অনলাইন

বিলেতের জার্নাল: জনক-জননীদের কষ্টের দীর্ঘ প্রহর

যুক্তরাজ্য থেকে ডা: আলী জাহান

৫ এপ্রিল ২০২০, রবিবার, ৮:৪৭ পূর্বাহ্ন

১৩ বছরের ইসমাইলের জানাজার দৃশ্য

আমার চার সন্তানের ভেতর দুই সন্তানের বয়স পাঁচ বছরের নিচে। গ্রেট ব্রিটেনে অঘোষিত লকডাউন চলছে। খাবার, ওষুধ বা ডাক্তারের প্রয়োজন না হলে বাইরে বেরোলেই পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করবে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে আছে। সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত কারখানা সবই বন্ধ। তবে জরুরি সেবা প্রদানকারী হাসপাতাল এবং পুলিশ বিভাগ খোলা।


যেহেতু আমি হাসপাতালের ডাক্তার তাই আমাকে আরো অনেকের মতো হাসপাতালে যেতেই হয়। এ দায়িত্ব এবং কর্তব্য থেকে আমার পিছপা হওয়া সুযোগ নেই। বৃটেনের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এনএইচএস এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে চলার চেষ্টা করি। এরপরও ঝুঁকি থেকে যায়। আমি জানিনা বাতাস থেকে, কারো কাছাকাছি আসা থেকে, অফিসে চেয়ারে বসা থেকে, দরজা বা কারের হাতল থেকে কভিড ১৯ নামক অদৃশ্য ঘাতক আমার সাথে চলে আসে কিনা।

বাসায় স্ত্রীর উদ্বিগ্ন মুখ আছে। মা এখনো বেঁচে আছেন। বাংলাদেশে থাকা মায়ের সাথে উদ্বিগ্ন ভাই-বোনদের ভয় কখন যে কি হয়ে যায়! ছোট বোন গুলশান পূবালী ব্যাংকে কাজ করে। ভয়ে ভয়ে এখনো তাকে ব্যাংকে যেতে হয়। বাংলাদেশে ব্যাংক এখনো বন্ধ হয়নি। নিজের ভয়ের সাথে নতুন যোগ হয়েছে ব্রিটেনে থাকা বড় ভাই, ভাবী এবং তার সন্তানদের ভয়। সে কয়েকবার মাকে বলেছে, ' ডাক্তার ভাইকে ছুটি নিতে বলো। এরকম ঝুঁকি নিয়ে ডিউটি করার কোন মানে হয় না।' মা হাসিমুখে জবাব দিয়েছেন ' ডাক্তাররা যদি ছুটি নিয়ে নেয়, হাসপাতালে রোগী দেখবে কে?'

জননীর মনে ভয় আছে, আশঙ্কা আছে। ব্রিটেনে এখন পর্যন্ত ৪ জন ডাক্তার করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তাঁর মেজো ছেলে সেই ঝুঁকিতে আছে। তিনি বাংলাদেশে থাকা আমার ভাই বোনদের অভয় দেন। ফোনে আমাকেও সাহস দেন। তবে এখন পর্যন্ত আমাকে বলেননি 'তুমি হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে নাও।' জননীর মনে তাঁর সন্তানদের নিয়ে ভয় আছে। তবে সে ভয় দেখিয়ে তিনি আমাকে আমার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে এখনো বলেননি। বললে হয়তো আমার পক্ষে তার কথা মেনে চলা কঠিন হবে। সন্তানদের নিয়ে জনক-জননীদের অনেক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকে। তবে সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাদের সন্তানদের ঘরে বেঁধে রাখতে পারেনা।
অতীতেও পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হয় না।


হাসপাতাল থেকেই যখন বাসায় ফিরি, তখন প্রথম কাজটি হয় গায়ের জামাটি পরিবর্তন করা। সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। সঙ্গে সঙ্গে শাওয়ার করে নতুন কাপড় পরা। তার আগে কোথাও স্পর্শ না করা। অদৃশ্য ঘাতক যদি আমার সাথে চলে আসে, সেই ঘাতককে পরিবারের বাকি সদস্যদের কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে।

আমার ৩ এবং ৫ বছর বয়সী সন্তানরা ব্যাপারটি পুরোপুরি বুঝতে পারেনা। দরজা খোলার সাথে সাথে ছোট ছেলে দৌড়ে আসে। জনকের কোলে উঠতে চায়। ৮ ঘন্টা পরে বাবাকে পেয়েছে। একটু আদরের আশা করতেই পারে। ৫ বছর বয়সী মেয়ে আশে পাশে ঘুরঘুর করে। আমার শরীর স্পর্শ করতে চায়। ওদের দুজনকেই পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি শাওয়ার রুমে যাই জামাকাপড় বদলাবার জন্য। সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ভালো করে পরিষ্কার করার জন্য। ছোট দুই ছেলেমেয়ে তাদের জনকের এ ব্যবহার দেখে মনে মনে কী ভাবে তা আমি জানিনা। জনক জননীর উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বোঝার বয়স তাদের হয়নি। আমরাও তাদের বোঝাতে পারছি না।

ব্রিটেনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মিছিলে যোগ হওয়া সর্বকনিষ্ঠ রোগীর বয়স ১৩ বছর। গত সোমবার লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত হয়ে ১৩ বছরের ইসমাইল যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তখন তার আশেপাশে আত্মীয় স্বজন ছিল না।


