শেষের পাতা

নারায়ণগঞ্জে ব্যবসায়ী হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা ঘাতকের

স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে

৭ জুলাই ২০২০, মঙ্গলবার, ৯:২২ পূর্বাহ্ন

দুই কারণে খুন করা হয় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মোটর পার্টস ব্যবসায়ী হেকমত আলী (৪৫)কে। গত রোববার ঘাতক রফিকুল ইসলাম সবুজ হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততার দায় স্বীকার করে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিল্টন হোসেনের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে সে কেন, কী কারণে এবং কীভাবে হেকমত আলীকে হত্যা করেছে তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছে আদালতে।

এদিকে মামলার অগ্রগতি নিয়ে সোমবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোডের সাইনবোর্ড এলাকায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)’র অস্থায়ী কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন পুলিশ সুপার এ আর এম আলিফ হোসেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক খন্দকার মো. জহির উদ্দিন, এসআই আবু সায়েম, এসআই তৌহিদুল ইসলাম।

সংবাদ ব্রিফিংয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)’র পুলিশ সুপার এআরএম আলিফ হোসেন বলেন, পিবিআই মামলাটির দায়িত্বভার গ্রহণের পর মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছে। যদিও ঘাতক সবুজ এককভাবে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। তারপরও এর সঙ্গে আরো কেউ জড়িত আছে কিনা তা আমরা খতিয়ে দেখছি।

এদিকে যেখানে তিন মাসেও থানা পুলিশ ব্যবসায়ী হেকমত আলী অপহরণ ও হত্যার ক্লু উদ্‌ঘাটন করতে পারেনি সেখানে মাত্র এক সপ্তাহে এর রহস্য উন্মোচন করায় পিবিআইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসী।

যে কারণে হত্যা করা হয় হেকমতকে
আদালতে ঘাতকের স্বীকারোক্তির আলোকে পিবিআই জানায়, রূপগঞ্জের কালাদি এলাকার মৃত কদম আলীর ছেলে হেকমত আলীর রাজধানী ঢাকার বংশালে মোটরপার্টসের দোকানে কর্মচারী হিসেবে চাকরি নেয় রফিকুল ইসলাম সবুজ। হেকমত আলী সম্পর্কে সবুজের খালু। এরপর ৪ বছর আগে হেকমত আলী রূপগঞ্জের ভূলতা গাউছিয়ার নূর ম্যানশনের নিচ তলায় একটি দোকান ভাড়া নিয়ে মেসার্স হাসান এন্টারপ্রাইজ নাম দিয়ে মোটরসাইকেল পার্টসের ব্যবসা শুরু করে। ওই দোকানে সবুজকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেয় সে। এক পর্যায়ে হেকমত আলী গত আড়াই বছর আগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বড় করার জন্য উক্ত মার্কেটের নিচ তলায় ১৩ ও ১৪ নং আরো দুটি দোকান ভাড়া নেয়। এই দোকানে সবুজ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে লভ্যাংশের ৪০% এর পার্টনার হয়। ব্যবসার দুই বছরের মাথায় ব্যবসার উন্নতি হতে থাকলে হেকমত আলী সবুজকে ব্যবসায়িক পার্টনার হওয়ার প্রস্তাব দেয়। পরে সবুজ ব্র্যাক ব্যাংক ভূলতা গাউছিয়া শাখা  থেকে ৫ লাখ টাকা উত্তোলন করে হেকমত আলীকে দেয় এবং সমানভাবে পার্টনার হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকে। কিন্তু  হেকমত আলী সবুজকে ব্যবসার লভ্যাংশ সমানভাবে না দিয়ে আগের নেয়া ৪০% দিয়ে নিজে ৬০% টাকা নেয়। এ নিয়ে খালু হেকমত আলীর সঙ্গে সবুজের মতবিরোধ দেখা দেয়। এরমধ্যে সবুজের বাবা-মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হেকমত আলী বিয়ের পাত্রী দেখতে গেলে সবুজ ও তার পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।  হেকমত আলী তার নাবালিকা কন্যা হাফসা (৯) কে সবুজের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সবুজ নাবালিকা কন্যাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করলে ঘটনার কয়েকদিন আগে হেকমত সবুজের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। এবং ব্যবসার হিসাবনিকাশ বুঝিয়ে দিতে সবুজের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। এতে সবুজও ক্ষিপ্ত হয় হেকমত আলীর ওপর। এবং ৭-৮ দিন দোকান বন্ধ রাখে সবুজ। ঘটনার দিন ৪ঠা এপ্রিল সকাল অনুমান ৭/৮টার দিকে হেকমত আলীকে সবুজ তার বাড়িতে যেতে বলে। এবং সকাল ৯টার দিকে হেকমত আলী সবুজের বাড়িতে যায়। সবুজ হেকমত আলীকে নাস্তা খাওয়ায়। এক পর্যায়ে সোফায় বসে টিভি দেখতে  দেখতে হেকমত ঘুমিয়ে পড়ে। তখন সবুজ পূর্বের ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে পেছন থেকে হেকমত আলীর গলায় গামছা পেঁচিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে হেকমতের হাত-পা বেঁধে ঘরে থাকা একটি খালি স্টিলের বড় ড্রামের (গ্রিজের ড্রাম) ভেতর ভরে। তারপর সিমেন্ট দিয়ে ড্রামের মুখ ভরে আটকিয়ে দেয়। এবং লাশভর্তি ড্রাম পরে রুমে রেখে দেয়। এরপর সন্ধ্যার দিকে হেকমত আলীর বাড়িতে যায় ঘাতক সবুজ। এবং হেকমত আলীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করে। তখন হেকমত আলীর স্ত্রী তার কাছে হেকমত আলী কোথায় জানতে চাইলে সে বলে যেহেতু সে তাবলীগ করে হয়তো কোথাও গেছে, চলে আসবে। এই কথা বলে নিজের বাড়িতে ফিরে আসে সবুজ। এবং পরদিন সকাল ৬টার দিকে লাশভর্তি ড্রাম একটি নসিমনে তুলে রূপগঞ্জের কুশাব এলাকায় গিয়ে নসিমন বিদায় করে দিয়ে সুযোগ বুঝে ড্রামটি পুকুরে ফেলে দেয়। এদিকে হেকমত আলী নিখোঁজের ঘটনায় একটি জিডি করেন তার স্ত্রী রোকসানা বেগম। এক পর্যায়ে ১৪ই এপ্রিল সবুজসহ ৪ জনকে আসামি করে অপহরণ মামলা দায়ের করেন হেকমতের স্ত্রী। ১৫ই এপ্রিল রূপগঞ্জ থানা পুলিশ সবুজকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ আসামি পক্ষের কাছ থেকে সুবিধা ভোগ করে ব্যবসায়ী হেকমত আলীকে উদ্ধারে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এক পর্যায়ে হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে ১৮ই জুন পিবিআইয়ের কাছে মামলাটি হস্তান্তর করা হয়। পরে প্রায় ৩ মাস জেলে থাকা অবস্থায় পিবিআই ২৯শে জুন সবুজকে রিমান্ডে আনে। পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে সবুজ হত্যার ঘটনা স্বীকার করে। এবং তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ২রা জুলাই সকালে পুকুর থেকে ড্রামভর্তি হেকমত আলীর লাশ উদ্ধার করা হয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status