অনলাইন

করোনার থাবা

স্তব্ধ নারায়ণগঞ্জে ইউরোপের আতঙ্ক

বিল্লাল হোসেন রবিন, নারায়ণগঞ্জ থেকে

৬ এপ্রিল ২০২০, সোমবার, ১:৫০ পূর্বাহ্ন

মরণব্যাধি করোনার থাবায় স্তব্দ নারায়ণগঞ্জ। দুইজনের মৃত্যু আর ১১ জনের আক্রান্তের খবরে আতঙ্ক চারদিকে। জেলার প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে সুনসান নিরবতা। রাস্তায় মানুষের নেই কোন কোলাহল। কঠোর অবস্থানে প্রশাসন। জেলাজুড়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর তৎপরতা। থেমে গেছে উৎপাদন আর উপার্জনের চাকা। দু-চারটি প্রতিষ্ঠান যা চলছে তাও প্রশাসনের নজরদারীতে রয়েছে। পরিস্থিতির ভয়বহতায় ইতিমধ্যে নারায়ণগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র সদর উপজেলাকে লকডাউন করা হয়েছে। বিধি-নিষেধ আনা হয়েছে লোকজনের চলাচলের উপর। বন্ধ রয়েছে গণপরিবহনসহ সব ধরনের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, বিপনীবিতান, মার্কেট। তবে ঔষুধের দোকান খোলা রয়েছে। তবে সদর উপজেলা ছাড়াও জেলার বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকার যুবকরা স্ব-উদ্যোগে যার যার এলাকায় লকডাউন করে দিয়েছে। এলাকার মসজিদের মাইকে কিছুক্ষন পর পর লোকজনকে জরুরী কাজ ছাড়া বাহিরে বের না হতে এবং করোনা থেকে নিজের এবং পরিবারের সুরক্ষায় ঘরে থাকার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
এদিকে লকডাউনের কারণে আতঙ্ক, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় প্রশাসনের চেয়ে লাঠি-সোঠা হাতে অতিউৎসায়ী যুবকদের তৎপতা চোখে পড়ার মতো। অভিযোগ রয়েছে, জরুরী প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে গিয়ে এলাকার ওই অতিউৎসাহী কতিপয় যুবকদের হাতে নাজেহাল হচ্ছেন মানুষ। বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আনার দাবি জানিয়েছেন ভোক্তভোগী লোকজন।
ওদিকে লোকডাউন দীর্ঘায়িত হতে পারে এই আশংকায় সোমবার সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন কাচাবাজারে লোকজনের ভীড় বেড়ে গেছে। দেশের অন্যতম পাইকারী বাজার শহরের নিতাগঞ্জে ক্রেতা বিক্রেতাদের ভীড় লক্ষনীয়। তবে পরিবহন সংকটের কারণে স্থানীয় কাঁচাবাজারগুলোতে আমদানী কমে গেছে। ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আবার সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজীর অন্যতম প্রধান বাজার সোনামিয়া বাজার সোমবার দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় প্রশাসন বন্ধ করে দিলে বিপাকে পড়ে আদমজীসহ আশপাশের ক্রেতা সাধারণ। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় সব ধরনের দোকান বন্ধ করে দিয়েছে তাতে সমস্যা নাই। কিন্তু বাজার বন্ধ করে দিলে আমরা তো না খেয়ে মারা যাবো। তারা বিষয়টিকে প্রশাসনের বাড়াবাড়ি বলে মন্তব্য করেছেন। প্রশাসন বাজার বন্ধ না করে ক্রেতা সাধারণের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবো।
যদিও রোববার নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান পুরো নারায়ণগঞ্জ এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী সিটি করপোরেশন এলাকাকে দ্রুত লক ডাউন করার আহবান জানিয়েছেন। পরে রাতেই জরুরী সভা ডেকে জেলা প্রশাসন লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়। এবং সোমবার সকাল থেকে প্রশাসন বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে লোকজনকে বাসা-বাড়িতে অবস্থান করার আহবান জানাচ্ছেন। এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিটি পাড়া মহল্লায় জরুরী প্রয়োজন ছাড়া লোকজনের চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সেখানে রিকসা পর্যন্ত চলতে দেয়া হচ্ছে না। এদিকে এমন পরিস্থিতিতে চরমভাবে বিপাকে পড়েছে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো।
এদিকে সোমবার জেলা সিভিল সার্জন অফিস জানিয়েছে, করোনা সন্দেহে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩১ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে এবং হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ১৫৭ জন।
রোববার নারায়ণগঞ্জে ১১ জনকে করোনায় আক্রান্ত জানালেও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানায় সংখ্যাটা হবে ১০। একজনের করোনায় আক্রান্তের বিষয়ে সন্দেহজনক হওয়ায় আইইডিসিআর এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২ জন, ৩ জন সুস্থ হয়েছেন এবং বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৫ জন।
বর্তমানে হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ১৫৭ জন। জেলায় মোট ৪৫০ জন হোম কোয়ারেন্টিন থেকে মুক্ত হয়েছেন। গতকাল নতুন করে ৩৬ জনকে হোম কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে। এনিয়ে জেলায় মোট ৬০৭ জনকে হোম কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে বিদেশ ফেরত মোট ৬০২১ জন।
লকডাউন নিয়ে শামীম-আইভী যা বললেন
এদিকে রোববার দুপুরে শামীম ওসমান এক ভিডিও বার্তায় বলেন, নারায়ণগঞ্জে ক্রমশ করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগই এটাকে রোধ করতে হবে। তাই আমি প্রশাসনকে অনুরোধ করবো যত দ্রুত সম্ভব পুরো নারায়ণগঞ্জকে লকডাউনের আওতায় আনুন। সেই সঙ্গে প্রশাসনকে এও আহ্বান জানাবো ‘লকডাউন’ মানে ‘লকডাউন’। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটতে দেয়া যাবে না। কাউকে যেন ঘর থেকে বের হতে না দেয়া হয়। আমাদের আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী, সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিতরা সক্রিয় আছেন। যে কেউ ফোন করলে আমরা তাদের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিব।
