এক্সক্লুসিভ

গাজীপুরে কর্মহীন সংস্কৃতিকর্মীদের জীবন বিপন্ন

ইকবাল আহমদ সরকার, গাজীপুর থেকে

১১ জুলাই ২০২০, শনিবার, ৮:৩৮ পূর্বাহ্ন

করোনা মহামারিকালে কর্মহীন হয়ে পড়ায় ও অভাব-অনটনের কারণে সাংস্কৃতিকসেবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের অনেকের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। গাজীপুরে এমনও রয়েছেন যাদের কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে রয়েছেন চরম দুরবস্থায়। বাসা ভাড়া পরিশোধ কিংবা স্বাভাবিক জীবনযাপন তো দূরের কথা, পরিবারের সদস্য এমনকি শিশুদের মুখেও তিন বেলা খাবার তুলে দিতে পারছেন না। আবার কেউবা গান-বাজনা, সাংস্কৃতি পথ ছেড়ে দেয়ার কথাও ভাবছেন। প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ছাড়াও আনাচে-কানাচে, পথে-ঘাটে, রেল স্টেশনে গান গেয়ে জীবন চালানো শিল্পীও রয়েছে। প্রায় থেমে যাচ্ছে তাদের জীবনের গতি।
গাজীপুরের সংস্কৃতি জগতের পরিচিত মুখ স্বপন গোস্বামী। তার হাত ধরে অনেক শিল্পীর জন্ম। নিজেও পারফরম্যান্স করেছেন এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৯টি দেশে। কিন্তু অসুখে বিসুখে পরে জীবনে তেমন সঞ্চয় করতে পারেননি। করোনা আজ তাকে কর্মহীন-অর্থহীন করেছে। কর্মহীন হয়ে পড়ে দুরবস্থায় পড়ে যাওয়ায় জানা নেই জীবনের সামনের দিনগুলি কতটা ভয়াবহ হবে। তাই গানের কথায় তুলে ধরছেন জীবনের কঠিন সময়ের প্রতিধ্বনি। জীবন লড়াইয়ের কঠোর এই চিত্র তিনি নিজেই তুলে ধরছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। স্বপন গোস্বামীর গান ‘চাল-তেল-লবণ নেই তো আমার ঘরে, দুচোখে ঘুম আসে না -করোনা আসার পরে’ ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তিনি দৈনিক মানবজমিনকে জানিয়েছেন, তার পরিবারের সন্তানসহ কেউ এখন নাস্তা খান না। নাস্তা খাওয়া বর্তমানে বাদ দিয়েছেন। দুপুরে মোটা চালের ভাত খান, রাতে খাওয়া হয় চিড়া-মুড়ি। এভাবেই দিন পাড়ি দিচ্ছেন। একটি ভালো সকালের অপেক্ষায় থাকছেন। তার বুকে জমে থাকা পাথর গলে চোখের কোনে জল ছলছল করছে জীবন কাহিনী বলতে গিয়ে। তিনি আরো বলেন, আজ এই দুরবস্থায় পড়ে যাওয়ার কারণ হলো-মানুষের বাড়িতে সঙ্গীত শেখাতে যেতে পারছেন না, আবার কেউ একাডেমী তো আসে না। তাই কোন অর্থ নেই, বাসা ভাড়া দেয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় সামাজিক সংগঠন জোফা ক্লাব এবং আরো কিছু সহযোগিতায় মাধ্যমে এখন জীবন চলে যাচ্ছেন। সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে সামাজিক মর্যাদা থাকার কারণে তিনি কারো কাছে যেতে পারছেন না।
এখন যেতে পারছেনা গার্মেন্টসে চাকরি করতে কিংবা বাজারে পিঠার দোকান বসাতে পারছেন না। এই অবস্থায় অর্থাভাবে পড়ে অতি কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন, সুদিনের আশায় আশায়। শুধু যে এক স্বপন গোস্বামী বা তার পরিবারের এই চিত্র, তা নয়। এই জগতের গিটারের শিক্ষক আব্দুল বারী, সংগীতশিল্পী ও মঞ্চের ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন রাজন, বাউল শিল্পী আজমিরী শান্তা কিংবা প্রতিবন্ধী শিল্পী আনোয়ার হোসেনের মত অনেকেরই সংসারে দুর্দিন চলছে।
দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে গিটারের প্রশিক্ষক আব্দুল বারী বলেন, টানা চার মাস কর্মহীন থাকায় চোখে এখন কেবলই অন্ধকার। সংসার টেনে নেওয়া খুবই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। দুর্দিনে সরকার যদি এগিয়ে আসতো তাহলে আমরা বুকে আশা বাঁধতে পারতাম। আলমগীর হোসেন রাজন বলেন, কোন স্টেজ শো না থাকায়, পারফরম্যান্স না থাকায় এখন একেবারে বেকার দিন কাটাচ্ছেন। এই অবস্থাটা আরও দীর্ঘতর হলে সংসার চালানো খুবই কঠিন হয়ে যাবে। বাসা ভাড়া ও আটকে যাচ্ছে। সরকার এগিয়ে নেয়া আসলে হয়তো পেশা বদল করা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকবেনা। বাউল শিল্পী আজমিরী শান্তা বলেন, আমরা বাউল শিল্পী, কোন প্রোগ্রাম এখন নেই। কেউ গান গাইতে ডাকেও না। অনেকে নাকি অনেক কিছুই সহযোগিতা পায়। কিন্তু আমরা শিল্পীরা কোন জায়গা থেকেই কিছুই পাচ্ছিনা। বেঁচে থাকাই এখন কষ্টের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবন্ধী সঙ্গীত শিল্পী আনোয়ার হোসেন, কলিজাতে দাগ লেগেছে গানটিতে সুর তুলে বলেন, সত্যি আজ পরিবারের সবার কলিজায় দাগ লেগেছে। গান গেয়ে গেয়ে জীবন চলতো, সংসার চালাতাম, বাসা ভাড়া দিতাম। এখন জীবনের পথ চলা প্রায় বন্ধ। করোনা গেলে যদি আবার গান গাইতে পারি, তাহলে হয়তো জীবন সংসার স্বাভাবিক হবে। এর আগেও বেঁচে থাকার জন্য সহযোগিতা প্রয়োজন।
কর্মহীন হয়ে দুরবস্থায় পড়ে যাওয়া সংস্কৃতিকর্মীদের বিষয়ে গাজীপুর কালচারাল অফিসার শারমিন জাহান জানান, ইতোমধ্যে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিছু সহযোগিতা ও করা হয়েছে। সরকারিভাবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জেলায় অসচ্ছল শিল্পীদের দিতে ৫০ জনের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৫ হাজার টাকা করে। যেগুলি অতিদ্রুত বিতরণ করা হবে।এছাড়াও জেলা শিল্পকলা একাডেমী জেলা জুড়ে প্রায় সাড়ে চারশো অসচ্ছল শিল্পীর তালিকা তৈরি করেছে। পর্যাক্রমে হয়তো তাদের জন্য বরাদ্দ পাওয়া যাবে।
শিল্প-সংস্কৃতিকে যারা ভালবাসেন তারা মনে করছেন, কারোনা মহামারী চলছে প্রায় চার মাস। এ সময় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বন্ধ। ধীরে ধীরে কাজ হারিয়েছেন গাজীপুরের সংস্কৃতিকর্মীরা। স্কুল বা বাসায় গিয়ে নাচ গান শেখানো বন্ধ। বন্ধ হয়েছে আয় রোজগারের পথ। ফলে বাসা ভাড়া দেয়া  তো দূরের কথা, খেয়ে পড়ে জীবনযাপনের অবস্থা নেই অনেকের। তাই চরম সংকটে পড়েছেন শিল্পী- সংস্কৃতিকর্মীরা। শিল্পীরা শুধু বিনোদন নয়, জাতির ক্রান্তিকালে ও অনন্য ভূমিকা রাখেন। বেঁচে থাকলে, পেশায় টিকে থাকলে হয়তো আগামীতে তারাও ভূমিকা রাখবেন। পথ দেখাবেন। দুঃসময়ের তাদের টিকিয়ে রাখতে,  সরকারি ভাবে সহায়তার পাশাপাশি আয়ের যেকোন উৎসে তাদেরকে সম্পৃক্ত করা হোক এমন দাবিও রয়েছে অনেকের।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status