এক্সক্লুসিভ

নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণ

চীনকে মোকাবিলায় ফের পশ্চিমাদের দলে ভিড়বে ভারত?

মানবজমিন ডেস্ক

২০ জুন ২০২০, শনিবার, ৮:২৪ পূর্বাহ্ন

বহু বছর ধরে ভারতের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিশ্বে অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে চীন। এশিয়া ছাড়িয়ে চীনের প্রভাব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এশিয়ায় চীনের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনা করা হয় ভারতকেই। চীনকে টক্কর দিতে তাই ভারতের সঙ্গে মিত্রতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় সুযোগ।
চলতি সপ্তাহে ভারত-চীন সীমান্তে দুই পক্ষের সেনাদের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্রহীন এক লড়াই হয়। এতে ভারতের অন্তত ২০ সেনা নিহত হন। আহত হন ৭০ জনের বেশি। চীনা পক্ষেও হতাহত হয়েছে, তবে সে সংখ্যা প্রকাশে অস্বীকৃিত জানিয়েছে বেইজিং। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই অঞ্চল ও পুরো বিশ্বে ভারতের ভূমিকা আরো শক্তিশালী করার ঘোষণা দিয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাত মোদি সরকারের ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পক্ষে কঠোরতম পরীক্ষা হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ভারত কি তাদের স্বার্থ ও শক্তি বৃদ্ধি করতে আসলেই প্রস্তুত ও ইচ্ছুক?
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে রয়েছে চীন। এমতাবস্থায় ভারতীয় কর্মকর্তারা এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছে, যেগুলো পশ্চিমা কূটনীতিকদের ভারতকে মিত্র করার ইচ্ছা বাস্তবে রূপ নেয়ার কাছাকাছি এনেছে বলে মনে করছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার এও মনে করছেন যে, চীনের সঙ্গে এই সংঘাত ভারতকে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আরো দূরে ঠেলে দেবে।
চলতি মাসে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে ভারত। চুক্তি অনুসারে, উভয় দেশ অপর দেশের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে সামরিক নৌ মহড়ায় অস্ট্রেলিয়াকে যোগ দেয়ার আহ্বান জানাতে পারে ভারত- এমন গুঞ্জনও রয়েছে। পুরো অঞ্চলে ভারত ও তার মিত্রদের শক্তি বৃদ্ধির এক প্রয়াস হিসেবেই দেখা হচ্ছে এসব পদক্ষেপকে।
বহুজাতিক সংগঠনগুলোয় ভারতের উত্থান হয়েছে খুব দ্রুত। গত বুধবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কোনো বিরোধিতা  ছাড়াই অস্থায়ী একটি আসনে নির্বাচিত হয়েছে দেশটি। গত মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পর্ষদের চেয়ারের আসনে নির্বাচিত হয়েছে দেশটি। কিন্তু সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এখনো চীনের চেয়ে বহুগুণ পিছিয়ে আছে দেশটি। এই ব্যবধানের কারণে চীনের সঙ্গে লাদাখ সীমান্তে চলমান উত্তেজনাকে যুদ্ধে রুপ না দিতে চাইতে পারেন ভারতীয় নেতারা।
নয়াদিল্লি ভিত্তিক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট সামির সরন চীনের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষের প্রসঙ্গে বলেন, ভারতকে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক- সকল ক্ষমতা মোতায়েন করতে হবে। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সরন বলেন, চীন একটি বিশাল ও প্রভাবশালী দেশ। তাদের বিরুদ্ধে টেকসই আগ্রাসন দেখাতে হলে এ তিন ক্ষমতার প্রয়োগ লাগবেই। দুই দেশের মধ্যে লিবারেলিজম ও গণতন্ত্রের প্রতিরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক মুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে লড়াই চলবে।
সীমান্তে উত্তেজনা নিরসনে অক্লান্তভাবে বৈঠক করে যাচ্ছেন চীনা ও ভারতীয় জেনারেলরা। শুক্রবার ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান, চীন সংঘর্ষের সময় আটক ১০ সেনাকে মুক্ত করে দিয়েছে। যদিও স্যাটেলাইট ছবি ও স্থানীয় গ্রামবাসীদের ভাষ্য থেকে ইঙ্গিত মেলে যে, উভয় দেশই সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন অব্যাহত রেখেছে। শুক্রবার বিকালে দেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে চীন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করার কথা রয়েছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। এ প্রতিবেদন লেখা অবধি বৈঠকটি শুরু হয়নি।
ভারতের সামরিক বাহিনী আকারে বিশ্বের বৃহত্তম বাহিনীগুলোর একটি। তবে বাহিনীটি আধুনিক ও প্রতিযোগিতামূলক নয়। চলতি বছর ভারত তাদের সামরিক খাতে ৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ব্যয়ের ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে চীন ঘোষণা দিয়েছে ১৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ব্যয়ের।
অর্থনৈতিক শক্তি বিবেচনায়, ভারত তাদের বিশাল বাজার ব্যবহার করে চীনের উপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করতে ইচ্ছুক। গত এপ্রিলে দেশটি চীনা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ বিষয়ক একটি আইন পাস করে। আইনটিতে, চীনা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে সরকারি অনুমোদন আবশ্যক করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স বৃহসপতিবার জানিয়েছে, চীনা পণ্যের উপর শুল্ক বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে মোদি সরকার।
ভারতের ক্রয় ক্ষমতা চীনের জন্য অসুবিধাজনক হলেও, চীনের ব্যয় ও ঋণ দেয়ার ক্ষমতার কাছাকাছিও নেই ভারত। তবে কূটনৈতিক দিক দিয়ে চীনকে পরাহত করার চেষ্টা করতে পারে ভারত। করোনাভাইরাস মহামারি সে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। মহামারির শুরুর দিক থেকেই এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে ভারতীয় কর্মকর্তারা। একইসঙ্গে এই মহামারি ভারতের বিশাল ফার্মাসিউটিক্যাল  শিল্পকে কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতে নিযুক্ত এক পশ্চিমা কূটনীতিকের ভাষ্যমতে, চীনকে মোকাবিলায় মজবুত সম্পর্ক গড়তে ইচ্ছুক ভারত। তিনি বলেন, করোনা পরবর্তী বিশ্বে চীন ইস্যুতে কথা বলতে সবাই আগের চেয়ে বেশি ইচ্ছুক। বিশ্বে চীনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা এখন আগের চেয়ে সহজ হয়ে উঠেছে। আমরা সবাই বোঝার চেষ্টা করছি নতুন ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ কোনটা। ভারত একটি পথের প্রতিনিধিত্ব করে, চীন আরেকটি পথের।
তবে এই মুহুর্তে ভারতের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় সীমান্তে চীনের সঙ্গে উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পাওয়া। গত সপ্তাহে দুই পক্ষের মধ্যে লড়াইয়ের পর থেকে সেখানে সামরিক শক্তি মজুদ করছে চীন। লড়াইয়ের দুই দিন পর গত বুধবার ঘটনাটি নিয়ে প্রথমবার মুখ খোলেন মোদি। তাতে তিনি বলেন, ভারত শান্তি চায়, তবে উস্কানি দেয়া হলে ভারত যথোপযুক্ত জবাব দিতে সক্ষম।
সীমান্তে আগ্রাসন চীনের শক্তি প্রদর্শনের একমাত্র ঘটনা নয়। করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে বেশকিছু ইস্যুতে অবস্থান শক্ত করেছে চীন। এর মধ্যে হংকংয়ের উপর প্রভাব বৃদ্ধিও রয়েছে। কিন্তু ভারতের জন্য চীন আরো বড় আতঙ্ক সৃষ্টিকারী শক্তি। ইতিমধ্যে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো মিত্র পাল্টে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। অন্যকথায় ভারতের দোড়গোড়ায় হাজির চীন। সমপ্রতি নেপাল সরকার একটি বিশেষ অঞ্চলকে নিজের দাবি করেছে, যে অঞ্চলটি ভারত নিজের মনে করে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুসারে, নেপাল ওই পদক্ষেপ নিয়েছে চীনের পক্ষে। এছাড়া, ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানে ব্যাপক  বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। সেখানে দেশটি বিশাল সব অবকাঠামো প্রকল্প তৈরি করছে।
মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কায়ও চীনের প্রভাব অনস্বীকার্য। চীনের কাছ থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় শ্রীলঙ্কার একটি বন্দর বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে চীন। ভারতের আশঙ্কা বন্দরটিতে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করতে পারে চীন। তবে শ্রীলংকা এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ব্রুকিং ইন্সটিটিউশনের ফেলো কন্সটান্টিনো জাভিয়ের বলেন, অঞ্চলটিতে এক সময় রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ভারতের। সেখান থেকে ভারত বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতায় নেমে এসেছে। এ প্রতিযোগিতায় নিশ্চিতভাবেই চীন প্রভাবশালী।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রামেপর সঙ্গে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদি একাধিকবার বৈঠক করেছেন। তবে দুই দেশের মধ্যকার সমপর্ক কখনো অত্যন্ত ভালো আবার কখনো এর বিপরীত অবস্থায় ছিল। কিন্তু কিছু ভারতীয় কর্মকর্তার মতে, চীনের বর্ধমান প্রভাবের মুখে পশ্চিমের দিকে তাকানো ছাড়া ভারতের কাছে খুব একটা পথ খোলা নেই।
গত মঙ্গলবার প্রকাশিত এক মতামত কলামে ভারতের বিদায়ী পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে লিখেন, বর্তমানে বেইজিংয়ের আগ্রাসন অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। দেশগুলোকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যেকোনো একপক্ষকে বেছে নিতে হবে। তিনি লিখেন, করোনা পরবর্তী বিশ্বে উভয় পক্ষের সঙ্গে থাকা সম্ভব নাও হতে পারে।

(মূল প্রতিবেদনটি লিখেছেন, নিউ ইয়র্ক টাইমসের দিল্লি-ভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রতিনিধি মারিয়া আবি হাবিব।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status