শেষের পাতা

কান্না থামছে না মাদারীপুরের ১১ যুবকের পরিবারে

অলিউল আহসান কাজল, মাদারীপুর ও মহিবুল আহসান লিমন, র

৩১ মে ২০২০, রবিবার, ৭:৩৫ পূর্বাহ্ন

স্বপ্ন পূরণের আশায় স্থানীয় দালালদের আশ্বাসে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিল মাদারীপুরের বেশকিছু যুবক। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি। তাদের লিবিয়া অবস্থানরত দালালরা জিম্মি করে দফায় দফায় টাকা দাবি করেন। এক পর্যায়ে দালালদের দাবিকৃত টাকা না দিতে পারায় গুলি করে হত্যা করে মাদারীপুরের ১১ জনকে। গুলিতে আহত হয় আরো ৩ জন। নিহত ও আহত পরিবারের দাবি, মৃতদেহ ফিরিয়ে দেয়ার। আর দোষীদের শাস্তির দাবি করেছেন ভুক্তভোগী পরিবার। প্রশাসনও দালালদের শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা করছেন বলে দাবি করছেন।
নিখোঁজের দু’দিন আগে নির্মম নির্যাতনের কথা জানিয়েছিলেন সদর উপজেলার কুনিয়ার মনির আকন। তার কথা শুনে পরিবারও দালালদের দাবি করা ৭ লাখ টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। কিন্তু তার আগেই লিবিয়ার মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে নিখোঁজ হয় মনির আকন। বিষয়টি জানাজানি হলে পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। পরিবারের দাবি, স্থানীয় দালাল নূর হোসেনের মাধ্যমে পাঁচ মাস আগে ইতালি যাওয়ার কথা বলে সাড়ে চার লাখ টাকা নিয়েছিল। এখন মৃত্যুর সংবাদে গা-ঢাকা দিয়েছে নুর হোসেন। তবে তার ভাই লিবিয়া থেকে মোবাইলে বিষয়টি স্বীকার করেন।
লিবিয়ায় গুলি করে ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে মাদারীপুর জেলার ১১ যুবক রয়েছে।  লিবিয়ায় হতাহতের ঘটনার খবর শুনে শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে বাংলাদেশি দালাল রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের মজিদ শেখের ছেলে জুলহাস শেখের বাড়িতে হামলা করে নিখোঁজ যুবকদের অভিভাবক ও এলাকাবাসী। এ খবর পেয়ে রাজৈর থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশের কাছে দালাল জুলহাস শেখ নিজেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে পরিচয় দেয়। এ সময় পুলিশ জুলহাসকে নিয়ে মাদারীপুর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করে। নিহতরা হলেন- সদর উপজেলার জাকির হোসেন, জুয়েল হোসেন, ফিরোজ ও শামীম, রাজৈর উপজেলার বিদ্যানন্দী গ্রামের জুয়েল হাওলাদার, একই গ্রামের মানিক হাওলাদার (২৮), টেকেরহাট এলাকার আসাদুল, মনির হোসেন ও আয়নাল মোল্লা, ইশিবপুর এলাকার সজীব ও শাহীন। আহতরা হলেন, সদরের ফিরোজ বেপারী, ইশিবপুরের সম্রাট খালাসী ও কদমবাড়ীর মো. আলী।
অনেক পরিবারের লোকজন জানেও না তাদের সন্তান আদৌ বেঁচে আছে কিনা। অনেকে আবার হত্যাকাণ্ডের খবর শুনেছেন। নিখোঁজ যুবকদের সঠিক পরিচয় না পাওয়ায় তাদের পরিবারকে খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
হোসেনপুর ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা নিখোঁজ জুয়েল হাওলাদারের পিতা রাজ্জাক হাওলাদার ও মা রহিমা বেগম বলেন, “আমাদের ছেলেসহ রাজৈরের বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকজনকে দালাল চক্র লিবিয়ায় নেয়ার কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪/৫ লাখ টাকা চুক্তি করে ৩/৪ মাস আগে। তারপর লিবিয়ার ত্রিপোলি না নিয়ে বেনগাজী নামে এক গ্রামে আটকে রেখে নির্যাতন করে। এরপর ভয়েজ রেকর্ডে নির্যাতনের শব্দ পাঠিয়ে আরো ১০ লাখ টাকা দাবি করে। আমরা হোসেনপুরে জুলহাস শেখ নামের ওই দালালের বাড়িতে গিয়ে ১০ লাখ টাকা দিয়ে আসি। মানুষের কাছে শুনতে পাচ্ছি লিবিয়ায় গুলি করে অনেক বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের ছেলে বেঁচে আছে কিনা তাও জানতে পারছি না। এখন পর্যন্ত ছেলের কোনো খোঁজ পাইনি।”
একই গ্রামের নিখোঁজ মানিক হাওলাদারের পিতা শাহ আলম হাওলাদার বলেন, “আমার ছেলে মানিককে লিবিয়ায় নেয়ার কথা বলে দালাল জুলহাস আমার কাছ থেকে প্রথমে ৪ লাখ টাকা নিয়েছে। পরে ছেলেকে বেনগাজী আটকে রেখে ভয়েজ রেকর্ডের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা দাবি করে। আমি আমার ছেলেকে আনতে জুলহাসের বাড়ি গিয়ে টাকা দিয়ে আসি। এখনো আমার ছেলের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না।”
নিখোঁজ আসাদুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় অসুস্থ বাবা বিছানায় সন্তানের জন্য কাতরাচ্ছে, মা শুভ তারা কান্না করতে করতে বলছে, আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দাও আমি আর কিছু চাই না।  আসাদুলের বোন কান্না করতে করতে বলছে, আমার ভাইর সঙ্গে কথা হয় নাই। তবে আমাকে একটি ভয়েস পাঠিয়েছিল ১৬ই মে ইমোতে। এরপর থেকে আর তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি।
রাজৈর থানার ওসি শওকত জাহান বলেন, “লিবিয়ায় লোক নেয়া দালাল রাজৈরের জুলহাস শেখের বাড়িতে এলাকাবাসী হামলা করে এমন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা ওই বাড়িতে গেলে জুলহাস বলে আমার করোনা হয়েছে। করোনার কথা শুনে আমরা জুলহাস শেখকে মাদারীপুর সদর হসাপাতালের আইসোলেশনে ভর্তি করি।”
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, “লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার কথা শুনেছি। যাদের মধ্যে মাদারীপুরের লোকজনই  বেশি। মাদারীপুরের কতজন মারা গেছে- এ তথ্য আমি এখন পর্যন্ত প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে পাইনি। মন্ত্রণালয়ে আমি যোগাযোগ করেছি। তারা বলেছে আমাকে মাদারীপুরের কতজন মারা গেছে সে তথ্য  দেবে। লাশ দ্রুত কীভাবে দেশে আনা যায় আমি সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি।”
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status