন্দর থেকে তাদেরকে রিসিভ করে নিয়ে যাওয়া হয় একটি মেডিকেল সেন্টারে। সেখানে তাদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হয়। পরে তাদের কাজ দেয়ার জন্য একটি ওয়ার্কশপে নিয়ে যায়। কিন্তু কাজ না থাকায় দালালরা সেখান থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে একটি বাসায় নিয়ে যায়। এসময় ফরিদুল শিপইয়ার্ডের কাজের কথা বললে দালালরা নানা টালবাহানা করে। ওই বাসায় তারা ৬ জনসহ  আরো ১৭ বাংলাদেশি ছিলো। এ অবস্থায় ফরিদুল বাংলাদেশে থাকা দালাল মোশাররফকে ফোন দিলে প্রথমদিকে বিষয়টি দেখার প্রতিশ্রুতি দেন। পরে আরো কয়েকবার ফোন দিলে বলেন যে, আমার দায়িত্ব ছিলো ভিয়েতনাম পাঠানো, পাঠিয়ে দিয়েছি, এখন তার কিছু করার নেই। সেখানে দু’মাস রাখার পর তাদের হো চি মিন সিটির গুনতাও এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশি দালাল কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির বাসিন্দা আতিকুর রহমান আতিক ও সাইফুল ইসলামের অফিসে রাখা হয়। তাদেরকে ৫-৭ টি ফ্যাক্টরি ঘুরিয়ে দেখানো হয়। বলা হয়, এখানে তাদের কাজ দেয়া হবে। কিন্তু আদতে কোন কাজ দেয়া হয়নি। এই অবস্থায় আরো একমাস অতিবাহিত করার পর ভুক্তভোগীরা দেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানান। কিন্তু দালালরা সাফ জানিয়ে দেয়, দেশে পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। উল্টো কাজ দেয়ার কথা বলে আতিক এবং সাইফুল তাদের কাছে আরো ৪০০ ডলার দাবি করে। ওই টাকা না দেয়ায় নানা ধরনের মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় তাদের। এরও একমাস পর ৩০০ ডলার চুক্তিতে তাদের একটি গ্লাস কারখানায় কাজ দেয়া হয়। কিন্তু ২২ দিন কাজ করানোর পর দেয়া হয় ১৪০ ডলার। ওই টাকায় তাদের থাকা-খাওয়া-চিকিৎসা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে ওই কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে হুমকি-ধামকি দেয় দালালরা। এই অবস্থায় বাড়ি থেকে টাকা পাঠাতে তাদের আবারো চাপ দিতে থাকে। খাবার নেই, ওষুধ কেনার টাকা নেই। পরে বাংলাদেশে থাকা দালাল চুয়াডাঙ্গার নাসির ও ঢাকার রমজানকে ফোন দিলে দেশে ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তারাও কথা রাখেনি। উল্টো ফোন করলে গালমন্দ করে ফোন কেটে দেয়।
ফরিদুল বলেন, উপায় না পেয়ে তিনি মোশাররফসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও ত্রিশালে অনলাইনে মামলা করেন। এদিকে দূতাবাসও বিষয়টি জানতে পেরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারাও দেশে ফেরত পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বর্তমানে ভিয়েতনামীদের সাহায্য-সহযোগিতায় কোনো রকম আধা পেট খেয়ে দিন কাটছে তাদের। দুর্ভোগের কথা উল্লেখ করে ভুক্তভোগীরা বলেন, আতিক ও সাইফুল তাদেরকে মারধরের জন্য স্থানীয় দালাল ভাড়া করছে বলে তারা জানতে পেরেছেন। ফলে আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারেন না। এছাড়া জোর করে বলানোর চেষ্টা চলছে যে, ‘আমরা ভালো আছি, কাজ করছি।’ প্রতারণার জন্য ভুক্তভোগীরা আতিকুর রহমান আতিক, সাইফুল ইসলাম, আবদুল জব্বার, মোস্তফা, আকরামসহ সকল দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। এছাড়া শিগগিরই দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন তারা।

ফরিদুল ইসলাম ছাড়াও একইসঙ্গে একই অবস্থায় দিন পার করছেন ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বাসিন্দা এরশাদ আলী, মো. মুরসালিস মিয়া, মো. মুকসেদুল ইসলাম, মো. আকরাম হোসেন, আতাবুল, ফুলবাড়িয়া উপজেলার আবদুল হক ও মো. শহিদুল ইসলাম। চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার মো. মিলন মিয়া, নরসিংদীর পলাশ থানার মো. জাহাঙ্গীর, ফেনীর দাগনভূঞা থানার আবু সায়েম, পরশুরাম থানার মো. ইয়াসিন, নোয়াখালীর কবিরহাট থানার নুর হোসেন, মেহেরপুরের গাংনী থানার আতাবুল, কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার সাজ্জাদ এবং হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার সুমন।

এদিকে ভিয়েতনামে পাচার হওয়া ৪৬ ব্যক্তিকে নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। সংস্থাটির মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের ওই অনুসন্ধানে উঠে এসেছে পাচারের সঙ্গে জড়িতদের তথ্য। তারা বলছে, পাচারের শিকার এসব ব্যক্তিদের ভিসা, কর্মী সংগ্রহ ও অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত মেসার্স দি জে. কে ওভারসিজ লিমিটেড, ট্র্যাভেল এজেন্সি: ম্যাশ ক্যারিয়ার সার্ভিসেস, আল নোমান হিউম্যান রিসোর্স (সাতক্ষীরা ইন্টারন্যাশনাল), মেসার্স এডভেন্ট ওভারসিজ লিমিটেড, ঝিনাইদহের গয়েশপুর গ্রামের বাসিন্দা বর্তমানে ঢাকায় বসবাসকারী দালাল সাইফুল ইসলাম। জনশক্তি ব্যুরোর ছাড়পত্র নেয়া ৬ রিক্রুটিং এজেন্সি  হলো- মেসার্স সন্ধানী ওভারসিজ লি., মেসার্স মাম এন্ড মাম ওভারসিজ, মেসার্স মুন এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স ইজতেমা ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি, মেসার্স আফিফ ইন্টারন্যাশনাল এবং মেসার্স এ ঝর্ণা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। ব্র্যাকের ওই অনুসন্ধানে ভিয়েতনামে অবস্থানরত চার বাংলাদেশি দালালের নামও উঠে এসেছে। তারা হলেন- মোস্তফা, আবদুল জব্বার, আতিকুর রহমান আতিক এবং সাইফুল ইসলাম।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status