অনলাইন

সিএনজি অটোরিকশা চালকদের বোবা কান্না

শামীমুল হক

৩০ জুন ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:৩২ অপরাহ্ন

প্রতীকী ছবি

বোবা কান্নায় গুমড়ে মরছেন সিএনজি অটোরিকশা চালকরা। সড়কে হন্য হয়ে খোঁজছেন যাত্রী। দিনের বেশির ভাগ সময় গাড়ির চাকা থাকছে অচল। দীর্ঘ অপেক্ষার পর যাত্রী পেলেও ভাড়া নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। এ অবস্থায় অনেকেই পরিবার পাঠিয়ে দিয়েছেন বাড়ি। নিজে উঠেছেন কোন মেসে। দেশে করোনা থাবার পর দীর্ঘ সময় সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। এ সময় তারা হয়ে পড়েন কর্মহীন। গাড়ি চলাচলের অনুমতি দেয়ার পর তাদের মুখে হাসি ফুঁটে। কিন্তু এ হাসি কদিন যেতে না যেতেই মিইয়ে যায়। কারণ যাত্রীর অভাব। এ অবস্থায় সিএনজি মালিকরা ডেইলি জমা ১০০০ টাকা থেকে কমিয়ে ৬০০ টাকা করে দেন।

আধা বেলার জন্য কমিয়ে করা হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের ধাক্কা লেগেছে সকল খাতেই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুললেও ক্রেতা নেই। সরকারি, বেসরকারি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে রোস্টার করে ডিউটি করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ অবস্থায় রাস্তায় মানুষের সংখ্যা কমে যায়। সিএনজি অটোরিকশা চালকরা উৎসাহ নিয়ে রাস্তায় নেমেই থমকে যান। দেখেন যাত্রী নেই। অথচ এক সময় একটি সিএনজি চালিত ফোরস্টোক অটোরিকশার জন্য সড়কে মানুষ অপেক্ষা করত। বেশিরভাগ গাড়িতেই থাকত যাত্রী।

কোন খালি সিএনজি পেলে একাধিক লোক গিয়ে হাজির হতো। এই যাবে, এই যাবে ডাকে চালক কার সঙ্গে কথা বলবেন তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যেতেন। একজনের সঙ্গে কথা বললে, গাড়ি ভাড়া হাঁকাতেন ডাবল। গেলে যান, না গেলে নাই- এ অবস্থা ছিল। যাত্রীরাও টাকার দিকে তাকাতেন না। গাড়ি যে পেয়েছেন তাতেই খুশি। ভাড়া যা-ই হোক। কোন নিয়ম কানুন ছিল না কোন ক্ষেত্রেই। ফলে যে যত পারে ভাড়া নিয়েছে। আর এখন যাত্রীর অভাবে রাজধানীর রাজপথে সিএনজি চালকরা লোকাল ট্রিপ মারছেন। চিৎকার করে ডাকছেন এই যাবেন? যাত্রাবাড়ী, যাত্রাবাড়ী। ৩০ টাকা। ফার্মগেটে দঁড়িয়ে ডাকছেন মিরপুর-১০, মিরপুর-১০। ৪০ টাকা। তারপরও যাত্রী মেলেনা। কখনো কখনো চারজন যাত্রী মেলাতে ঘন্টা পেরিয়ে যায়। এমন দুর্দশায় পড়েছেন সিএনজি চালকরা।

সিএনজি চালক টিপু মিয়া বলেন, যাত্রীর জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হয়। করোনা আমাদের শেষ করে দিয়েছে। সামনে কি হয় জানিনা। তবে ভাল কিছু হবে এমন লক্ষণ নেই। টিপুর বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনায়। তিনি বলেন, আগে গাড়িতে সিএনজি লাগত ১০০ থেকে ১৫০ টাকার। এখন সিএনজি লাগে ২০০ থেকে ২৫০ টাকার। কারণ, খালি গাড়ি নিয়ে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াতে হয় যাত্রীর জন্য। এতে করে সিএনজি পুুড়ছে বেশি। অন্যদিকে গাড়ি মালিকের জমা ৬০০ টাকা দিয়ে এখন হাতে তেমন কিছু থাকেনা। টিপুর কথা, জমা না কমালে চালকরা গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামার সাহসই পেতেন না।

তিনি বলেন, পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। রায়েরবাগের খানকা শরিফ রোডের পাঁচতলা ভবনের নীচ তলায় মেসে থাকি। মেস ভাড়া ১৫০০ টাকা। তারপর বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, বুয়ার বিল, ময়লার বিল দিতে হয়। মাসের খাওয়া খরচ তো আছেই। সব মিলিয়ে আর পারছি না। চোখে অন্ধকার দেখছি।

ঢাকা মেট্রো- থ ১৪- ৫২১১ সিএনজি গাড়ি চালক রফিক মিয়া বলেন, যাত্রী না পেয়ে নতুন কৌশল অবলম্বন করি। প্রতিদিন যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট লোকাল ট্রিপ মারতে থাকি। যাত্রী প্রতি ৩০ টাকা করে নেই। এতেও চার জন যাত্রী জোগাড় করতে কখনো কখনো ত্রিশ চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে যায়। যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত মাত্র ১২০ টাকা ভাড়া পাই। আবার ফার্মগেটে ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষার পর যাত্রাবাড়ী আসি একইভাবে। সারাদিনে মালিকের জমা দিয়ে এক থেকে দেড়শ টাকা কোন দিন পাই।

