প্রবাসীদের কথা

লন্ডনে লকডাউনের শুরুর দিনগুলো

মাহবুবা জেবিন

১২ মে ২০২০, মঙ্গলবার, ১০:৩৯ পূর্বাহ্ন

হিম শীতের জড়তা কাটিয়ে আড়মোড়া ভাঙছে প্রকৃতি। সোনালী আভা ছড়িয়ে নতুন দিনের বার্তা নিয়ে আসছে রাঙাসকাল । মাটি ফুঁড়ে উঁকি দিচ্ছে টিউলিপ আর ডেফোডিলস, গাছে গাছে এসেছে নতুন পাতা। কচি সবুজ ডালে খেলা করছে নানা রঙের পাখিরা। তাদের কিচির-মিচিরে প্রাণ ফিরে পেয়েছে লন্ডন নেইবারহুড। চেরি ব্লসমে প্রকৃতি নতুন প্রাণ ফিরে পেলেও শঙ্কার কালো মেঘ উঁকি দিচ্ছে সবার মনে। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যে ভয়াল ছোবল বসিয়েছে কোভিড-১৯। রকেট গতিতে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা আর ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে মৃত্যুর গ্রাফ। একটা চাপা উৎকণ্ঠা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখছে সারাক্ষণ। মৃত্যুভয় আমাকে তাড়া করে ফিরছে। প্রায় প্রতিরাতেই ঘুম ভাঙছে দুঃস্বপ্ন দেখে। অজানা আশঙ্কায় সকাল-বিকাল ফোন করছি আম্মাকে। একদিকে ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে আম্মাকে বলছি কোন ব্যাপার না। আত্মীয় স্বজন সবার সাথে কথা বলে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করছি আর নিজেকে দিচ্ছি মিথ্যে প্রবোধ। এরই মধ্যে আমার নিত্যসঙ্গী হয়েছে হ্যান্ডস্যানিটাইজার আর এনটি ব্যাকটেরিয়াল ওয়াইপ্স ।

ইতিমধ্যে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর সবগুলো মহাদেশে। পরাক্রমশালী ক্ষমতাধর দেশগুলো নতজানু হয়েছে মস্তিষ্কবিহীন এক অণুজীবের কাছে। ব্রিটিশ মিডিয়া আশঙ্কা করছে- যুক্তরাজ্যের করোনা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে ।

স্যোসাল মিডিয়াতে অন্যান্য দেশের বাজার পরিস্থিতি দেখে লন্ডনের জনগণ আতঙ্কিত হয়ে ‘প্যানিক বায়িং’ শুরু করেছে । বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও খাদ্যসামগ্রীর শেলফগুলো নিমেষেই খালি হয়ে যাচ্ছে। সুপার মার্কেটগুলোতে তৈরি হয়েছে তীব্র সরবরাহ সঙ্কট। ফলে সুপার মার্কেটগুলো বাধ্য হয়েছে কিছু ক্রয়নীতিমালা আরোপ করতে। আমার প্রতিবেশি বন্ধুরা ফোন করে আমাদের খোঁজ নেয়ার পাশাপাশি বেশি করে শুকনো খাবার আর প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে রাখার পরামর্শ দিলেন। ফলাফল হিসেবে আতঙ্কিত হয়ে আমিও ছুটলাম সুপার মার্কেটে । কিন্তু গিয়ে ফাঁকা শেল্ফ ছাড়া আর কিছুই পেলাম না। সবচেয়ে অবাক বিষয় হলো, এ সময় টয়লেট টিস্যুর জন্য ব্রিটিশদের হাহাকার আমাদের এশিয়ান কমিউনিটিতে ছিল কৌতুকের বিষয়।

এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের প্রত্যাশিত লকডাউনের ঘোষণায় ঘরবন্দি হলেন ব্রিটিশরা। এনএইচএস সহ ফ্রন্টলাইনের কী-ওয়ার্কার ছাড়া কেউ বাসা থেকে বের হচ্ছেন না । একেবারে জনশূণ্য হয়ে গেল পথঘাট । প্রথম কয়েকদিন পরিবারের সাথে সময় কাটানো সবাই উপভোগ করলাম । আমার ছেলে খুশী, সারাদিন খেলা আর খেলা । ছেলের বাবা সারাদিন দেশে-বিদেশে বন্ধুদের সাথে গ্রুপচ্যাট আর ভিডিও কনফারেন্স করে খুবই আপ্লুত। আর শঙ্কা আমার ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। মনোযোগ অন্যদিকে ফেরাতে মন দিলাম ভিডিও কন্টেন্ট তৈরিতে। আমার জাহিনও উৎসাহের সাথে ক্যামেরার সামনে পোজ দিতে লাগলো। বেশ কয়েকটি লেখার ফরমায়েশ থাকলেও আমি ব্যস্ত হলাম রান্নাবান্না আর গানের চর্চায়।