মা-বাবা ভাই-বোন বন্ধু-বান্ধব কাউকেই এ ঘাতক রোগে আক্রান্ত ছোট্ট ইসমাইলের পাশে হাসপাতালে আসতে দেয়া হয়নি। এমনকি তার মারা যাবার পর কাউকেই তার মৃতদেহ দেখতে দেয়া হয়নি। পরিবারের সবাইকে এখনো কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।


ছোট্ট ইসমাইলের শেষ যাত্রা সম্পন্ন হয়েছে।বিশেষ ব্যবস্থায় কবরস্থানে থাকে শায়িত করা হয়েছে। বিশেষ ভাবে জানাজার নামাজ পড়া হয়েছে। হাতেগোনা গুটি কয়েক মানুষকে ( চাচা, কয়েকজন চাচাতো ভাই) জানাযায় আসতে দেয়া হয়েছে। জানাজার নামাজে যারা দাঁড়িয়েছেন তাদের একজন আরেকজন থেকে ২ মিটার দূরত্বে অবস্থান করেছেন। জানাজায় অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তা বর্ম বা PPE পরে আসতে হয়েছে।ইসমাইলের জানাযা ও দাফনের দৃশ্য অনলাইনে তার মা এবং ছয় ভাইবোন বাসা থেকে দেখেছেন।

আমি চেষ্টা করছি ইসমাইলের জননীর মনোজগত বিশ্লেষণ করার। অনেকটা ব্যর্থ অনুমান করার চেষ্টা করছি তার ছয় ভাইবোনের মনোজগতে এখন কী আছে তা জানার জন্য।


মা-বাবা ভাই-বোন বন্ধু-বান্ধব কেউই হতভাগা ইসমাইলকে হাসপাতালের বিছানায় শেষ বিদায় দিতে পারেননি। চির বিদায় নেবার পরেও কপালে স্পর্শ করে শেষ চুমু দিতে পারেননি। বাবা আমার, ভাই আমার- ইসমাইলের নিথর শরীর ধরে এই শেষ চিৎকারও কেউ দিতে পারেননি। ইসমাইলের মা এবং ছয় ভাইবোন কোয়ারেন্টাইনে এখন। এর
ভেতরে দুজনের করোনার উপসর্গ দেখা দিয়েছে।

করোনা ভাইরাস এখন আর বয়সের পার্থক্য করে না। শিশু, তরুণ, মধ্য বয়স, বৃদ্ধ বয়স- কাউকে রেহাই দিচ্ছে না। অদৃশ্য, নিঃশব্দ ঘাতক থেকে আমাদের কেউই এখন আর নিরাপদ নই। আমরা এখন অসহায়।

আপনার প্রিয় মেয়ের বয়স হয়তো এখন চার বছর। স্কুল বন্ধ। বাসায় হইচই করছে সব সময়। ভাই বোন, মা-বাবাকে তটস্থ করে রেখেছে। একবার ওই রুম আরেকবার ওই রুমে গিয়ে ভাই-বোনদের জ্বালাচ্ছে। টেলিভিশনের চ্যানেল বারবার বদলাতে ব্যস্ত। হাতে একবার ফোন নিচ্ছে, আরেকবার আইপ্যাড নিচ্ছে, কখনো ট্যাবলেট নিচ্ছে।

জনক, জননী- আপনাদের জন্য একটি দুঃসংবাদ আছে। আপনার মেয়ে যদি করোনা আক্রান্ত হয়, ইংল্যান্ডে থাকলে এম্বুলেন্স এসে তাকে নিয়ে যাবে। মেয়ে যতই মা-বাবা বলে কাঁদতে থাকুক, চিৎকার করতে থাকুক, কাউকেই এম্বুলেন্সের সঙ্গে যেতে দেয়া হবে না। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য তৈরি বিশেষ হাসপাতাল বা ইউনিটে তাকে রাখা হবে। আপনার প্রিয় মেয়েকে দেখার জন্য আপনি হাসপাতালে যেতে পারবেন না। একটি অচেনা অচেনা জগতে আপনার প্রিয় সন্তানকে আইসোলেশন রাখা হবে। আপনি হয়তো এর কিছু দৃশ্য মোবাইলে দেখতে পারেন। মা মা বলে বাবা বাবা বলে যতই কাঁদুক আপনি কিন্তু তাকে দেখতে যেতে পারবেন না। মেয়েকে স্পর্শ করতে পারবেন না। যদি মেয়ে সৌভাগ্যবতী হয় তাহলে আপনাদের কাছে ফিরে আসবে। আর যদি কিশোর ইসমাইলের মতো দুর্ভাগা হয়, পরবর্তী দৃশ্যগুলো হয়তো আপনাকে শুধুই মোবাইল বা টিভির পর্দায় দেখতে হবে।

জগতের জনক-জননীদের এমন কঠিন সময় এর আগে কখনো এসেছিল কিনা আমার জানা নেই। আমাদের সকলের ঘরেই শিশু-কিশোর ইসমাইল আছে। জগতের মালিক, অসীম ক্ষমতার আধার মাবুদে এলাহি, আমাদের রক্ষা করো। আমাদের জনক-জননীরা এতো কঠিন হৃদয়ের অধিকারী নয় যে তাদের চোখের সামনে প্রাণ প্রিয় সন্তানদের করোনা ভাইরাস নিয়ে যাবে
কিন্তু তারা কিছুই করতে পারবে না।



(ডা: আলী জাহান ব্রিটেনে কর্মরত চিকিৎসক)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status