অনলাইন

করোনা টেস্ট নিয়ে খামখেয়ালীপনার দায় কার?

নিজস্ব প্রতিনিধি

৬ এপ্রিল ২০২০, সোমবার, ৮:২৬ পূর্বাহ্ন

৫ এপ্রিল করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত নিয়মিত ব্রিফিং-এ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, “যেহেতু ভাইরাসটি নতুন, উন্নত বিশ্ব যেখান থেকে আমরা যন্ত্রগুলো নিয়ে আসছি তারাই পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে, সুতরাং আমাদের দেশেও এই সংক্রমণ অতিমাত্রায় ছড়িয়ে পড়লে মোকাবিলা করা অসম্ভব।”

এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে! যেই কথাটি বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলেন, সেটিই অবশেষে স্বীকার করলেন ডা. আবুল কালাম আজাদ। ব্রিফিং-এ তার বক্তব্যে হতাশার সুর ছিল স্পষ্ট। বলেছেন, ৩ মাস কাজ করেই শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ভুলের পুনরাবৃত্তি না করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু কী ভুল করেছেন তিনি? সেটি খুলে বলেননি। তবে তার কার্যক্রমে তা স্পষ্ট।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানতম পরামর্শ ছিল, “টেস্ট, টেস্ট ও টেস্ট।” এখনও প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া এই রোগের বিস্তার প্রতিরোধে একমাত্র উপায় হলো, পরীক্ষার মাধ্যমে রোগী শনাক্ত করা। এরপর রোগীর সংস্পর্শে কারা কারা এসেছেন, তাদের পরীক্ষা করা ও আইসোলেট করা। আবুল কালাম আজাদ করেছেন তার ঠিক উল্টোটা। পরীক্ষা যত কম করা যায় সেটিই যেন ছিল তার লক্ষ্য।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গড়িমসি ও আপত্তির কারণেই রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর বাইরে অন্য কোথাও পরীক্ষা চালু করা যায়নি দীর্ঘদিন। ভাবা যায় ১৬ কোটি মানুষের দেশে পরীক্ষার জন্য একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান!

প্রতিদিন আইইডিসিআর-এর হটলাইন নম্বরে হাজার হাজার ফোনকল এসেছে। কিন্তু বিদেশ ফেরত ও আক্রান্তদের সংস্পর্শে না এসে থাকলে পরীক্ষা করানো হয়নি০০। অজুহাত দিয়ে বলা হয়েছে, কম্যুনিটি সংক্রমণ শুরু হয়নি। ৩০ মার্চ পর্যন্ত হটলাইনে কল এসেছে সাড়ে ৯ লাখের বেশি। আর পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ১৩০০! পরীক্ষা না করেই ঘোষণা দেওয়া হয় যে, দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে! আশ্বস্ত করা হয় যে, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। দেশে করোনার রোগীই পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, এত কম টেস্ট করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের করোনা আক্রান্ত রোগী ও মৃতের হার হয়ে উঠে বিশ্বের সর্বোচ্চ। আবার প্রতি ১০ লাখ মানুষের বিপরীতে পরীক্ষা করার হার হয় বিশ্বে সর্বনিম্ন!

ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বারবার প্রশ্নের মুখে পড়লেও, আইইডিসিআর থেকে সাফ জানানো হয়েছে, দেশের অন্য কোথাও করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা যাবে না। কেন? জবাবে আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, ‘পরীক্ষার যন্ত্র বা রিএজেন্ট থাকলেই চলবে না; জৈবনিরাপত্তা (বায়োসেফটি) আছে এমন ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা করতে হয়। যেন পরীক্ষার সময় স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত না হন।’

অথচ, যথাযথ পরীক্ষাগার, স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ও দক্ষ কর্মী থাকা সত্ত্বেও, দেশের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনকে (নিপসম) কাজে লাগানো হয়নি। বিশ্বব্যাপী পরিচিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি) কাছ থেকে কিট সংগ্রহ করে আইইডিসিআর প্রথম করোনাভাইরাস পরীক্ষা শুরু করে। কিন্তু আইসিডিডিআর,বি’র নিজস্ব ৮টি পিসিআর মেশিন ও অত্যন্ত দক্ষ লোকবল থাকলেও, প্রতিষ্ঠানটিকে কাজে লাগানো হয়নি। এমনকি প্রতিষ্ঠানটি নিজ থেকে প্রস্তাব দিলেও নিশ্চুপ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নিষ্ক্রিয় রাখা হয় ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারকে, যাদের ৩টি পিসিআর মেশিন ছিল। দেশের মেডিকেল কলেজ ও বায়োপ্রকৌশল নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্য নেওয়া হয়নি। যারা ল্যাবে পরীক্ষার কাজ করবেন, তাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরেও পরীক্ষা শুরুর অনুমতি দেওয়া হয়নি।

বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সচিব বারবার পরীক্ষার আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিলেও কর্ণপাত করেননি ডা. আবুল কালাম আজাদ। অনেকেই উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, তাঁর খুটির জোর কোথায়! অবশেষে মার্চের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী নিজে পরীক্ষার সংখ্যা ও আওতা বাড়ানোর তাগিদ দেন। এরপরই টনক নড়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তররের মহাপরিচালকের। মোট ১০টি ল্যাব প্রস্তুত রাখা হয়। কিন্তু তাদেরকে পর্যাপ্ত কিট না দিয়ে বেশ কয়েকদিন নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। আইসিডিডিআর,বি’কে দেওয়া হয় মাত্র ১০০টি কিট। বলা হয়, আইইডিসিআর-এ পরীক্ষা করা সম্ভব না হলেই এই ল্যাবগুলোতে পরীক্ষা করা যাবে, তার আগে নয়।

অবশেষে চাপের মুখে সারাদেশজুড়ে ২৮টি ল্যাব প্রস্তুত করা হয়েছে। আইইডিসিআর ছাড়াও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়েছে। গত কয়েকদিন আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এদের অনেককেই শনাক্ত করা হয় আইইডিসিআর’র বাইরের ল্যাবে। এ থেকে বোঝা যায় পরীক্ষার ব্যাপ্তি বাড়ানো কত প্রয়োজন ছিল! সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশের ৬৪টি জেলার হাসপাতালের ল্যাব টেকনিশিয়ানদের পর্যন্ত অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্সিং করে নমুনা সংগ্রহের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই উদ্যোগ এতদিন নেওয়া হলো না কেন? কেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআর গোয়ার্তুমি করে পরীক্ষা যতভাবে কম করা যায়, তা নিশ্চিতে সচেষ্ট ছিল? এখন কীভাবে সারাদেশে ২৮টি ল্যাব প্রস্তুত রাখা সম্ভব হলো? এতদিন স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার অজুহাতে অন্য কোথাও পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়নি। তাহলে এখন কীভাবে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ল্যাব সহকারীকে পর্যন্ত স্যাম্পল সংগ্রহের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তা-ও অনলাইনে? কেন পরিস্থিতি জটিল দিকে মোড় নেওয়ার পর টনক নড়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের?
ডা. আবুল কালাম আজাদের গোয়ার্তুমি ও গড়িমসির জন্য জাতিকে কতটা চড়া মূল্য দিতে হবে, তা-ই এখন প্রশ্ন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status