প্রথম পাতা

মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে নতুন জীবন পেয়েছি

কাজল ঘোষ

৪ জুলাই ২০২০, শনিবার, ৮:৩৬ পূর্বাহ্ন

শেষ পর্যন্ত মনোবল হারাইনি। বারবার মনে হচ্ছিল রবার্ট ফ্রস্টের অমর সেই কবিতার কথা- মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ। ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমাকে যেতে হবে অনেক দূর। আর মনে হয়েছিল বিখ্যাত সেই চলচ্চিত্রটির কথা। আয়রন উইল। অর্থাৎ ইস্পাত কঠিন ইচ্ছা। আমেরিকান চিত্র পরিচালক চার্লস হেইড এই চলচ্চিত্রে দেখিয়েছেন কীভাবে একজন তরুণ সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এগিয়ে যায়। জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়। তার ইস্পাত-দৃঢ় মনোবল আর কঠিন প্রতিজ্ঞার ফলেই সম্ভব হয়েছিল জয়ী হওয়া। আমার বেঁচে থাকাও সম্ভব হয়েছে মনোবলের
যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কারণেই। কথাগুলো সুজন সম্পাদক ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় অগ্রণী কণ্ঠস্বর ড. বদিউল আলম মজুমদারের।
হাঙ্গার প্রজেক্টের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রধান ড. মজুমদার করোনায় আক্রান্ত হন মে মাসের শেষদিকে। গলা ব্যথা আর থেমে থেমে জ্বর। উপসর্গ দেখেই বুঝতে পারছিলেন করোনা হতে পারে। কারণ, ইতিমধ্যেই পরিবারের অপর তিন সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। স্ত্রী ও দুই কন্যা সেরে উঠেছে। বিএসএমএমইউ হাসপাতালের নমুনা পরীক্ষায় ড. মজুমদারের কোভিড পজিটিভ আসে। লম্বা সময় আইসোলেশনে থাকেন। দূর প্রবাস আমেরিকায় থাকা ছেলে চিকিৎসক মাহফুজ মজুমদারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নেন। আর নিজস্ব মনোবলের শক্ত ভিত নিয়ে মরণঘাতী করোনার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। এ সময় তিনি ভয়াবহ অসুস্থতার মধ্যেও নিজেকে কাজের সঙ্গে যুক্ত রেখেছেন। সব সময় ইতিবাচক চিন্তা করেছেন। জুনের শেষদিকে ফের মুখোমুখি হন নমুনা পরীক্ষার। ফলাফল নেগেটিভ আসে। তিনি সম্পূর্ণ শঙ্কামুক্ত। মানবজমিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সেই করোনা জয়ের কথাই বলেছেন বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেন, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েই ফিরেছি। বহু মানুষ দোয়া চেয়েছেন, শুভ কামনা করেছেন, তাদের সকলের ভালোবাসায় নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। রমজানের ঈদের পরপরই স্ত্রী ও দুই কন্যা আক্রান্ত হয়। মে মাসের শেষদিকে আমি। আমার নিজের আগে থেকেই বেশকিছু স্বাস্থ্যগত জটিলতা ছিল। হার্টে রিং পরানো। কাজেই করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় আমার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ছিল অনেক বেশি।
দ্বিতীয় সন্তান নিউ ইয়র্কে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা সেবাদানে যুক্ত। সেখানকার ব্রুকভেইল হাসপাতালে কাজ করছে। সেখানকার বহু করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সে নিয়মিত টেলিফোনে চিকিৎসা দিয়েছে। কখন, কি করতে হবে পরামর্শ দিয়েছে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এটা সম্পূর্ণ মনোবলের যুদ্ধ। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হা-হুতাশ করলে চলবে না। এতে রোগ বাড়বে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। রোগী দুর্বল হয়ে যাবেন। কাজেই সব সময় শক্ত মনোবল নিয়ে এরসঙ্গে লড়তে হবে।
