অনলাইন

ট্রাম্প বনাম শি-

ওষুধ না ভ্যাকসিন, কে আগে দেবে?

মানবজমিন ডেস্ক

১৯ মে ২০২০, মঙ্গলবার, ৯:১৪ পূর্বাহ্ন

চীন বিশ্বকে করোনা দিয়েছে। একে হারাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দৌড়ে আছে। কে আগে  ভ্যাকসিন ও ওষুধ দেবে? ১৯ মে এএফপি সর্বশেষ খবর দিয়েছে, নতুন ওষুধের। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দাবি করেছেন, তাদের ওষুধ করোনাকে বলবে, হল্ট। এটা খেলে আক্রান্ত ব্যক্তির দ্রুত করোনা সেরে যাবে। আবার সুস্থ কেউ আগাম খেলে তার মধ্যে ইমিউনিটি গড়ে উঠবে। অবশ্য এরকম খবর প্রায়ই ছাপা হচ্ছে। কবে কখন আসবে, সেটাই শুধু জানা যায় না।   

চীন মরণব্যাধি করোনার উৎস বলেই পরিচিতি পেয়েছে। করোনো ভাইরাস বিশ্বকে বদলেছে। কিন্তু দুই শক্তিধর দেশের নেতাকে অবশ্যই বদলায়নি। তারা যথারীতি মুখোমুখি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং অব্যাহতভাবে চাপানউতোর চালিয়ে যাচ্ছেন।

তবে ভ্যাকসিন নিয়ে দুই নেতার অগ্রাধিকারে একটা মৌলিক পরিবর্তন দেখছে বিশ্ববাসী। বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্যতম রাজধানী ঢাকায় বসে পর্যবেক্ষকরা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। ট্রাম্প বলেছেন, ভ্যাকসিন তৈরি হওয়া মাত্রই প্রতিটি মার্কিনের ঘরে পৌছে দেবেন। আর মি. শি সোমবার বলেছেন, ভ্যাকসিন তৈরি হওয়া মাত্রই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পৌছে দেওয়া হবে। চীনা ভ্যাকসিন ‘গ্লোবাল পাবলিক গুডের’ জন্য।   
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট গত ১৭ মে এক প্রতিবেদনে বলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানুয়ারি মাসের গোড়ায় ভ্যাকসিন বিষয়ে কাজ করতে শুরু করেছে। চীনের বিভিন্ন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া বলছে যে যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিযোগ ঠিক নয় যে, চীন  এটার উৎপত্তি ঘটিয়ে ছড়িয়েছে এবং তারা যথাসময়ে এসব তথ্য অবশিষ্ট বিশ্বের সঙ্গে শেয়ার করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র হিসেবে পরিচিত পিপলস ডেইলি। এই পত্রিকাটি শনিবার বলেছে ১১ জানুয়ারির আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নভেল করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি শুরু করেছিল, এটা কিসের প্রমাণ?  ট্রাম্প এবং কতিপয় মার্কিন রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যম এ বিষয়ে মিথ্যাচার করে চলছেন।

গত সোমবারে জেনেভায় বসেছিল হেলথ এসেম্বলি।  আর তখন একটা চাপের মধ্যে পড়েছিল চীন। এখন অবস্থা এমন যে চীনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার পাল্টাপাল্টি হুমকি চলছে। হুমকির মধ্যে দাঁড়িয়েছে দুই পরাক্রমশালী দেশ ।

তবে গত বছরের শেষদকে চীনের উহানে চিহ্নিত হওয়া ওই ভাইরাসের উৎপত্তি কিভাবে ঘটেছিল, সে জন্য বাদুরকে দায়ী করা হয়। কিন্তু বাদুর থেকে সরাসরি মানব দেহে প্রবেশের আগে আরেকটা কোন প্রাণীর দেহে ঢুকেছিল বলে মনে করা হয়।

চীনা সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট পত্রিকাটি পর্যন্ত বলেছে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে প্রথম এটি রিপোর্ট করার পর থেকে এটি প্রাণীদেহ থেকে মানব দেহে কি করে এর ট্রান্সমিশন ঘটেছিল, সেটা চার মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর এখনও তা স্পষ্ট নয়।

তবে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়ে পরস্পরকে দায়ী করে চলেছে।মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার সহকর্মীরা গোড়া থেকেই অবশ্য বলে আসছেন যে উহানের ল্যাবরেটরী থেকে এই করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে । যদিও তার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ মেলেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও চ্যালেঞ্জ করে বলেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রমাণ সরবরাহ করতে পারেনি । অবশ্য কতিপয় মার্কিন রাজনীতিক বলে আসছেন যে, বেইজিংকে বিশ্ব অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে । এবং এই ধারণার স্বপক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ।

তবে পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, এখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনোকে কেন্দ্র করে যা কিছুই বলবেন, তার একটি লক্ষ্য থাকবে ভোটব্যাংক তুষ্ট করা। তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জিং নির্বাচন।

এবং তিনি নিশ্চিতভাবেই পরবর্তী রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়াতে যাচ্ছেন। তিনি তাই চীনকে উদ্দেশ্য করে যাই বলছেন, তার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র মানবজাতির মঙ্গল এবং তার নিরাপত্তার বিষয়টি নয়। তার সঙ্গে অবশ্যই ভোটের রাজনীতির প্রভাব আছে।
গত শুক্রবার ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ গত ১১ জানুয়ারি প্রথম ভ্যাকসিন ডেভলপ করা শুরু করে দিয়েছিল । আর এটা তারা করেছিল অনলাইনে চীন ভাইরাসের জেনেটিক কোড আপলোড করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে।

ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, ১১ জানুয়ারি থেকে কি ঘটতে যাচ্ছিল তা অধিকাংশ মানুষ কখনো শোনেনি । এবং আমরা কোন কিছু না জেনে-শুনেই ভ্যাকসিনের কাজ শুরু করে দিয়েছিলাম । এটা কিসের বিরুদ্ধে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছিলাম, সে বিষয়ে আমাদেরও কোনো ধারণা ছিল না।


চীনা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত মিডিয়া বলেছে, মি. ট্রাম্প বর্ণিত দিনক্ষণটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ দিনটি ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেদিন ঘোষণা করেছে যে, জেনেটিক সিকোয়েন্সের বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করেছে চীন। তার ঠিক একদিন আগের ঘটনা ।

অবশ্য চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক কমপ্লিট জেনোম সিকোয়েন্সিং গ্লোবাল ডাটাবেজে আপলোড করেছিল  ১০ জানুয়ারি।

গত রোববার চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সিসিটিভি ভাষ্যকার মন্তব্য করেছেন যে, ট্রাম্পের ওই ঘোষণার পরপরই নেটিজেনরা দেশে-বিদেশে এই প্রশ্নটিকে সামনে তুলে আনে যে, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কবে থেকে এই ভাইরাসের বিষয়টি জানতো ? তাহলে কি তাদের এ বিষয়ে আগাম ধারণা ছিল?

 

চীনা প্রতিশ্রুতি:

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন । তিনি বলেছেন, এর ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হওয়া মাত্রই সারাবিশ্বের কাছে এটা সহজলভ্য করা হবে ।

ইতিমধ্যে তিন লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনা। গত সোমবার ওয়ার্ল্ড হেলথ এসেম্বলিতে দেয়া এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট শি অঙ্গীকার করেন যে, আফ্রিকার পাশে তিনি দাঁড়াবেন এবং তিনি একই সঙ্গে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আবেদন জানান। তিনি আরো প্রতিশ্রুতি দেন যে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে করোনা বিরোধী যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কার্যক্রমে দুশ কোটি ডলারের বেশি সহায়তা দেয়া হবে।

প্রেসিডেন্ট শি অবশ্য বলেননি কখন এই ভাইরাস আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে তিনি এটা জোর দিয়ে বলেছেন আবিষ্কৃত হওয়া মাত্রই এটা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পৌঁছে দেয়া হবে।

বিশেষ করে ভ্যাকসিন উন্নয়নশীল দেশগুলোর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে চীন বিশেষভাবে ভূমিকা রাখবে বলেও অঙ্গীকার করেন ।
ডেট্রয়েট নিউজের  এক খবরে বলা হয়, চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকেও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। কারণ এই দেশগুলো মনে করে চীন করোনাভাইরাস মোকাবেলায় যথাযথ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারেনি। অবশ্য প্রেসিডেন্ট শি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সহযোগিতা দেওয়ার ব্যাপারে এমন এক সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যখন মার্কিন প্রশাসন বলেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে আর কোন সাহায্য তারা করতে চান না । চীনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জন্য সহায়তা স্থগিত করেছে।
প্রেসিডেন্ট শির ঘোষণা এমন একটি সময় এসেছে, যখন বিশ্বে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে যে যখনই ভ্যাকসিন উৎপাদন হোক না কেন, তখন উৎপাদনকারীরা আগে তার নিজের চাহিদা পূরণ করবে। এরপর তা অন্যদেরকে দিবে। এতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে ভ্যাকসিন আসতে আরো দেরী হবে।  

বিশ্বব্যাপী বর্তমানে এক ডজনের বেশি ভ্যাকসিন প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে চীনের রয়েছে পাঁচটি। যা তারা মানবদেহে ইতিমধ্যে পরীক্ষা শুরু করেছে এবং আরো বেশি পরিমাণে তারা শুরু করবে আগামী মাস থেকে।

অপারেশন ওয়ার্ক স্পিড: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে অপারেশন ওয়ার্ক স্পিড চালু করেছেন ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য । এবং তিনি আশা করছেন যে এ বছরের শেষ নাগাদ এর কাজ শেষ হবে। তিনি বলেছেন, যখন ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রসঙ্গ আসে, তখন সে বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন সংকীর্ণতা থাকে না । বরং তারা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এ বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় । অবশ্য তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, আমেরিকানদের তাড়াতাড়ি ভ্যাকসিন দিতে হবে। ভ্যাকসিন উৎপাদন হওয়ামাত্রই প্রত্যেকটি প্লেন, ট্রাক এবং সৈনিকরা ভ্যাকসিন নিয়ে মার্কিন নাগরিকদের দ্বারে দ্বারে ছুটে যাবে।
অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্পষ্ট করে বলেছেন, তার সরকার করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করছেন । তারা প্রতিদিনকার তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কে দিচ্ছেন।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিজান বেইজিংয়ে এক নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বিশ্বাস করে মহামারী পরিস্থিতি অতিক্রম হয়ে যায়নি।  ঐ মুখপাত্র বলেন, এখন তাই মহামারি থেকে বাঁচাই হলো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার । তাই এই ভাইরাসের উৎস কি ছিল তা খুঁজে বের করাটা এই মুহূর্তের সর্বোচ্চ করণীয় নয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চলতি মাসেই অবশ্য বলেছে, তারা চীনে একটি নতুন মিশন পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা করছে । যার লক্ষ্য থাকবে ভাইরাসের উৎস চিহ্নিত করা । ডব্লিউএইচও গত ফেব্রুয়ারিতে একটি ডেলিগেশন পাঠিয়েছিল চীনে। চীন বলেছে, তারা একটি ব্যাপকভিত্তিক স্বাধীন নিরপেক্ষ তদন্ত অনুষ্ঠানকে স্বাগত জানায়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status