অনলাইন

আমি স্বপন বলছি

শামীমুল হক

৩১ মার্চ ২০২০, মঙ্গলবার, ১১:২৭ পূর্বাহ্ন

হ্যালো শামীম ভাই, আমি স্বপন বলছি। এ হাই স্বপন। আমেরিকা থেকে। গত তিন বছরে কমপক্ষে শতবার ফোন করেছেন।  চিৎকার করে কাঁদতেন। বলতেন, শামীম ভাই মাফ করে দিয়েন। কখন যে মরন ডাক দেয় তার ঠিক নেই। ওপেন হার্ট সার্জারি হওয়ার পর বলতেন, এমনিতেই মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। সতর্ক হয়ে চলবেন। দীর্ঘ দুই যুগের ও বেশি সময় একসঙ্গে কাজ করেছি। সহকর্মী হিসেবে ছিলেন সেরাদের সেরা। অফিসের সব পর্যায়ের সহকর্মীদের কাছে ছিলেন প্রিয় । ভালোবাসা যেমন বিলিয়ে দিয়েছেন তেমন অর্জন করেছেন স্নেহ, শ্রদ্ধা। এমন একজন ভালো মনের মানুষকে করোনার থাবায় হারিয়ে ফেলব কল্পনাও করিনি। তিনদিন আগেই আরেক সহকর্মী শওকত ওসমান রচি'র ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে জেনেছি এ হাই স্বপন হাসপাতালে ভর্তি। জ্বর, ঠান্ডা, গলাব্যাথা। বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। স্বপন ভাই কি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত? সোমবার রাতে যখন তার মৃত্যুর সংবাদ শুনলাম একেবারে থমকে যাই। বিশ্ব যখন কাঁপছে করোনা আতংকে তখনই করোনা থাবা মেলে তার উপর। হাজার মাইল দূর থেকে বাংলাদেশে বয়ে যায় শোকের বন্যা। ফেসবুক ওয়ালে শুধু এ হাই স্বপনের ছবি। বন্ধু,  স্বজন, সহকর্মীরা জানাচ্ছেন শোক। শোকের এই বন্যাই বলে দেয় স্বপন তার কর্মজীবনে সহকর্মীদের ভালোবাসা অর্জন করেছেন। বন্ধুদের আস্থা অর্জন করেছেন। সপ্তাহ দশদিন আগে আরেক সহকর্মী কামরুল আম্বিয়া নিউ ইয়র্ক থেকে ফোন করেন। নানা স্মৃতি আওড়াতে গিয়ে এক পর্যায়ে এ হাই স্বপনের শারীরিক সমস্যার কথা তুলে ধরেন। বলেন, স্বপন ভাইয়ের জন্য দোয়া করবেন। শরীরটা তার ভাল যাচ্ছে না।

সত্যি বলতে কি, স্বপন আমেরিকায় গিয়েছেন বটে। কিন্তু তার মত দিলখোলা মানুষ বাংলাদেশ ছেড়ে গিয়ে একেবারে ভেঙ্গে পড়েন। প্রত্যেকবার ফোন করলেই বলতেন, শামীম ভাই বড্ড ভুল করেছি আমেরিকা এসে। বাংলাদেশই সেরা। যেখানে প্রেম, ভালোবাসা আছে। আদর,  সোহাগ আছে। একের প্রতি অন্যের টান আছে। আর আমেরিকা যান্ত্রিক শহর। প্রত্যেকে নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে মজা করে বলতাম, খাওয়া দাওয়া কেমন চলে? ভোজন বিলাসী স্বপন হেসে দিয়ে বলতেন, না ভাই খাওয়া দাওয়া একেবারে ছেড়ে দিয়েছি। ঢাকার অলিগলি, এমাথা থেকে ওমাথা কোথায় কোন খাবার পাওয়া যায় তার ছিল মুখস্ত। প্রায়ই নানা খাবার নিয়ে আসতেন অফিসে। সবাইকে নিয়ে খেতেন। ঢাকার পত্রিকা জগতের আলোচিত একজন ফটোসাংবাদিক স্বপন।  ছিলেন ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের কর্মকর্তা। মনে রাখার মত কতো ছবি যে তুলেছেন তার ইয়ত্তা নেই। বহু রিপোর্টারের রিপোর্ট সমৃদ্ধ হয়েছে তার ওঠানো ছবি দিয়ে। বহু কঠিন অ্যাসাইনমেন্ট কভার করেছেন ঝুঁকি নিয়ে। তার মটোরবাইকে চড়েননি এমন রিপোর্টার খুব কম। রাত কিংবা ভোর সময় কিংবা অসময় ফোন করে বলেছি স্বপন ভাই এই ছবিটা প্রয়োজন। বেরিয়ে পড়তেন। যথাসময়ে ছবি এনে সামনে হাজির করতেন। এমন করিৎকর্মা সহকর্মী পাওয়া এ সময়ে দুস্কর। তারপরেও  কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই তার প্রতি হয়েছি রুষ্ট। ধমক দিয়েছি।  কিন্তু তিনি হাসি দিয়ে রাগ একেবারে পানি করে দিয়েছেন। ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের পৈত্রিক বাড়িতেই বসবাস করতেন। অভাবও ছিল না। আমেরিকায় থাকা ছোট ভাই অকাতরে সহযোগিতাও করতেন। তারপরেও স্বপন কেন গেলেন আমেরিকায়? এটা জানতে চাইনি কখনোই। আমেরিকায় পাড়ি জমিয়ে তিনি কি সুখী ছিলেন? নিজেই বলতেন, ভাই আমি আমেরিকায় এসে সুখী নই। মনে হয় উড়ে ঢাকায় চলে আসি। আমেরিকা গিয়েই পরেন হার্ট অ্যট্যাকের কবলে। দীর্ঘ চিকিৎসার পর করা হয় ওপেন হার্ট সার্জারি। তারপর ডাক্তারের পরামর্শে দীর্ঘ বিশ্রাম। কিন্তু এ হাই স্বপন তো বিশ্রামে থাকার লোক নন। এখানে সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। মাস দেড়েক আগে ফের অসুস্থতায় পড়েন। হাসপাতালের আইসিইউতে থাকতে হয় বেশ কদিন। সে সময় সবাই তার বেঁচে থাকার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি ফিরে আসেন। সর্বশেষ করোনা ভাইরাসের থাবা থেকে তিনি আর ফিরে আসতে পারেন নি।  সোমবার রাতের খবরটি পেয়ে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। স্বপন ভাইয়ের স্ত্রী সন্তানরা কিভাবে সইবে এ শোক? তার সন্তানরা বাবার লাশটি ও শেষবারের মত দেখতে পাবে না। এ দুঃখ রাখি কোথায়? আর আমেরিকা থেকে ফোন করে বলবে না-হ্যালো শামীম ভাই, আমি স্বপন বলছি। ভালো মানুষেরা বুঝি এভাবেই চলে যায়।

স্বপন ভাই, যতদিন বেঁচে থাকব আপনার স্মৃতি ভুলতে পারব না। মনের গহীনের এসব স্মৃতি আজীবন ভাবাবে। কাঁদাবে। পরপারে ভাল থাকুন স্বপন ভাই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status