বাংলারজমিন

প্রতিবন্ধি জাহানারার প্রতিভার স্বাক্ষর

ঘাটাইল ( টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি

২ জুন ২০২০, মঙ্গলবার, ২:৫১ পূর্বাহ্ন

প্রতিবন্ধকতা কখনোই সাফল্যকে আটকে দিতে পারে না। প্রতিবন্ধীরা বুঝা নয়,সঠিক যত্ন ও পরিচর্যা পেলে ওরাও বদলে দিতে পারে সমাজ, সংসার ও পরিবার। সমাজের মানুষের শুভ দৃষ্টি ও রাষ্ট্রের সামান্য সহযোগিতা পেলে অন্যদশ জন সুস্হ্য স্বাভাবিক মানুষের মতই দেশ ও শিক্ষিত জাতী গঠনে ভুমিকা রাখতে পারে সম পরিমান। জাহানারা এমনি একটি উদাহারন।টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার পৌরসভাস্হ ৬নং ওয়ার্ডের পশ্চিম পাড়া গ্রামের বাসিন্দা।বাবার নাম মোঃ জাহাঙ্গীর আলম।দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্য জাহানারা সকলের বড়।জন্মগত ভাবেই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী জাহানারা। অক্ষমতাকে জয় করে সে এবার এসএসসি পরীক্ষায় পেয়েছে জিপিএ ফাইভ। এমনকি তার বাবাও প্রতিবন্ধী। তাই প্রতিবন্ধীর বাবার প্রতিবন্ধী মেয়ের এ সাফল্য এলাকার মানুষ,প্রতিবেশি ও তার স্কুলের শিক্ষকদের মাঝে ব্যাপক আনন্দের জোয়ার বইছে।গোটা উপজেলার মানুষের ভালবাসায় প্রশংসার জোয়ারে ভাষছে জাহানারা। অদম্য প্রতিভার অধিকারী জাহানারা প্রতিবন্ধী হলেও জীবন যুদ্ধে থেমে নেই তার অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা। ২০১৮ সালে ঘাটাইল এস,ই পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ-৩.৫০ পায় জাহানারা। পরিবার ও বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, এসএসসি-তেও জিপিএ-৫ পেতে মরিয়া হয়ে উঠে জাহানারা।নিয়মিত স্কুলে আসা,শিক্ষকদের আদেশ নিষেধ মেনে চলা ও মনযোগ ছিল চোখে পড়ার মত।এক দিন বড় হয়ে মানুষের মত মানুষ হয়ে অসহায় দরিদ্র পিতা মাতার অভাব লাঘব করবে এটাই জাহানার ইচ্ছে ও স্বপ্ন ছিল । তার এ স্বপ্নপূরণে কোনও বাধা থামাতে পারেনি। অসম্ভবকে সম্ভব করে মেধার স্বাক্ষর রেখে এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। অত্যান্ত শান্ত ও মেধাবী জাহানার এ বছর ঘাটাইল এসই পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করে কৃতিত্বের সাথে জিপিএ-৫ পেয়ে সবাইকে রিতিমত চমকে দেয়।অনেকটা অ- প্রত্যাশিত এই রেজাল্ট পরিবার ও সমাজের মানুষেরর চোখ খুলে দিয়েছেন বলে ধারনা করছেন অনেকেই।অভাবের সংসারে এমন রত্ন নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে জাহাঙ্গীর আলম ও মা বিনা বেগমকে।যেখানে বাবা বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী,এক মাত্র ভাই বিজয় ও ছোট বোন তানিয়া সেও বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী।
জাহানারার মা বিনা বেগম বলেন, জাহানার জিপিএ-৫ পেয়েছে ঠিকই। আমরা এতে সবাই খুশি। বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীকতা নিয়ে মেয়েটি সংগ্রাম করে এতদূর এসেছে। তবে মেয়ের রেজাল্টে খুশি হলেও দুশ্চিন্তার অন্ত নেই মা বীনার । কারণ মেয়ের স্বপ্নপূরণ করতে হলে ওকে কলেজে ভর্তি করাতে হবে।টাকা নেই,মাথা গোজার ঠাই নেই। দু- বেলা দু- মুঠো ভাতই যেখানে যোগাড় করতে পারিনা সেখানে মেয়ের স্বপ্ন পুরন করা কিছুতেই সম্ভব নয়।তাছাড়া গ্রাম পর্যায়ে তেমন ভালো কলেজ বা লেখাপড়ার সুযোগ কম।আমার ৩ টি সন্তান ও স্বামী প্রতিবন্ধী।এদের নিয়ে জীবন পরিচালনা করা কত যে কষ্ঠের সেটা বলে বুঝানো সম্ভব নয়।তিনি আরো বলেন, একটি ভালো কলেজে দিতে গেলে মেয়ের সাথে কাউকে যেমন রাখতে হবে তেমনি অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার।আমাদের মত মানুষ গুলোর পক্ষে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।তাছাড়া যেহেতু সে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী কথা বলতে পারে না তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক কাউকে না কাউকে থাকতে হয়। তাই কীভাবে মেয়েকে লেখাপড়া করাবেন এনিয়ে চিন্তিত তিনি। তবে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও মেয়ের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করবেন বলে জানান মা বীনা বেগম।কষ্ঠের কথা গুলো বলার সময় বিনা বেগমের দু- চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ছিল আর কান্না জড়িত কন্ঠে বলছিলেন জন্মগত ভাবেই জাহানারা বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। সামাজিক অনেক প্রতিকূলতাও মোকাবেলা করতে হয় তাদের। অভাবের সংসার। তারপরও বেড়ে ওঠা শিশুটির চাহনি, মেধা মা বিনার মনে সাহস যোগায়। মায়ের কাছে প্রথমে অক্ষর জ্ঞান নিতে থাকে জাহানারা। বাসা থেকে দূরবর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা সহজ ছিল না। প্রথমে ঘাটাইল প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করা হয়। মা বিনা বেগমই তাকে স্কুলে আনা নেয়ার কাজ করতেন। প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ভালো রেজাল্ট করে উত্তির্ন হয় জাহানারা। লেখাপড়ার ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে একই স্কুল থেকে পিএসসিতে ২০১৮ সালে একই বিদ্যালয় থেকে জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে জিপিএ-৩.৫০ পায় জাহানারা।
জাহানারার বাবা জাহাঙ্গীর আলম বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী হয়েও দিনমুজুরির কাজ করেন। ফলে দিনমুজুরির কাজ করে যা উপার্জন হয় তাই দিয়ে সংসার চলে তাদের।এ অবস্থায় কষ্ট করে মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিবন্ধী বাবা।
বিনা বেগম জানান, মেয়ের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু শারীরিকভাবে স্বাভাবিক না হওয়ায় মেয়েকে বোঝানো হয়, এটা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। মেডিকেলে পড়তে গেলে ব্যবহারিক অনেক কাজ থাকে। তাই জাহানার এখন লেখাপড়া শেষ করে বিসিএস ক্যাডার হতে আগ্রহী। এ ব্যাপারে ঘাটাইল এসই পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বুলবুলি বেগম মানবজমিনকে বলেন, প্রতিবন্ধী জাহানারা স্কুলে থাকাকালী আমরা তাকে অনেক সহযোগীতা করেছি। আমি জাহানারার মতো প্রতিবন্ধীসহ সকল প্রতিবন্ধীদের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি। জাহানারার সাফল্য তার কথা শ্রদ্ধায় ভরে স্মরণ করি।ওর মত শান্ত মেয়ে আমার স্কুলে আর দ্বিতীয়টি নেই।আমি ওর শিক্ষক হয়ে সমাজের বৃত্তবান ও সরকারের কাছে দাবি জানাই এ সব অসহায় ও প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়ালে এরাই এক দিন সম্পদে পরিনত হবে। এদেরকে সুযোগ দিন, পাশে এসে দাঁড়ান।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status