প্রথম পাতা

অর্থবছর শেষ, এখনো কেনাকাটা হয়নি ত্রাণ অধিদপ্তরের

আলতাফ হোসাইন

২ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৯ পূর্বাহ্ন

বন্যায় দেশের দশটি জেলা ইতিমধ্যেই প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শত শত পরিবার। এছাড়া বন্যার পানি দেশের ১৫টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে। এতে চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে এসব অঞ্চলের খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষগুলো। প্রতিবছরই দেশের এমন দুর্যোগের সময় এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায় মানুষের জন্য সে বছর ১৭০ কোটি টাকার ঢেউটিন, শুকনো খাবার ও কম্বল ক্রয় করে সরকার। কিন্তু ২০১৯-২০২০ অর্থবছর শেষ হলেও কেনাকাটা শেষ করতে পারেনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। গত জানুয়ারিতে এ সকল কেনাকাটার জন্য টেন্ডার আহ্বান করে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর। কিন্তু বিধি-বহির্ভূতভাবে ক্রয় কমিটির সভাপতি নিয়োগ দেয়ায় বাদসাধে মন্ত্রণালয়। এরপর রি-টেন্ডার করা হয়। অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের এমন রশি টানাটানিতে বছর শেষ হয়ে গেলেও এখনো শেষ হয়নি কেনাকাটা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৫টি প্যাকেজে ৭৫ কোটি টাকার ঢেউটিন ক্রয়ের দরপত্র আহ্বান করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। টেন্ডারে ৬টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে। এসব প্রতিষ্ঠানের ঢেউটিনের গুণগত মান বুয়েট কর্তৃক পরীক্ষা করা হয়। গত ৩০শে জানুয়ারি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে ৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫টি প্রতিষ্ঠানের ঢেউটিনের যাচিত মান সঠিক না পাওয়ায় এবং দাখিলকৃত কাগজপত্র সঠিক না থাকায় মেসার্স উর্মি এন্টারপ্রাইজ, আলাল এগ্রো ফুড প্রডাক্টস, কর্ণফুলী গ্যালভানাইজিং মিল্‌স লিমিটেড, মেসার্স জয় এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স সানজি ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে নন রেসপনসিভ করা হয়। আর ৫টি প্যাকেজেই কেওয়াই স্টিল মিল্‌স লিমিটেডকে রেসপনসিভ করে মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু বিধি-বহির্ভূতভাবে ক্রয় কমিটি সভাপতি মনোনয়ন দেয়ায় সেই প্রস্তাব অনুমোদন করেনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপণা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে কয়েক দফা চিঠি চালাচালি হয় মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে।
গত ৩০শে মার্চ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. শাহজাহান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ১৮ই মার্চ ২০২০ তারিখের ৫১,০১,০০০০,০১৬,০৭,০১২,১৯,১৯৪ নং স্মারকে মহাপরিচালক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠন সংক্রান্ত যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তা যুক্তিসঙ্গত এবং গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ দরপত্রটি ৫০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে হওয়ায় বিষয়টি সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপন যোগ্য। এ মন্ত্রণালয়ের ২০১৯ সালের ২০শে নভেম্বরের ৫১,০০,০০০০,৪২১,০৭,০১৫,১৯,৪১৪ নং স্মারকে পিপিএ-২০০৬ এবং পিপিআর-২০০৮ এর বিধিবিধান অনুযায়ী ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ঢেউটিন ক্রয়ের স্পেসিফিকেশন এবং প্রশাসনিক অনুমোদন প্রদান করে এবং মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে যুগ্ম সচিব একেএম টিপু সুলতানকে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু মহাপরিচালক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর তাকে মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি করে, যা বিধি-বহির্ভূত। এ অবস্থায় পিপিএ-২০০৬ এবং পিপিআর- ২০০৮ এর সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান অনুযায়ী দরপত্র মূল্যায়ন করে প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য অনুরোধ করা হয়।
সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আমলে নিয়ে দরপত্র মূল্যায়নে নতুন কমিটিকে আবারও দরপত্র আহ্বান করে অধিদপ্তর। নতুন এই কমিটি আগের কমিটি নমুনা ঢেউটিনের বুয়েট কর্তৃক গুণগত মান পরীক্ষায় যাচিত মান সঠিক না পাওয়ায় এবং দাখিলকৃত কাগজপত্র সঠিক না থাকায় নন রেসপনসিভ হওয়া কর্ণফুলী গ্যালভানাইজিং মিল্‌স লিমিটেডকে ৪টি প্যাকেজে এবং আগের মূল্যায়ন কমিটির ৫টি প্যাকেজেই রেসপনসিভ হওয়া কেওয়াই স্টিল মিল্‌স লিমিটেডকে ১ প্যাকেজে রেসপনসিভ করে কাজ দেয়ার জন্য সুপারিশ করার জন্য যখন তোড়জোড় চলছে। এরইমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর মহাপরিচালক মো. মোহসিনকে পদোন্নতি দিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। গত সোমবার তিনি মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছেন।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, এর আগের বছরগুলোতে প্রতি বান্ডিল ঢেউটিন ক্রয় করা হয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকায়। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানগুলো টেন্ডারে দর দিয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার টাকায়। দর কমিটির দর রয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা, তার থেকে কম মূল্যে দিচ্ছে আগের টেন্ডারে নন রেসপনসিভ হওয়া দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। দুর্যোগকালীন অসহায় মানুষকে এসব নিম্নমানের পণ্য বিতরণ করা হয়। পণ্য গ্রহণকারী কমিটিকে ম্যানেজ করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্ন্নমানের পণ্য সরবরাহ করে। ফলে বঞ্চিত হয় অসহায় হতদরিদ্র মানুষ। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অন্যদিকে শুকনা খাবার, চাল, ডাল, লবণ, চিনি, চিঁড়া, সয়াবিন তেল, নুডুলস-এর জন্য ৫টি লটে দরপত্র আহ্বান করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। গত ১লা জুন দরপত্র খোলা হয়। এতে দেখা যায়, মেসার্স সরদার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ২টি লটে, মেসার্স সামসিন্ডিকেট লিমিটেড ২টি লটে এবং বাকি ১টি লটে সফ টাচ্‌ নেটওয়ার্ক নামের একটি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতাগণ। এরমধ্যে ৬ নং প্যাকেজে সর্বনিম্ন দরদাতা মেসার্স সরদার ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে বাদ দিয়ে ২য় সর্বনিম্ন দরদাতা মেসার্স নওশী ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ৮ নং প্যাকেজে সর্বনিম্ন দরদাতা মেসার্স সরদার ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে বাদ দিয়ে ২য় সর্বনিম্ন দরদাতা মেসার্স আলাল এগ্রোফুড প্রডাক্ট লিমিটেডকে কার্যাদেশ দেয়ার নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। সর্বনিম্ন্ন দরদাতাকে কাজ না দেয়ায় রাষ্ট্রের প্রায় সোয়া কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মেসার্স সরদার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এর স্বত্ব্বাধিকারী আবদুল কাদের বলেন, আমরা দুইটা প্যাকেজে সর্বনিম্ন্ন দরদাতা হয়েছি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট দপ্তরেই শুকনো খাবার সরবরাহ করেছি। শুকনো খাবারের ইজিপিতে দেয়া টেন্ডারের বর্ণনায় ডালের কথা থাকলেও পরবর্তীতে ব্রিফ অংশে দেশি ডালের কথা লেখা হয়েছে। একইভাবে বর্ণনায় নুডুলসের কথা থাকলেও পরবর্তীতে ইন্সট্যান্ট নুডুলসের কথা জুড়ে দেয় অধিদপ্তর। যা পিপিআর-২০০৮ এর স্পষ্ট লঙ্ঘন। এজন্য হয়তো আমাদের বাদ দেয়া হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সচিব মো. মোহসিন মানবজমিনকে বলেন, বিষয়টি আমি এখনো জানি না। কাজটিতো শেষ হয়নি। এ নিয়ে আমাদের সভা হবে তারপর দেখা যাবে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি-না। আপনি যেটা বলছেন এমনটা হলে অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status