অনলাইন

বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার: চীনের কূটনৈতিক বিজয়

জয়ীতা ভট্টাচার্য

১০ জুলাই ২০২০, শুক্রবার, ৯:৫৫ পূর্বাহ্ন

সম্প্রতি, চীন বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্য আমদানির ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য চীনের শুল্ক ও কোটামুক্ত আমদানি প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশকে এই ছাড় দেয়া হয়েছে। ১লা জুলাই থেকে এই সুবিধা কার্যকর হয়েছে।
চীনের এই পদক্ষেপকে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে স্বাগত জানানো হয়েছে। দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে একে বড় একটি কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা আশা প্রকাশ করে বলেছেন, এর ফলে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে। দুই দেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর হবে।
চীনের এই সিদ্ধান্ত যেহেতু ভারতের সঙ্গে দেশটির সামরিক বিবাদের সময়ই এসেছে, সেহেতু এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক নজর কেড়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ধরে নিয়েছে যে, এটি চীনের কৌশলগত পদক্ষেপ। একে আখ্যা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশকে জিতে নেয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে। যেই দেশটি কিনা ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। তবে চীনা সিদ্ধান্তকে ঘিরে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক পর্যালোচনা করলে চিন্তার উদ্রেক হয় যে, চীনের এই সিদ্ধান্ত কি নতুন কিছু? নাকি সকল স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দেয়া সুবিধার মতোই বাংলাদেশকে এই সুবিধা দেয়া হয়েছে?
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালের পর। বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের স্বল্পসময় পর। সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর গত ৪ দশকে এটি কেবল ধারাবাহিকভাবে সামনে এগিয়েছে।
চীনকে বাংলাদেশ ‘সবসময়ের বন্ধু’ মনে করে। দুই দেশ একটি কৌশলগত আংশিদারিত্বেও শামিল হয়েছে। এছাড়া চীনের বহুল আলোচিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এ বাংলাদেশ প্রথিতযশা আংশিদার।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রস্ফুটিত হওয়ার পেছনে অর্থনৈতিক সম্পর্ক একটি বড় কারণ ছিল সবসময়। চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক আংশিদার। দেশটি বাংলাদেশের আমদানির প্রধান উৎস। ২০১৯ সালে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৮০০ কোটি ডলার। এর বৃহৎ অংশই চীন থেকে আমদানি। বাণিজ্য ব্যাপকভাবেই চীনের দিকে ঝোঁকা।
বাণিজ্যের দিক থেকে এই ব্যাপক ভারসাম্যহীনতার কারণে বাংলাদেশ অনেকদিন ধরেই চীনকে বাণিজ্য ভারসাম্য কমিয়ে আনার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে চীন বাংলাদেশের ৩০৯৫টি পণ্য আমদানির ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করে। বর্তমান ঘোষণায় ৫১৬১টি পণ্যকে একই সুবিধা দেয়া হয়েছে। এছাড়া এশিয়া-প্যাসিফিক বাণিজ্য চুক্তির সদস্য অনুযায়ী বাংলাদেশ অগ্রাধিকারমূলক ট্যারিফ সুবিধা পেয়ে আসছে।
চীন ২০১০ সাল থেকে এলডিসি-ভুক্ত দেশগুলোকে শুল্কমুক্ত কোটা সুবিধা দিয়ে আসছে। প্রথমে ২৪টি দেশকে এই সুবিধা দেয়া হয়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশকে আংশিকভাবে এই সুবিধা দেয়া হয়। বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ রপ্তানি পণ্যকে শুল্কমুক্ত প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। দুই দেশের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিবেচনায়, এই ধরণের সুবিধা বাংলাদেশকে অনেক আগেই দেয়া উচিৎ ছিল। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, যার আকার ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার, সেই চীন যেখানে অনেক দেশকে অনেক আগেই এই সুবিধা দিয়েছে সেখানে বাংলাদেশকে সকল পণ্যের ওপর শুল্কমুতক সুবিধা দেয়া নিয়ে চীনের দ্বিধা অনেককেই বিস্মিত করেছে।
১৯৭৩ সালে ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ প্রকল্পের আওতায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্রথম বাংলাদেশকে ‘শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার’ প্রদান করে। এই সুবিধা দেশটির বাণিজ্য বৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে। দেশটির রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাত এই সুবিধার প্রধান সুবিধাভোগী হয়েছে। ইইউ বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বৃহত্তম ক্রেতা। একইভাবে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত ২০১১ সালে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। তবে ২৫টি বিশেষ পণ্যকে এই সুবিধার বাইরে রাখা হয়েছে।
চীনের এই পদক্ষেপ তাই অনেকটা বিলম্বিত সিদ্ধান্ত। এছাড়া ঠিক কতদিন বাংলাদেশ এই সুবিধা পাবে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ ২০২৪ সালের মধ্যেই মধ্য-আয়ের (এমআইসি) দেশে পরিণত হবে। এরপর এই শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সহ দেশটি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এতদিন পেয়ে আসা অনেক সুবিধা আর পাবে না। তাই বাংলাদেশি পণ্য চীনা বাজারে বেশ সংক্ষিপ্ত সময়ই এই শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। এই স্বল্প সময়ে এই সুবিধা দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, রপ্তানি রাতারাতি বৃদ্ধি করা যায় না। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন হয়।
সম্প্রতি, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা দূত ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন যে, বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিৎ তাদের পণ্যে বৈচিত্র্য আনা। পণ্যের মান উন্নত করা। তবেই এই সুবিধার সর্বোচ্চ বাংলাদেশ ভোগ করতে পারবে। তবে বাংলাদেশে বিশ্লেষকরা বলছেন যে, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তেই থাকবে। চীনের ওপর নির্ভরশীলতাও বাড়বে, বিশেষ করে কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে।
চীন ও ভারতের মধ্যে তুলনা করা ঠিক নয়। বিশেষ করে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে এই দুই দেশের সম্পর্কের তুলনা করা উচিৎ নয়। বাংলাদেশ সরকার শান্তি এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে খোলামেলাই ছিল। সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পরিচর্যা করতেই সরকার সতর্ক ছিল।
তবে দেশটি চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। আর দুই দেশের সঙ্গেই উষ্ণ সম্পর্ক রক্ষা করতে পারায় সরকারকে কৃতিত্ব দেওয়া উচিৎ। দুই বৃহৎ এশিয়ান দেশের সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতা ধরে রাখতে পারায় বাংলাদেশ চীন ও ভারত থেকে উদার অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়েছে। চীন বাংলাদেশকে ৩০০০ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছে। অপরদিকে ভারত এখন পর্যন্ত ১০০০ কোটি ডলারের উন্নয়ন সহায়তা দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশকে দেয়া ভারতের ৩০০০ কোটি ডলারের উন্নয়ন সহযোগিতার সর্ববৃহৎ গ্রহীতাই হলো বাংলাদেশ।
একটি দেশের সঙ্গে অপরটিকে তুলনা করা অপ্রয়োজনীয় সংশয় জন্ম দেয়। এই ইস্যুগুলোর সুক্ষ বিশ্লেষণ প্রণয়নে ও ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টিতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারে মিডিয়া ও সুশীল সমাজ। এছাড়া সমৃদ্ধশালী দেশগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে, বিশেষ করে অসম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করার ক্ষেত্রে।

(ভারতের প্রভাবশালী থিংকট্যাংক ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর সিনয়র ফেলো জয়ীতা ভট্টাচার্যের এই নিবন্ধ থিংকট্যাংকটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status