মত-মতান্তর

মাছি মারা কেরানি

শামীমুল হক

২৪ জুন ২০২০, বুধবার, ১০:৪০ পূর্বাহ্ন

বাঙালি অনুকরণের জাতি। একজন এটা করেছে তাই আমাকেও করতে হবে। এমন মানসিকতা প্রায় সবার। এই করোনাকালেও বসে নেই এ জাতি। রাস্তাঘাটে একজন দাঁড়িয়ে কিছু একটা দেখছে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেখানে জমায়েত হয়ে যাবে। আচ্ছা, অনুকরণ আর নকলের মধ্যে পার্থক্য কি? অনুকরন তো অন্যে যা করে তা করা। আর নকল? অন্যের কাজ হুবুহু করা। তাহলে তো একই হলো তাই না? করোনাকালে মহল্লার রাস্তায় তিল ধরনের ঠাঁই নেই। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছেন? উত্তর- চৌরাস্তায়। কেন? এই একটু ঘুরে আসি। এই করোনায় এভাবে ঘুরতে যাওয়া কি ঠিক? কেন হাজারো মানুষ যাচ্ছে আমি গেলে অসুবিধা কোথায়? সত্যিই তো। তবে সমাজে ব্যতিক্রম যে নেই, তা কিন্তু নেই। এমনও মানুষ আছেন করোনা কালের পুরো সময়ই ঘরে থাকছেন। আর এজন্য তারা নিরাপদ। আমরা যারা অনুকরন কিংবা নকলে ওস্তাদ তারা হলেন ঝুঁকিপূর্ণ। আমার এক শিক্ষক ক্লাসে গিয়েই বলতেন, আরে তােরা মাছি মারা কেরানি ছাড়া জীবনে কিছুই হতে পারবি না। কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝতাম না আমরা। একদিন স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম স্যার মাছি মারার কেরানিটা কি? উত্তরে স্যার বলেছিলেন বােকা- তা বুঝলি না। শোন তাহলে এক ছাত্রের কাজই ছিল নকল করা। এর, ওর কাছ থেকে নােট চেয়ে এনে তা কপি করা। একদিন এক ছাত্রের কাছ থেকে এরকম নােট নিয়ে এসেছে। তা নিয়ে বসেছে লিখতে। তাে লিখতে লিখতে খাতার এক জায়গায় গিয়ে দেখে কি জানি আঁকা রয়েছে। সেও তার খাতায় হুবহু করে তা এঁকেছে। দুই চারদিন পার হয়ে গেলে খাতা ফেরত না দেয়ায় ছাত্রটি তার খাতা ফেরত নিতে এসেছে। কথায় কথায় সে বললাে, দেখি কি লিখেছিস। দেখতে দেখতে এক জায়গায় গিয়ে চোখ আটকে গেছে ছাত্রের। দেখে সে যখন লিখতে বসেছিল তখন কোন ফাকে তার হাতের নিচে একটা মাছি পড়েছিল। আর সে মাছি হাতের চাপে মরে শেষ। ওই মাছির দাগ পড়েছে খাতার পাশে । আর সেটাই সে হুবহু এঁকেছে তার খাতায় । তার ধারণা এটাও পড়া। কিংবা লেখার একটা অংশ। কোন পড়া না পারলেই স্যার বলতেন— তােরা মাছি মারার কেরানি ছাড়া কিছুই হতে পারবি না। আসলে আমাদের দেশে সবকিছুই হুবহু কপি করা হয়। কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে কপি করতে ব্যস্ত। স্যারের কথাটি মনে পড়ল সেদিন টিভি দেখতে গিয়ে। টিভি অন করতেই ভেসে এলাে পুরুষ কণ্ঠের গান আমার কাংখের কলসি গিয়াছে ভাসি...। শুনে হাসলাম । পুরুষ কি কখনাে কাখে কলসি নেয়? এ প্রশ্নটি বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কাংখে কলসি নিলেই তো আসবে ভাসার প্রশ্ন। তাই না? আসলে এ গানটি মহিলার কণ্ঠেই মানাবে ভাল। গান রচয়িতা হয়তাে এ ধারণা থেকেই গানটি