সুনসান নীরবতা গ্রাস করেছে কর্মব্যস্ত লন্ডনকে। ডিপ্রেশন ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। তাই শরীরচর্চার জন্য বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা অনেকটাই শিথিল করা হয়েছে। প্রতিদিন একবার করে পার্কে দৌড়ানো বা শরীরচর্চাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তাইতো নির্জন রাস্তায় স্বাস্থ্য সচেতন অনেকেরই দেখা মিলেছে হরহামেশাই। লকডাউনের এক সপ্তাহের মধ্যেই লন্ডনের বাতাসে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমে গেল অভাবনীয় হারে । আকাশ বদলে গেল গাঢ় নীলে। সবুজ গালিচায় পরিণত হলো পার্কের ঘাস। ঝোপ-ঝাড়ের আড়াল ছেড়ে নির্ভয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে শুরু করলো বন্য প্রাণীরা ।

স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যুক্তরাজ্যের ঘরবন্দি শিশুরা আগাম ইস্টারের ছুটি কাটাচ্ছে পরিবারের সাথে। আমরাও বাতিল করলাম আমাদের হলিডে প্ল্যান । ক্লাস হোমওয়ার্কের তাড়া নেই বলে আমার ছেলে জাহিন ছবি আঁকাসহ নানা ধরণের বেকিং কুকিং শিখেছে। মাঝে মাঝে করছে মিউজিক। উৎসাহের সাথে প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হাততালি দিয়ে করোনা মোকাবেলায় ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা ডাক্তার ও এনএইচএস স্টাফদের সম্মান জানাচ্ছে আর রংধনু সম্বলিত নানা রকমের ছবি আঁকছে, কার্ড বানাচ্ছে । সে করোনা ভাইরাসের ছবি এঁকেছে। ব্যবহৃত টিস্যুর রোল আর চকলেটের বক্স টেপ দিয়ে লাগিয়ে রকেট তৈরি করেছে। এই রকেটে করে করোনাকে ‘আউট অফ স্পেস এ পাঠিয়ে দিবে। শিশুরাতো আর করোনার ভয়াবহতা বুঝে না। তারা বোঝে শুধু ঘরের বাইরে ভাইরাস আছে, আর তাদেরকে ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। ফেব্রুয়ারিতে ৭ বছর পার করা আমার ছেলে ছোট্ট জাহিন প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠেই প্রশ্ন করে- ‘মাম্মি ভাইরাস চলে গেছে?’ নিশ্চুপ আমি কোন উত্তর দিতে পারি না ।

এদিকে সরকারি ঘোষণায় বাসা থেকে অফিস করাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বড় বড় কোম্পানির অফিসগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যেখানে সম্ভব বাসা থেকে অফিস করছেন অনেকেই। ন্যূনতম স্টাফ দিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে সেন্ট্রাল লন্ডনের ব্যস্ততম অফিসপাড়া অনেকটাই জনশূন্য হয়ে পড়েছে। যেখানে প্রতিদিন সকালে অফিসগামী মানুষের ঢল নামতো, সেখানে আজ শুধুই শূন্যতা। ফাঁকা রাস্তায় মাঝে মাঝে নির্জনতা ভেঙ্গে শুধু সাইরেন বাজাতে বাজাতে তীব্র গতিতে ছুটে চলে এম্বুলেন্স ।

স্বাভাবিক সময়ে, ভোরের আলো ফোটার আগেই লন্ডনে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়ে যায় । সেন্ট্রাল লন্ডনমুখী আন্ডারগ্রাউন্ডে তিল ধারণের জায়গা থাকে না । করোনা মহামারী চলাকালীন এ সময়ের চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। আন্ডারগ্রাউন্ড রেল সার্ভিস চলছে হাতে গোনা যাত্রী নিয়ে। করোনার সংক্রমণ এবং মৃত্যুঝুঁকি কমাতে লকডাউনের পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। নানাভাবে মানুষকে ঘরে থাকতে আহবান করছে। পাতাল রেলস্টেশনগুলোতে বিরাজ করছে ভুতুড়ে পরিবেশ। সুনসান নীরবতা ভেঙ্গে বারবারই স্পিকারে শোনা যায়- অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ এড়িয়ে বাড়িতে অবস্থানের আহ্বান। ট্রেনের কামরার ভেতরে সবাই সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী দুই ফিট দূরত্ব বজায় রাখতে এক সিট বাদ দিয়ে দিয়ে বসছেন। সংক্রমণ এড়াতে প্রায় সবাই হাতে গ্লাভস ব্যবহার করছেন । অনেকেই মুখে পড়ছেন মাস্ক ।

প্রায় তিন সপ্তাহের বেশি বাসায় থাকার পর কী-ওয়ার্কার হিসেবে আমি কাজে যোগ দিলাম। কোন বাধ্যবাধকতা না থাকলেও আমার মন সায় দিল না ঘরে বসে থাকতে । আমার অনেক সহকর্মীরা কাজে যোগদান না করলেও আমি ফিরে এলাম প্রাত্যহিক কর্মব্যস্ত জীবনে। ব্যস্ততা আমাকে করোনার দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। মুক্তি দিয়েছে মৃত্যুর হিসাব রাখা টিভি নিউজ আর সোশ্যাল মিডিয়ার ঘেরাটোপ থেকে। আমি আবার নতুন করে নিঃশ্বাস নিচ্ছি মুক্ত বাতাসে। আমার ফ্যাকাসে হয়ে পড়া ত্বক পাচ্ছে সূর্যরশ্মির স্পর্শ । স্বপ্ন দেখছি করোনামুক্ত সুস্থ পৃথিবীর ।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status