শেষের পাতা
সিলেটের আর্তনাদ শোনার কেউ নেই
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
১ জুলাই ২০২০, বুধবার, ৯:২২ পূর্বাহ্ন
ডিও দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও পাঠিয়েছেন নানা প্রস্তাবনা। সিলেটের প্রশাসন থেকেও জানানো হচ্ছে সংকটের কথা। কিন্তু সিলেট সম্পর্কে ঘুম ভাঙছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। করোনা নিয়ে কোথায় যেন আটকে আছে সিলেট। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সিলেটের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। এজন্য ক্ষুব্ধ সিলেটের নীতি-নির্ধারক মহলও। বিষয়টিকে তারা ‘সিলেট বিদ্বেষী’ মনোভাব বলে উল্লেখ করেছেন। প্রায় ৩ মাস। অনেকটা অসহায়ের মতো করোনার সঙ্গে লড়াই করছে সিলেটের মানুষ। ফ্রন্টলাইন যুদ্ধ চিকিৎসকদের অবিরাম লড়াইয়ের কারণে কিছুটা স্বস্তিতে মানুষ। কিন্তু তারাও লড়াই করতে ক্লান্ত। সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন না। সিলেট জেলাতেই এখন প্রতিদিন গড়ে ১শ’ করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। বিভাগে এ সংখ্যা প্রায় দিগুণ। সিলেট বিভাগে এখন রোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। সিলেট জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা আড়াই হাজারের কাছাকাছি। মারা গেছেন ৭০ জন। মূল বিষয়টি হচ্ছে- করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। সিলেটের ১৯টি এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করে প্রস্তাব পাঠানো হলেও লকডাউনের ঘোষণা আসেনি। এ কারণে সিলেটের সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। সংক্রমণ রোধ করার আরেকটি উদ্যোগ হচ্ছে কোভিড রোগীদের আইসোলেটেড করে রাখা। কিন্তু সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে সেই উদ্যোগও খুব কম। সিলেটের প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল নগরীর আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সে একটি ৫০০ কিংবা ১০০০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টার চালু করা যেতে পারে। সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী চেয়েছিলেন নগরীর পুরাতন কারাগারকে আইসোলেশন সেন্টার করতে। এসব প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনও এসব উদ্যোগে সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। সিলেট জেলার সাবেক সিভিল সার্জন ও সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্তমান উপ-পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায়ের প্রস্তাব হচ্ছে- সংক্রমণ রোধ করতে হলে আইসোলেটেড পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি কার্যকর। সুতরাং বড় আকারে আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন ছাড়া এই মুহূর্তে গত্যন্তর নেই। তার মতে- কোভিড আক্রান্ত হলেই রোগীকে আইসোলেটেড করে নিতে হবে। যাতে তার দ্বারা নতুন কেউ সংক্রমিত না হয়। চিকিৎসা নিয়েও চলছে এক ধরনের নাটকীয়তা। সিলেটে কোভিড চিকিৎসার একমাত্র হাসপাতাল ১০০ শয্যার শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল। গত শনিবার থেকে এর সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছে খাদিমপাড়ার ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল। এর বাইরে বেসরকারিভাবে যে দুটি হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসা চলছে সে দুটি হাসপাতালের গলাকাটা বিল নিয়ে ক্ষোভ চলছে। সিলেটের স্বাস্থ্য বিভাগ মে মাসেই চেয়েছিল ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট সিলেটের বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে সরকারিভাবে ভাড়া নিতে। কিন্তু টাকার অঙ্ক বেশি হওয়ার কারণে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা সেখান থেকে পিছু হটেন। এরপর তারা সরকারিভাবে আরো ৮১ শয্যার দুটি হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসার প্রস্তুতি শুরু করেন। প্রবাসীদের অর্থায়নে দক্ষিণ সুরমা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও খাদিমপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা সংযোগ করা হচ্ছে। সিলেট সিটি করপোরেশনসহ বেসরকারি উদ্যোগে নগরীর বেসরকারি পপুলার হাসপাতালকে আইসোলেশন সেন্টার করার প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে। সেখানে শুরু রোগীদের আইসোলেশন ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া যাবে। অক্সিজেন কিংবা ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হলে শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে রোগী পাঠানো হবে। এদিকে- এই উদ্যোগেও নিজ থেকে সন্তুষ্ট নন সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি জানিয়েছেন- বার বার প্রস্তাবনা পাঠানো হচ্ছে সিলেট থেকে। কিন্তু কোনো রিপ্লাই নেই। কেউ কোনো কথা শুনছে না। মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীও একাধিক ডিও দিয়েছেন। সেখানে কোনো কাজ হচ্ছে না। ফলে কোভিড চিকিৎসায় বেসরকারি উদ্যোগ আছে। সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া না পেলে কোনোভাবেই সমন্বয় করে চিকিৎসা সেবা চালুর সুযোগ নেই। সিলেট বিভাগে মাত্র দুটি পিসিআর ল্যাবে কোভিড পরীক্ষা চলছে। প্রতিদিন সিলেট বিভাগে ১ হাজারে মতো নমুনা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু স্থানীয়ভাবে পরীক্ষা করা সম্ভব হয় ৪০০ জনের। বাকি নমুনা পরীক্ষার জন্য ঢাকার পাঠাতে হচ্ছে। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি এবং আরো দুটি জেলায় দুটি পিসিআর মেশিন চালুর প্রস্তাব করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। তিনি এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছেন। কিন্তু তার এই প্রস্তাবেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাড়া মেলেনি। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল জানিয়েছেন- ‘মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলেটের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। তিনি সিলেটে পরীক্ষা বাড়ানো এবং চিকিৎসার পরিধি বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করছেন। এরপরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সাড়া মিলছে না।’ তিনি বলেন- ‘একটি সিলেট বিদ্বেষী মহল এ কাজ করছে বলে ধারণা স্পষ্ট হচ্ছে। নতুবা এখন পর্যন্ত কোভিড চিকিৎসায় সিলেটবাসীর দাবি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমলে নিচ্ছে না। এরা সরকারের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করতে এমনটি করছে বলে জানান তিনি।’ এদিকে- সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও কোভিড চিকিৎসা শুরু না হওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শুরুতেই ওসমানী মেডিকেলকে করোনামুক্ত রাখতে তারা কোভিড চিকিৎসা শুরু করেনি। এখন হাসপাতালে রোগী কম। আলাদাভাবে বিল্ডিং ও ওয়ার্ডকে আইসোলেটেড করে কোভিড চিকিৎসা শুরু করা যায় বলে জানিয়েছেন অনেকেই। কিন্তু ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসা শুরু করা হচ্ছে না। এদিকে- সিলেটের সুধীজনেরাও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ এবং প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট না হওয়ার কারণে এবার তারা প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন।