বাংলারজমিন

৪ ভাইকে কেড়ে নিলো আর্সেনিক

শাহরাস্তি (চাঁদপুর) প্রতিনিধি

২ জুন ২০২০, মঙ্গলবার, ৭:১৩ পূর্বাহ্ন

শাহরাস্তিতে একই পরিবারের ৫ সহোদরের ৪ জনের আর্সেনিক আক্রান্তেই মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে শুধু ওই পরিবারটি নয় সমগ্র উপজেলার ৩ লাখ অধিবাসীই আর্সেনিকের ঝুঁকিতে ডুবে রয়েছে। এ করুণ বাস্তবতা তাড়া করছে এই জনপদের ১০টি ইউপি ও একমাত্র পৌরসভার নাগরিকদের মাঝে। আজ থেকে ২৪ বছর পূর্বে দেশের সর্বোচ্চ  আর্সেনিক প্রবন অঞ্চল হিসেবে এ জনপদকে চিহ্নিত করেছিল। ওই সময়ে অষ্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষানবীশ কর্মীরা ছুটে আসে এখানে, তা সত্ত্বেও জনসংখ্যা অনুপাতে বিশুদ্ধ খাবার পানির সরবারহ ব্যবস্থা আজও সেভাবে গড়ে উঠেনি। এতে ভুক্তভোগীরা ওই আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে কেউ জীবন, কেউ সংসার হারাচ্ছেন। পার্শ্ববর্তী কচুয়া উপজেলার জনৈক গৃহবধূ নাহিদা (৩৬) ইউনিডো এনজিওতে আর্সেনিক  চিকিৎসা করিয়েও সংসার টিকাতে পারেননি। বর্তমানে শাহরাস্তির গণমাধ্যামকর্মী হেলাল উদ্দিন (৫৩) আর্সেনিক  আক্রান্ত হয়ে দু’টি কিডনি বিকল হওয়ার পথে। অনেকে আর্সেনিকযুক্ত পানি দীর্ঘ মেয়াদে পান করে, শরীরে নানা অসুখের বাসা বাঁধিয়ে চরম অসুস্থতা নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
গত মাসের ২৫শে মে উপজেলার পৌর শহরের ৭নং ওয়ার্ডের নিজমেহার তালুকদার বাড়ির কৃষক মমতাজ উদ্দিনের চতুর্থ পুত্র আর্সেনিকে আক্রান্ত শেষে ক্যানসারে মারা যায়। ওই রোগের  আগ্রাসনে পরিবারটির  পাঁচ ভাইয়ের চারজনকে অকালে জীবন দিয়ে মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হতে হয়েছে।
ওই পরিবারের বেঁচে থাকা একমাত্র ছোট ভাই মো. মফিজুর রহমান জানান, ১৯৭৬ সালে তাদের বাড়ির পাশে মসজিদের সন্নিকটে স্থাপিত একটি টিউবওয়েলের পানি পান করছিলো ওই পরিবার। পরে ১৯৮৬ সালে তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়লে নিজ বাড়ির আঙিনায় আরো একটি টিউবওয়েল স্থাপন করে পানি পান করে। ওই পরিবারের প্রথম সন্তান (বড় ভাই) রুহুল আমিন মানিক (৫৫) শাহরাস্তি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করতেন। ১৯৯১ সালে প্রথম একটি এনজিও’র মাধ্যমে শনাক্ত হয় তিনি আর্সেনিক আক্রান্ত। পরে ২০০৪ সালে ঢাকার আইসিডিডিআর’বিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হন, আর্সেনিক বিষক্রিয়া তার শরীরের কতটা ক্ষতি করেছে। ওই বিষক্রিয়া ক্যানসারে রূপ নিয়ে ২০০৭ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুপথের যাত্রী হন। তৃতীয় ভাই মোঃ মজিবুর রহমান (৪৮) একই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির চাকরি করতেন। একইভাবে তাকেও আর্সেনিকের অক্টোপাস গিলে ফেলে। এবং তার শরীরটাকে ক্যানসারে জিম্মি করে ফেলে। ২০১৭ সালের ১৯শে অক্টোবর  তিনি মৃত্যুর নিকট হেরে যান।
দ্বিতীয় ভাই নুরুল আমিন (৫৫) বাড়ির পাশে পৌর শহরের তালতলা নামক স্থানে একটি চা স্টল দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ওই সময় চোখের সামনে দুই ভাইয়ের চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখে নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে নড়েচড়ে বসেন। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হন, তিনি একই রোগে আক্রান্ত। পরে ঢাকার মহাখালীতে অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে শনাক্ত হয় শরীরটাকে ক্যানসার দখলে নিয়েছে। ২০১৮ সালের ১০ই এপ্রিল তার জীবন প্রদীপটিও নিভে যায়। এবার চতুর্থ ভাই হাবিবুর রহমান। তার ৩ ভাইয়ের অকালে চলে যাওয়ায় তিনি স্তব্ধ হয়ে যান। পরে তিনি চেষ্টা করেন, ওই সহোদরদের পরিবার-পরিজনকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে জীবন ও জীবিকার একটু আলো দেখাতে । চলছিল বেশ, কিছুটা সফলতা দেখতে পায় পরিবারগুলো। কিন্তু শেষ পরিণতি সেই একই অবস্থা। ওই পরিবারের চতুর্থ ছেলে হাবিবুর রহমান ২০১৯ সালে কানের ব্যথা নিয়ে ঢাকা মগবাজারের তাক্‌ওয়া স্পেশালাইজ্‌ড হাসপাতালে  (ঢামেকের) নাক-কান-গলা বিভাগের প্রধান ডাক্তার ইউসুফ ফকিরের নিকট চিকিৎসা নিতে ছুটে যান। তখনই তার শনাক্ত হয় টিউমার, সেটা অপসারণ করেন তিনি। পরে ঢাকা মহাখালী ক্যানসার হাসপাতালে ত্রিশটি থেরাপি নিয়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধটা চালিয়ে যান। পরিবারের হিস্টরি মোতাবেক শনাক্ত হয় তিনিও আর্সেনিকের সেঁকো বিষ-এর থাবায় মরণব্যাধি ক্যানসার আক্রান্ত হয়েছেন। গত ২৫শে মে ভোরে তিনি একটি শ্রবণ প্রতিবন্ধী ছেলে ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়ে রেখে মারা যান।
এদিকে ওই পরিবারের পঞ্চম ভাই মফিজুল ইসলাম জীবিকার প্রয়োজনে কিছুদিন পূর্বে মালদ্বীপ থেকে প্রবাস জীবন-যাপন করে করোণার পূর্বে দেশে ফিরে আসেন। তিনিও আর্সেনিকের বিষে আক্রান্ত। এবার জীবনযুদ্ধে মফিজের বেঁচে থাকার লড়াই ।
এদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শিরিন আক্তার পরিবারটির কষ্টের কথা অবহিত হয়ে উপজেলা প্রশাসন থেকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
 উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডাঃ অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তী (আরএমও) জানান, এ রোগে ২০১২ সালের পর থেকে সরকারিভাবে কোনো ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে না বলে জানান। আমরা রোগীদের ব্যবস্থাপত্র লিখে দিচ্ছি। তারা বাহির থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ৫হাজার ৬শ’ ৫৫ জন রোগীর পর আরো  কিছু রোগী শনাক্তকরণের হিসাব পাওয়া যাবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status