রচনা করেছিলেন। কিন্তু হুবহু কপি করে পুরুষ কষ্ঠে তা শুনতে হচ্ছে টিভি পর্দায়। আরেক অনুষ্ঠানে গান শুনতে গিয়েছি ৪/৫ বন্ধু। সেখানেও এক পুরুষ শিল্পী আসলেন মঞ্চে। গান শুরু করলেন- আমিও রাধার মত ভালবেসে যাব, হয় কিছু পাব, নয় সবই হারাব...। গান শেষ হলাে। সবাই হাততালি দিলেন। ওয়ান মাের, ওয়ান মাের চিৎকার চারদিকে। হাসলাম, গায়ক ও শ্রোতার অবস্থা দেখে। কিছুদিন পর আরেক অনুষ্ঠান। সেখানে শ্রোতার সারিতে বসা। হঠাৎ এক গায়িকা মঞ্চে এলেন- গান শুরু করলেন- আমিও রাধার মত ভালবেসে যাব, হয় কিছু পাব, নয় সবই হারাব...। মনে মনে বললাম, হ্যা এ গান তাে তার কণ্ঠেই মানায়। আমরা আসলে এমন হয়েছি কার কি করা উচিত, কোনটা কার মানায় সেদিকে খেয়াল নেই কারাে। একটা হলেই হলাে। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়েছে। দীর্ঘদিন পর বেয়াইর বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন এক লােক। বেয়াইকে পেয়ে অপর বেয়াই মহাখুশি। নানা কথা। গল্প-গুজব। তখন ছিল কাঠালের সময়। বেয়াইর বাড়িতে আছে কাঁঠাল বাগান। এক সময় বেড়াতে আসা বেয়াইকে প্রস্তাব দিলেন চলুন কাঠাল খাই। সম্মতি পেয়ে খাটের নিচ থেকে কাঠাল আনলেন । কিন্তু কাঠালে ছিল শিক দেয়া। এ শিক দেখে বেয়াই প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বেয়াই এটা কি? আরে জানেন না শিক দিয়েছি। শিক দিলে কাঠাল তাড়াতাড়ি পাকে। কাঁঠাল ভেঙে দু বেয়াই মজা করে খেলেন। একদিন বেড়ানাের পর বেয়াই চলে গেলেন। বলে গেলেন, আগামী তরমুজের মৌসুমে বেড়াতে আসবেন। তখন তরমুজ খাওয়াবাে। এ বেয়াইর এলাকায় তরমুজ হয় খুব বেশি । একদিন দুদিন করে তরমুজের সময় এসেছে। দিন তারিখ ঠিক করে বেয়াই গেলেন অপর বেয়াইর বাড়ি। এদিকে বেয়াই আসবেন। তরমুজ খাওয়াতে হবে। তাই বেয়াই করলেন কি জমির কাচা তরমুজ এনে শিক দিয়ে খাটের নীচে রেখে দিয়েছেন। নির্দিষ্ট দিনে বেয়াই আসার পর তোড়জোড় শুরু হলাে বেয়াইকে তরমুজ খাওয়ার। কিন্তু বেয়াই ঘরে প্রবেশ করেই কিসের গন্ধ পেল। যাই হােক তিনি নীরবে বসে রইলেন।। বেয়াই দা, প্লেট নিয়ে এসে তরমুজ কাটতে বসলেন। বেশ কটি তরমুজ খাটের নিচ থেকে আনলেন। কিন্তু প্রথমটি কাটতে গিয়ে দেখলেন পচে দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে। একে একে সব কটি কাটলেন। দেখা গেল সবকটিই পচা। এবার বেড়াতে আসা বেয়াই প্রশ্ন করলেন- কি হলাে বেয়াই, তরমুজ যে পচে গেল। প্রশ্ন শুনে বেয়াই রেগে গেলেন, বললেন আপনি কাঠালে শিক দিয়েছেন তাড়াতাড়ি পাকার জন্য। আমিও তরমুজে শিক দিয়েছি তাড়াতাড়ি পাকার জন্য। এবার বেয়াই বললেন, কাঁঠালে শিক দিলে পাকে। কিন্তু তরমুজে শিক দিলে পাকে এ কথা আপনাকে কে বললাে?
বুঝলেন বেয়াই যার যেটা মানায় সেটাই করা উচিত। নতুবা তরমুজের মত দশা হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status