আবার কোন দিন শূণ্য হাতে ঘরে ফিরতে হয়। তিনি বলেন, আগে যাত্রাবাড়ী থেকে কমপক্ষে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় ফার্মগেট যেতাম। রফিক মিয়া বলেন, এভাবে চললে পরিবার নিয়ে বাড়ি চলে যেতে হবে। সংসার খরচই এখন উঠাতে পারছিনা। ঘর ভাড়া দেবো কোথা থেকে? রফিক মীরহাজীরবাগ টিনসেড বাড়িতে ভাড়া থাকেন। মাসে ঘর ভাড়া ৬৫০০ টাকা। গত তিন মাস ধরে ভাড়া দিতে পারেন না। বাড়িওয়ালা এসে চাপ দিচ্ছেন। রফিক বলেন, আমার বাড়ি বরিশালে। ঘরে স্ত্রী ও তিন সন্তান।

এরমধ্যে দুই সন্তান স্কুলে পড়ে। একজন থ্রিতে। অন্যজন সিক্সে। আরেকজন ছোট। স্বপ্ন ছিল ঢাকায় সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করব। সেই স্বপ্ন এখন আর পূরণ হবেনা। গ্রামে গিয়ে কি করবেন? রফিকের উত্তর সেখানে গিয়েও সিএনজি চালাব। কিন্তু ঘর ভাড়াতো লাগবেনা। ছেলে মেয়েকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করালে পয়সা লাগবেনা। রফিক বলেন, আমাদের এ অবস্থা দেখে সিএনজি মালিকরা জমার টাকা কমিয়ে দিয়েছে। আগে যেখানে সারা দিনের জমা ছিল ১০০০ টাকা। এখন সেখানে দিতে হয় ৬০০ টাকা। আবার অর্ধেক বেলার জন্য জমা ৩০০/ ৩৫০ টাকা। করোনার আগে নেয়া হতো ৬/৭ শ টাকা। আমরা যারা জমা দিয়ে সিএনজি চালাই তাদের লক্ষ্য থাকে আগে জমার টাকা উঠানো। এরপর যা পাব তা আমাদের। কিন্তু এখন জমার টাকা উঠাতেই কষ্ট হয়ে যায়।

সকালে রায়েরবাগ স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, কমপক্ষে ২০টি সিএনজি ফোরস্টোক গাড়ি যাত্রীর অপেক্ষায়। চালকরা দাঁড়িয়ে আছেন। একজন যাত্রী আসা মাত্রই ষাটোর্ধ মোতাহার এগিয়ে যান। কোথায় যাবেন? চলেন। যাত্রী বলেন, সদরঘাট যাবো। কত? চালকের জবাব, যা দেবার দিয়েন। এ সময় অন্য একজন চালক এসে বলেন, কাল না আপনি আমার গাড়ি দিয়ে গিয়েছিলেন। ১০০ টাকা দিয়ে। এ সময় মোতাহার জবাব দেন, তুই যদি ১০০ টাকায় যেতে পারিস আমি পারবনা কেন? আসেন ভাই আমার গাড়িতে আসেন। ১০০ টাকাই দিয়েন। ওই যাত্রী ইব্রাহিম ব্যবসা করেন সদরঘাটে। তিনি বলেন, করোনায় আমাদের অনেক শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। করোনার পর এ শিক্ষা আমাদের মধ্যে থাকলেই হলো।

আগে রায়েরবাগ থেকে সদরঘাট যেতে লাগত ২০০ থেকে ২৫০ টাকা সিএনজি ভাড়া। চালকদের কাছে যাত্রীরা ছিল জিম্মি। কত অনুনয় বিনয় করে তাদের রাজি করাতে হতো। এখন ১০০ থেকে ১২০ টাকায় যাই। চালকরা খুশি হয়ে নেন। ইব্রাহিম বলেন, এটাই হলো আসল ভাড়া। আরেক সিএনজি চালক জসিম বলেন, আর পারছিনা। একদিকে যাত্রীর অভাব, অন্যদিকে আগের চেয়ে অর্ধেক ভাড়ায়ও যাত্রী গন্তব্যে যেতে চাননা। এ অবস্থায় আমাদের অবস্থা তথৈবচ। মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। এ অবস্থা থেকে কবে মুক্তি পাবো কে জানে?

ঢাকা মেট্রো- থ- ১৪- ৭৫১৯ সিএনজি অটোরিকশার চালক মনির ইতোমধ্যে পরিবার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার বাড়ি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে। তিনি বলেন, করোনায় করুণ অবস্থায় পড়ে যাই। দিশাহারা হয়ে গত ঈদে পরিবার বাড়ি পাঠিয়ে দেই। এখন নিজে একটি মেসে উঠেছি। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে ২/৩ শ টাকা নিয়েও ঘরে ফিরতে পারিনা। এ টাকা দিয়ে নিজে চলব, না বাড়িতে পরিবারের কাছে পাঠাব? এ চিন্তায় ঘুম হয় না। তিনি বলেন, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি যাত্রীর জন্য। পাই না। আর পেলে যত টাকাই হোক ছাড়িনা। মাথায় কাজ করে জমার টাকার কথা। এই জমার টাকা উঠানোর পর যেটা থাকবে সেটা আমার। এভাবে চলতে থাকলে আমাকেও রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status