মত-মতান্তর

প্রসঙ্গ আল্লামা শফীর উত্তরসুরী নির্বাচন এবং...

সৈয়দ মবনু

১৭ জুন ২০২০, বুধবার, ৪:৩০ পূর্বাহ্ন

বনের বাঘে খায় না মনের বাঘে খায়। মনের বাঘের ভয়ে কোন সংবাদ পেলেই লাফ দিয়ে ওঠে একদল মানুষ। হাটাজারী মাদরাসার বিষয়টি এমনই। মাওলানা আনাস মাদানী কি কোথাও বলেছেন যে তিনি মুহতামিম হতে চান কিংবা হতে চান না। অনেকে-ই তো অনেক কথা বলেন, তিনি কি কোন কথা বলেছেন? কেন বলেন না? কারণ আমার ধারণা, তিনি জানেন এই সব তার বিষয় নয়। জ্ঞানীরা যে কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকে শ্রেয় মনে করেন। ইহতেমাম-মুহতামিম এসব বিষয় শুরার কাজ, শুরা সিদ্ধান্ত নিবে কাকে কি করবে।
হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনটা শুরু হলো কীভাবে? এর পেছনে মূল প্রেরণাদাতা কে? এ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। অনেক কথা চাউরও আছে। সব বলতে চাই না। আজকের লেখায় তা প্রাসঙ্গিকও নয়। তবে কিছু বিষয় বলতে হচ্ছে। শাহবাগ আন্দোলন নিছক একটা ঘটনা বা আন্দোলন ছিল না। এতে বাম-ডান, দেশি বিদেশে অনেকের ফায়দা ছিল। সরকারের ভেতর থেকেও ইন্ধন ছিল। জামায়াত বিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নের হিসাব-কিতাব তো ছিলই। শাহবাগের আন্দোলনকে সরকার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও এটি ঘরের এবং বাইরের ইন্ধন মুক্ত ছিল না। শাহবাগীদের মাঠ থেকে সরানো যাচ্ছিলো না। দেশী মিডিয়াগুলোও শাহবাগীদের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলো। অবশেষে প্রয়োজন হলো হেফাজতের। সরকার হেফজতিদেরকে সুযোগ দিলো মাঠে আসার এবং তারা আসলেনও। ফলে শাহবাগের বিদায় হলো। হেফাজতকে মাঠে আনতে শুধু সরকার নয়, কাজ করেছে জামায়াত-বিএনপি জোটও। তাদের টার্গেট ছিলো সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করা। একটি পত্রিকার সম্পাদক, বুদ্ধিজীবি, মাওলানা, মুফতি অনেকেই হেফাজতকে মাঠে নামাতে নেপথ্যে কাজ করেছেন। নানা জনের নানা মত, হিসাব মিলানো মুশকিল। সরকার, বিএনপি, জামায়াত যে যার মতো করে ক্রেডিট নিতে চেয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটা সরকার না বিএনপি-জামায়াত কার সৃষ্টি? নাকী সরকার ও জামায়াতের যৌথ প্রযোজনা? সেই সব প্রশ্নের জবাব আজও খোঁজা হচ্ছে। সত্য-মিথ্যা আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন।
সে যাই হোক। আর যেভাবেই হোক, একটা আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো। এই আন্দোলন মাঠকে গরম করে দিয়েছিলো। বিশাল আন্দোলন ছিল কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা চেইন অফ কামান্ডের প্রচণ্ড অভাব ছিল। না হয় শাপলাচত্বরের ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো। জনমনে প্রশ্নের অন্ত নেই। হেফাজতের প্রধান নেতা থাকেন রাজধানীর বাইরে, চট্টগ্রামে। ঢাকায় এসে তাকে অবস্থান নিতে অন্যের ওপর ভর করতে হয়। যার ওপর ভর বা ভরসা করেন ঢাকার সেই নেতা মানসিক বা কৌশলগতভাবে অন্যের কাছে জিম্মি। এই যখন অবস্থা তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় চলে এলো বিএনপি-জামায়াত। আরও স্পষ্ট করে বললে গুটিটা নাড়লো জামায়াত। কারণ, তারা জানে বিপ্লবের পূর্ব শর্ত কি? তারা তাদের শক্তিকে রিজার্ভ রেখে কওমীর শক্তিকে মাঠে উত্তেজিত করতে থাকলো। আর হেফাজতের কিছু উইপোঁকা, জনস্রোত দেখে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিল ক্ষমতায় যাওয়ার। হেফাজত স্বয়ংসম্পূর্ণ কোন দল না হওয়ায় এই দলের উপর এই উইপোঁকাদের বেশ প্রভাব বরাবরই। হেফাজতের বটবৃক্ষ আল্লামা আহমদ শফী হলেও উইপোঁকারা প্রায় সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। তারা এটাও জানে, আল্লামাকে মাঠে নামাতে না পারলে সেখানে তারা দাঁড়াতেই পারবে না। ফলে বয়োবৃদ্ধ আল্লামা আহমদ শফীকে লাগবেই। সঙ্গে তারা সুপরিকল্পিতভাবে নিলো মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী এবং তাঁর মামা মাওলানা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীকে। ছেলে হিসেবে তো মাওলানা আনাস মাদানীকে পাশে থাকতেই হয়।