শামীম ওসমান আরও বলেন, এ সময়ে আমাদের কঠোর হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। বার বার প্রশাসন মাইকিং করে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরও দেখতে পাচ্ছি অনেকে বাইরে বের হচ্ছে। অনেক এলাকাতেও লোকজন জড়ো হয়। তাই অনতিবিলম্বে প্রশাসনকে বলবো কোনো দিক না তাকিয়ে আপনারা কঠোর হন। এখন বড় বিষয় পুরো জাতিকে রক্ষা করা। এজন্য যত কঠোর হওয়া প্রয়োজন আপনারা হন। আমরা আপনাদের পাশে আছি।
একইভাবে রোববার নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুল আমিন প্রেরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, সারা বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস সংক্রামণ মহামরী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। বাণিজ্যিক নগরী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকায় এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। দিন দিন সংক্রমন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সিটি এলাকায় ইপিজেড, গার্মেন্টস, হোসিয়ারীসহ ভারী শিল্প কল কারখানার পাশাপাশি চাল, ডাল, আটা, ময়দা, লবণসহ নিত্য পণ্যের পাইকারী বাজার রয়েছে বিধায় এলাকাটি শ্রমিক অধ্যুষিত। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ এই নগরীতে করোনা ভাইরাস সংক্রমনের ঝুঁকি অত্যাধিক। মানুষের জীবন রক্ষার্থে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ পূর্বক সার্বিক বিবেচনায় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী জরুরী ভিত্তিতে সিটি এলাকা লকডাউন/কারফিউ জারী করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন। অন্যথায় করোানা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যেতে পারে।
জেলা প্রশাসকের বক্তব্য
জেলা প্রশাসক মো. জসীম উদ্দিন বলেন, রোববার রাতে জরুরী বৈঠক করে সবার সম্মতিক্রমে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি নারায়ণগঞ্জ শহরের সদর উপজেলাধীন তিনটি থানা অর্থাৎ সিদ্ধিরগঞ্জ, সদর থানা ও ফতুল্লা থানা এলাকার কাউকে বাইরে যেতে দেওয়া হবে না এবং বাহির থেকে কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় হবে না।
জেলা প্রশাসক বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে আইইডিসিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সদর, ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকাকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। আমরা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি নারায়ণগঞ্জ শহরের সদর উপজেলাধীন তিনটি থানা অর্থাৎ সিদ্ধিরগঞ্জ, সদর থানা ও ফতুল্লা থানা এলাকার কাউকে বিনা প্রয়োজনে বাইরে যেতে দেওয়া হবে না এবং এই এলাকার বাইরে থেকেও বিনা কারণে কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না।
তিনি আরো বলেন, এসব এলাকায় বিনা প্রয়োজনে রিকশা, অটো রিকশা, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস আরোহী ও মোটরসাইকেলসহ যাত্রী বহনকারী ছোট বড় কোনো যানবাহনকে বিনা প্রয়োজনে রাস্তায় চলাচল করতে দেয়া হবে না।
আরোহী যে কাজেই বাইরে বের হোক তাদেরকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে এবং বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রশাসন নির্ণয় করবে। যদি অহেতুক কেউ বাইরে বের হন তবে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নেবে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে কিনা তা কঠোরভাবে নির্ণয় করা হবে।
জেলা প্রশাসক আরো জানান, সদর উপজেলার এই তিনটি থানা এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে চেকপোস্ট বসানো হবে। পুরো নিরাপত্তা বিষয়টির দায়িত্ব পালন করবে পুলিশ প্রশাসন। তাদেরকে সহায়তা করবে সেনাবাহিনী ও র‌্যাবসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য সংস্থাগুলো।
পুলিশ সুপারের বক্তব্য
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম বলেনছেন, সোমবার থেকে আমরা একেবারে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছি। কাউকে কোন প্রকার ছাড় দেয়া হবে না। নিয়ম ও নির্দেশনা মেনে সকলকে ঘরেই অবস্থান করতে হবে। রোববার রাতে জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে জরুরী সভা শেষে তিনি আরোও বলেন, নারায়ণগঞ্জে ইনপুট আউটপুট বন্ধ থাকবে। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের ও ঢুকতে পারবে না। এখন নারায়ণগঞ্জ বেশ গুরুত্বপূর্ণ সে কারণে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। সোমবার থেকে পিপিই প্রস্তুত করা ও বিদেশী অর্ডার ছাড়া বাকি সব গার্মেন্ট বন্ধ থাকবে। পরিস্থিতি ভালো না হওয়া পর্যন্ত আমরা কঠোর থাকবো।
তিনি বলেন, আমরা সবদিক বিবেচনা করে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোকে চিহ্নিত করেছি। সার্বক্ষণিক মোট ৩২টি চেকপোস্ট বসানো হবে। এসব চেকপোস্ট থাকবে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও র‌্যাব টহলের মাধ্যমে এসব চেকপোস্ট নজরদারিসহ পুলিশকেও সহযোগিতা করবে। সোমবার ভোর থেকেই চেকপোস্টের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কাউকে কোনোভাবে ছাড় দেয়া হবে না।
তিনি আরোও জানান, ইতোমধ্যে আমাদের মাইকিং চলছে। অলিগলি বাশ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status