তিনি বলেন, জীবনে এর আগেও অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়েছি। চল্লিশের দশকে আমার জন্মের পরপরই কলেরায় আক্রান্ত হই। মরে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছিল। মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম। আমার মা হাল ছাড়েননি। সে যাত্রা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। এরপর চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়ি আমেরিকায়। ১৯৮৩ সালের ঘটনা। সিয়াটল থেকে দূরে একটি পাহাড়ি এলাকায় নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে যাচ্ছিলাম। উল্টোদিক থেকে একটি ছোট ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে আমার পাঁজড়ের অনেকগুলো হাড় ভেঙে যায়। পরে সেখান থেকে হেলিকপ্টারে সিয়াটলের হাসপাতালে নেয়া হয়। সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকেও ভাগ্যগুণে বেঁচে আসি। মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ তখন গায়ে লেগেছে। কখনো মনোবল হারাইনি। মনোবলের যুদ্ধেই আমি জিতেছি। এবারো তার ব্যথ্যয় হয়নি।  
এবার আমি যখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হই তখন বারবার মনে হয়েছে আমাকে বাঁচতে হবে। আমি যে কাজগুলো শুরু করেছি তা গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে ১৯৯১ সালে সামাজিক কাজে যুক্ত হই। বাংলাদেশের মানুষের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করি। প্রয়াত মোজাফফর আহমদের মতো মানুষদের নিয়ে গড়ে তুলি সুজন। স্বেচ্ছাব্রতী গড়ে তুলি দেশজুড়ে। তাদেরকে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজে সম্পৃক্ত করি। আমি যেমনটি তাদের উদ্বুদ্ধ করেছি তেমনি তারাও তাদের নানা কর্মস্পৃহা ও স্পর্শ দিয়ে আমাকে বলিষ্ঠ করেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে এ কাজগুলোকে এগিয়ে নিতে হবে, রোগশয্যায় বারবার এ কথাগুলোই মনে হয়েছে। যে কাজগুলো শুরু করেছি তা এগিয়ে নেয়ার জন্যই বেঁচে থাকতে হবে। তিনি যুক্ত করেন, করোনা মহামারি হয়তো অনেকদিন অব্যাহত থাকবে আর এরসঙ্গে লড়াই করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। আমাদের করোনা সহিষ্ণু হতে হবে। এই লক্ষ্যে দেড় হাজার গ্রামে আমাদের স্বেচ্ছাব্রতীরা কাজ করে যাচ্ছে। এই গ্রামগুলোকে করোনা সহিষ্ণু গ্রামে রূপান্তরের কাজ চলছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এ ব্যবস্থার মাধ্যমেই আমরা করোনা মুক্ত হতে পারবো। মূলত থ্রি ডব্লিউ - Washing Hand, Wearing Musk, Watching Distance এর ভিত্তিতে আমাদের স্বেচ্ছাব্রতীরা কাজ করে যাচ্ছে। প্রথমত, মানুষকে সচেতন করা, মানুষের অভ্যাসে পরিবর্তন আনা। আমার নিরাপত্তা, আমার দায়িত্ব এর ভিত্তিতে সকলকে সচেতন করা। দ্বিতীয়ত, যারা আক্রান্ত তাদের পৃথক করা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। আর যারা এই সময়ে বেকার বা কর্ম হারিয়েছেন তাদের তালিকা করে স্থানীয় প্রশাসনকে দেয়া। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে দরিদ্র মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। ইতিমধ্যেই আমাদের স্বেচ্ছাব্রতীরা প্রায় আড়াই কোটির বেশি অর্থ ও বিভিন্ন সামগ্রী সংগ্রহ করে মানুষকে সহায়তা করেছে।
আমি বিশ্বাস করি, করোনা মুক্ত হতে হলে আগে কমিউনিটিতে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। হাঙ্গার প্রজেক্টের স্বেচ্ছাব্রতীরা দেশজুড়ে এই কাজটিই করছে। এর সঙ্গে সুজনের অনেক সদস্যও এগিয়ে এসেছে। দুটি স্লোগান সামনে নিয়ে আমরা এ কাজগুলো করছি। ‘সকলে মিলে শপথ করি, স্থানীয় পর্যায়ে করোনা প্রতিরোধ করি’ এবং ‘আমার স্বাস্থ্য, আমার দায়িত্ব’।
সবশেষে তিনি যারা করোনা থেকে মুক্ত হতে পারেননি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, আমরা যারা করোনাভাইরাসের হাত থেকে মুক্ত হয়েছি তাদের সমাজের প্রতি দায়িত্ব অনেক। যারা করোনা জয়ী তাদের সংগঠিত করে অন্যদের সচেতন করা এবং যেন এর বিস্তার না হয় তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলাই হবে এ সময়ের সর্বোচ্চ দেশপ্রেম।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status