হেফাজতের অপরিকল্পিত নেতৃত্ব বা আন্দোলন আটকে যায় বিভিন্ন গ্রুপের বিভক্তিতে। সন্তান হিসাবে মাওলানা আনাস মাদানী হয়ে পড়েন একা। তার নিজস্ব কোন গ্রুপ না থাকায় বাবার কিছু ছাত্র আর মুরিদের নিয়ে (বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে) পথ চলতে শুরু করেন তিনি। তখন তার প্রধানতঃ দু'টি কাজ। এক. সন্তান হিসাবে আল্লামার স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা, দ্বিতীয়ত: তিনি যেনো এমন কিছু না বলেন যা দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করে। মাওলানা এ পর্যন্ত তার কাজদ্বয় ভালভাবেই সামলেছেন, যদিও বাজারে এরইমধ্যে অনেক কিছু রটে গেছে।
যাক, হাটাজারীতে নেতৃত্ব নিয়ে সংঘাত চলছে। যাদের জানা আছে তারা জানেন, হাটাজারিতে শুরার অবস্থান কতটি শক্ত বা পোক্ত। যখন খতিব আল্লামা উবায়দুল হক বেঁচে ছিলেন তখন হাটাজারীর শুরায় অনেককে জবাবদিহী করতে হয়েছে, এরপর ছাড়া পেয়েছেন। খতিব উবায়দুল হক সাহেবের সঙ্গে ইংল্যান্ডে একবার আমার হাটাজারীর শুরার বিষয়ে কথা বলার এবং শুনার সূযোগ হয়েছিল। বর্তমানেও শুরা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আমার জানা মতে বর্তমানে হাটাজারীর শুরাতে আছেন ঢাকার জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসার পরিচালক ও হাইয়াতুল উলয়ার কো-চেয়ারম্যান আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস, ফরিদাবাদ মাদরাসার নায়েবে মুহতামিম ও বেফাক যুগ্ম-মহাসচিব মুফতি নুরুল আমিন, ঢাকার খিলগাঁও মাখজানুল উলুম মাদ্রাসার মাওলানা নুরুল ইসলাম চট্টগ্রামী, হাটহাজারীর আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া হামিউচ্ছুন্নাহ মেখল মাদরাসার পরিচালক মাওলানা নোমান ফয়জী, ফটিকছড়ির জামিয়া উবাইদিয়া নানুপুর মাদরাসার পরিচালক মাওলানা সালাহউদ্দিন নানুপুরী, হাটহাজারীর ফতেপুর মাদরাসার পরিচালক মাওলানা মাহমুদুল হাসান ফতেপুরী সহ বাংলাদেশের বড় কিছু মাদরাসার মুহতামিম। তারা সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিবেন বলেই কওমীপন্থিরা তথা জাতি অাশা করে। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে কিছু লোক মাওলানা আনাসকে কেনানের সঙ্গে তুলনা দিচ্ছেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক। মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে নিয়েও কথা উঠেছে। তিনি না-কী কারাবন্দী মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীপুত্রের সঙ্গে গোপন মিটিং করেছেন। তাদের একটি ছবিও সোস্যাল মিডিয়ায় ঘুরপাকা খাচ্ছে। মাওলানা বাবুনগরীর খাদেম- ইন'আমুল হাসান ফারুকী অবশ্য মিটিংয়ের তত্ত্ব নাকচ করেছেন। তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বলেছেন, সেটা মিটিং নয় বরং একটি ইফতারের আয়োজন ছিল। আয়োজক ছিলেন তৃতীয়পক্ষ। মেহমানদের উপস্থিতি কাকতালীয়। ইফতারের আগে আচমকা শামীম সাঈদী উপস্থিত হন। সেখানে বাবুনগরী হুজুরেকে তিনি নিজের পরিচয় দেন। এতে অনুমেয় আগে থেকে তাদের পরিচয় ছিল না। বাকীটা আল্লাহ মা'লুম। কওমিপন্থিদের মৌলিক সমস্যা হচ্ছে তারা যাচাই করেন কম, বিশ্বাস করেন বেশি। না বুঝে অনেকে প্রচার শুরু করে দেন। এতে পারিবারিক এবং মানসিক প্রভাব রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী এসব ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা যেহেতু একটি কর্পোরেট সংগঠন, তাই তারা ব্যবসায়িক স্বার্থে যেকোন কাজ খুব দক্ষতার সঙ্গে আদায় করতে পারে।
শেষকথা, আল্লামা বাবুনগরী কিংবা মাওলানা আনাস মাদানী দু’জনের কারও নিজস্ব এডেন্ডা আছে বলে মনে করি না। তাদের মতান্তর থাকতে পারে, কিন্তু বিরোধ নেই। আমার বিশ্বাস তৃতীয়পক্ষের উপস্থিতিহীন তাদের মধ্য কথা হলে সেই ছোটোখাটো মতপার্থক্যও থাকবে না। জরুরি হচ্ছে খোলা মনে তাদের একান্ত অলোচনা বা ডায়ালগ। সেই সূযোগ সৃষ্টি করে দেয়া প্রয়োজন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ শুরা তো আছেই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status